করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকবেলায় দেশের অনেক বড় বড় শিল্প-কারখানা হিমশিম খেলেও একটি প্রতিষ্ঠান ছিল ব্যতিক্রম। মার্চ মাসের শুরুর দিকে দেশে করোনা সংক্রমন শুরু হলে অনেকের মতো তৈরী পোশাক শিল্পখাতের এ প্রতিষ্ঠানটিও তাদের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। কিন্তু কারখানা খোলার পর ১২ হাজার কর্মীকে সুরক্ষিত রেখেছে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়।
করোনা আক্রান্ত কর্মীদের কোয়ারেন্টাইনে রেখে তাদের খাওয়া দাওয়াসহ চিকিৎসার ব্যবস্থা করে প্রতিষ্ঠানটি শ্রমিকদের মন জয় করেছে। এর ফলও পাচ্ছে। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে শ্রমিকরা ব্যাপক উৎসাহে কাজে মনোযোগী হয়েছে।
রাজধানী ঢাকার অদূরে গাজীপুর বোর্ডবাজারে অবস্থিত হান্নান গ্রুপ এই অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রেখেছে করোনার দু:সময়ে।
প্রতিষ্ঠানটির মোট ১৩’শ ৫৭ জন শ্রমিক প্রায় দুইমাস কোয়ারেন্টাইনে থেকেছে, যাদের মধ্য থেকে পরীক্ষায় মাত্র ১৪৩ জনের করোনা পজেটিভ পাওয়া যায়। তাদের মাঝে নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে করোনায় আক্রান্তের হারও কমিয়ে এনেছে হান্নান গ্রুপ। এসময়ে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে কমবেশি ছাঁটাই হলেও গত দুই মাসে ৫টি ইউনিটে নতুন করে প্রায় ১৬’শ কর্মীর চাকরি হয়েছে হান্নান গ্রুপে।
এই গ্রুপে মোট পাঁচটি ইউনিটে ১২ হাজারেরও বেশি কর্মী কাজ করেন। করোনার প্রকোপ শুরু হলে সকল কর্মীকে ছুটি দেয়া হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে লকডাউন শিথিল করার পর ২৭ এপ্রিল হান্নান গ্রুপের সব কারখানা খুলে দেয়া হয়। যদিও প্রথম দুদিন উৎপাদনের তেমন কাজ হয়নি। কর্মীদের মধ্যে নূন্যতম সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে প্রচেষ্টা চালান কর্মকর্তারা। কারখানার ডাম্পিং এরিয়াতে (যেখানে তৈরী পণ্য রাখা হয়) ডাইনিং হলের চেয়ার টেবিল এনে কাজের ব্যবস্থা করা হয়। ডাইনিং হলকে ডাম্পিং এরিয়া বানানো হয়। এতে কর্মীদের কাজের ক্ষেত্র বেড়ে যায়।
কারখানা খোলার আগে কয়েকজন নির্বাহী করোনায় আক্রান্ত হলে তাদের দু:শ্চিন্তা বেড়ে যায়। এ পর্যায়ে কারখানা থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে একটি ভবন ভাড়া করা হয়। সেখানে বিছানাপত্রসহ সকল ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করা হয়, নিশ্চিত করা হয় কোয়ারেন্টাইন।
এ বিষয়ে হান্নান গ্রুপের কোম্পানির চেয়ারম্যান এবিএম সামছুদ্দিন জানান, কারখানা খোলার প্রথম দিন থেকে কর্মীদের শরীরের তাপমাত্রা মাপা শুরু হয়। তাপমাত্রা বেশি হলে ওই কর্মীকে কিছু ঔষুধসহ দুদিনের ছুটি দিয়ে বাসায় থাকতে বলা হয়। দুদিনে তার তাপমাত্রা না কমলে তাকে কোম্পানির নির্দিষ্ট কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পাঠানো হয়। করোনা উপসর্গ দেখা দিলেই আমরা তাদেরকে কোয়রেন্টাইন সেন্টারে পাঠিয়েছি। এভাবে ১৩’শ ৫৭ জন কর্মীর জন্য মোট ৯টি সেন্টার খুলতে হয়েছে।
জানা যায়, ৯টি কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে প্রতিদিন রান্না করা খাবার এবং পানি সরবরাহ করেছে। সবাই যাতে পর্যাপ্ত গরম পানি খেতে পারে এবং গরগরা করার কাজে ব্যবহার করতে পারে সে জন্য ১৪’শ ফ্লাস্ক দেয়া হয়েছে। আদা, লেবু, এলাচি, দারুচিনি সরবরাহ করা হয়েছে প্রত্যেকটি সেন্টারে। প্রতিদিন কোম্পানির ৬জন ডাক্তার এবং কয়েকজন নার্স রোগীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন।
এবিএম সামছুদ্দিন বলেন, কোয়ারেন্টাইন সেন্টারগুলো চালাতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। বিশেষ করে স্থানীয় লোকজনের বিরোধিতার কারনে আমরা কারখানার কাছাকাছি সেন্টার ভাড়া নিতে পারিনি। এছাড়া সেন্টারগুলোতে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র পাঠাতে কর্মকর্তাদের বেগ পেতে হয়েছে।
তিনি বলেন, এত কর্মী যাতে একসাথে কারখানায় প্রবেশ করতে না হয় সেজন্য পুরুষ এবং নারীদের আলাদা সময়ে ( আধাঘণ্টা আগে ও পরে) প্রবেশ করতে দেয়া হয়েছে। ছুটির সময়ও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। প্রতিদিন সকালে কর্মীরা যখন প্রবেশ করে তখন সবার শরীরের তাপমাত্রা নেয়া হয়। এছাড়া দুপুরে এবং বিকেলে সবার আরো দুই দফা তাপমাত্রা নেয়া হয়। কারো শরীরের তাপমাত্রা বেশি হলে তাকে দুদিনের ছুটি দিয়েছি আমরা। পরে তাপমাত্রা স্বাভাবিক হলে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের কাজে যোগদান করতে দেই। করোনা থেকে সুস্থ রাখার জন্য কারখানায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিপুল হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরী করা হয়েছে।
১৩’শ ৫৭ জন কর্মী কোয়ারেন্টাইনে থাকার কারণে তারা একদিনের বেতন থেকেও বঞ্চিত হয়নি বলে জানিয়েছেন কোম্পানির নির্বাহীরা। এমনকি তাদেরকে হাজিরা বোনাসসহ পুরো বোনাস দেয়া হয়েছে। অথচ অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের ৬০ শতাংশ বেতন দিয়েছে।
কোম্পানির চেয়ারম্যান বলেন, কর্মীদের যত্ন নেয়ার কারণে কারখানার অন্য কর্মীদের মাঝে কাজের স্পৃহা বেড়েছে।
হান্নান গ্রুপ মূলত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নামকরা ক্রেতাদের কাছে পোশাক বিক্রি করে। কোম্পানির বার্ষিক টার্নওভার ৮০ মিলিয়ন ডলারের বেশি।