করোনা মানুষকে জীবনের নতুন শিক্ষা দিয়েছে। জীবন যে ঠুনকো এই সত্যে বিশ্বাস আরো গভীর করেছে। আগেও জীবন ঠুনকো ছিল কিন্তু জীবনের প্রতি মায়া ছিল বেশি। এখন জীবন যে তুচ্ছ সেটিও কারো কারো কাছে ধরা দিচ্ছে। বিশেষ করে যারা বইয়ের মধ্যে থাকেন তারা এই পৃথিবীতে মানুষের স্থায়ীত্ব ব্যাপারটা নিয়ে এখন আরো সতর্ক।
গ্রামে যখন কোনো মেলা হয়, তখন সেই গ্রাম ও তার আশপাশের গ্রামে নাইওর আসে। মেলাকে ঘিরে মেয়েরা বাবার বাড়িতে আসে। ছেলেমেয়েরা মামাবাড়িতে আসে। আরো দূরের সম্পর্কের মানুষও আত্মীয় বাড়িতে যায়। মেলার একটা প্রভাব ঘরবাড়িতে থাকে। নদীসংলগ্ন জেলাগুলিতে যখন নৌকাবাইচ হয় তখনও কয়েকটি গ্রামে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। ঘরে ঘরে এক অন্যরকম আনন্দ এসে পড়ে। সেই আনন্দ থাকে খাবার দাবারে, পোশাক আশাকে, গপসপে।
অমর একুশে বইমেলার শক্তি আরো বেশি। সারাদেশের অনেক গ্রাম, উপশহর থেকে মানুষ বইমেলার জন্য ঢাকা আসেন। কেউ আত্মীয় বাড়িতে ওঠেন। কেউ ওঠেন হোটেলে। কারো কারো বইমেলার টানে টানা ঢাকা অবস্থান করতে গিয়ে অনেক ঝামেলা ও সংকটেও পড়তে হয়। তারপরও সবকিছু পেরিয়ে বইমেলার ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই তিনি স্বপ্ন ভূবনের সন্ধান পেয়ে যান।
বইমেলার পরিচিত মুখ কবি, গবেষক আহমাদ মাযহার। থাকেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। করোনার কারণে পর পর দুই বছর বইমেলায় আসতে পারেননি। এবার মেলায় এসে প্রাণের সংযোগটি নবায়ন করলেন। বিকেল থেকে মেলার শেষ অবধি তার সুগভীর ও আন্তরিক উপস্থিতির সুবাদে সঙ্গলাভ হচ্ছে প্রিয় কবি লেখক প্রকাশকদের। যদিও অনলাইনের পৃথিবীতে কেউ কোনো দূরত্বেই থাকতে পারে না, তারপরও শারিরীক উপস্থিতির শক্তিটিকে তুচ্ছ করার সুযোগ কোথায়। তার মতো অনেকেই এসেছেন এবার। মার্কিন যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী লেখক ও সংস্কৃতিপ্রাণ খাদিজা রহমানও বইমেলায় এসে তারা ঢাকার জীবন ও একুশে বইমেলার পরিবর্তনটাও গভীরভাবে ধরতে পারছেন। তারা যেখানেই দাঁড়াচ্ছেন সেখান থেকেই পেয়ে যাচ্ছেন বইমেলার নৈসর্গিক সৌরভ। যারা বইমেলার সঙ্গে আপাদমস্তক যুক্ত অনেকসময় তারাও বইমেলার এমন শক্তি খুঁজে পান না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শামীম পারভেজ নিজেকে পুরোপুরি নিমগ্ন করেছেন বইমেলায়। বইমেলায় আসবেন বলে অনেক আগে থেকেই পরিবার পরিজনকে বুঝিয়ে রেখেছেন, অন্তত ফেব্রুয়ারির একটা মাস তাকে যেন নিরঙ্কুশ বইমেলা উপভোগের সুযোগ দেয়া হয়। আর কোনোকিছুর মধ্যেই তিনি থাকতে চাননা। শামীম পারভেজ লেখালেখি করেন। সংগঠনও করেন। তার মতোন কেউ কেউ আছেন হয়তো। কিন্তু সত্যিকার অর্থে সবকিছু থেকে মুক্ত হয়ে শুধু বইমেলা উপভোগের বিষয়টি অন্যরকম।
পুলিশের এক পদস্থ কর্মকর্তা বহুদিন পর পনের দিনের অর্জিত ছুটি পেয়েছেন। তিনি দায়িত্ব পালন করেন পার্বত্য এলাকায়। ছুটিটি তিনি মিলিয়েছেন এবারের বইমেলার সঙ্গে। প্রতিদিন বইমেলায় আসেন। শুরু থেকে শেষ থাকেন। এবার বইমেলায় তার একটি বই এসেছে। বললেন, একজন লেখক হিসেবে বইমেলায় উপস্থিতির মধ্যে যে প্রাপ্তি, তার সঙ্গে কোনোকিছুকেই মেলানো যায় না।
(চলবে)