মহামারীর চেয়েও ভয়ংকর রূপ ধারণ করা করোনা ভাইরাস চীন থেকে ছড়িয়ে পড়লেও এশিয়ার কয়েকটি দেশ দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে অনেকটাই নিরাপদে থাকতে পেরেছে। কিন্তু কিভাবে?
চীনের খুব নিকটবর্তী হয়েও করোনার ভয়াবহতা থেকে বেঁচে গেছে তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, হংকং। দক্ষিণ কোরিয়ায় ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লেও দ্রুত পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশের মানুষকে ভয়াবহ ভাইরাসের থাবা থেকে বাঁচিয়েছে দেশটি।
পশ্চিমা দেশে করোনা ভাইরাস সবচেয়ে বেশি আঘাত করছে এখন। কেননা, প্রথমে তারা সেভাবে একে গুরুত্ব দেয়নি। চীনের ভাইরাস বলেই আলসেমি করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠিকই ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমা বিশ্বে।
খুব দ্রুত না হলেও দেশগুলো স্কুল-কলেজ লকডাউনসহ কঠোর কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তারা কি এশিয়ার দেশগুলো থেকে কোনো শিক্ষা নিতে পারে?
সিঙ্গাপুর, হংকং, তাইওয়ানের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে করোনা মোকাবেলায় পশ্চিমা দেশগুলো এশিয়ার কাছ থেকে কোন ধরনের শিক্ষা নিতে পারতো বা শিক্ষা নিতে পারে, সে বিষয়ে বিবিসি একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
প্রথম শিক্ষা: ভাইরাসকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এই বিষয়টাকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা একমত যে, শুরু থেকেই গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। সন্দেহভাজনদের ব্যাপকভাবে পরীক্ষা, আক্রান্তদের পৃথকীকরণ, সামাজিক দূরত্বকে উৎসাহিত করতে হবে শুরু থেকেই। যেমন: চীনে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার তিন দিনের মধ্যেই সিঙ্গাপুর, হংকং, তাইওয়ান নিজেদের প্রত্যেকেটি সীমান্তে করোনা স্ক্যানিং শুরু করে দেয়। বিমানের প্রত্যেক যাত্রীকে তারা পরীক্ষা করেছে প্রথম থেকেই।
এই বিষয়গুলো পশ্চিমা বিশ্বে এখন করা হচ্ছে। তবে প্রথম দিকে ঢিলেমি করা হয়েছে। ‘যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুযোগ হারিয়েছে‘- বলছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাক্তন গবেষণা বিষয়ক পরিচালক টিক্কি পানগেষ্ট।
তিনি বলছেন, ‘চীনে ভাইরাস ছড়ানোর দুই মাস পর করোনার প্রকোপ শুরু হয়েছে এসব দেশে। তারা ধারণা করেছিল, চীন অনেক দূরে এবং তেমন কিছুই হবে না।’
দ্বিতীয় শিক্ষা: ব্যাপক সাশ্রয়ী পরীক্ষা
ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাউথ কোরিয়ার মতো দ্রুত পরীক্ষা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তা সাশ্রয়ী পরীক্ষা হবে। দেশটি ২ লাখ ৯০ হাজার মানুষকে দ্রুত পরীক্ষা করানোর কারণে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে পেরেছে। তারা দিনে ১০ হাজার মানুষকে পরীক্ষা করেছে। ব্যাপক আকারে পরীক্ষা করার কোনো বিকল্প নেই। দেশটি যে দৃষ্টান্ত রেখেছে, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোরিয়ার এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছে।
তৃতীয় শিক্ষা: শনাক্তকরণ ও বিচ্ছিন্ন করে রাখা
প্রথমে করোনা শনাক্ত করতে হবে। তবে লক্ষণ দেখা দিলে শুধু পরীক্ষাই সমাধান নয়, সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে দ্রুত বিচ্ছিন্ন করে রাখতে হবে। কঠোরভাবে এটি পালন করতে হবে।
সিঙ্গাপুর, হংকং, তাইওয়ান এই কাজটি বেশ ভালোভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে। হোম কোয়ারেন্টাইন অনেকে মানতে চান না সাধারণত। সিঙ্গাপুর এই বিষয়টি ডিজিটাল ডিভাইস পদ্ধতি দিয়ে তদারকি করেছে এবং তাদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করেছে।
চতুর্থ শিক্ষা: প্রথম থেকেই সামাজিক দূরত্ব তৈরি
সামাজিক দূরত্বকে মহামারী থেকে বাঁচার মোক্ষম প্রতিষেধক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব তৈরি দ্রুত করা না গেলে মানুষের দেহ থেকে দেহে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে এবং সমগ্র দেশে বিস্তার লাভ করবে। ইতালি, স্পেন এই কাজটি করতে ব্যর্থ হওয়ায় এতো ভয়াবহ মৃত্যুর সংখ্যা গুণতে হচ্ছে আজ।
জনসমাবেশ, সামাজিক, রাজনীতি সমস্ত অনুষ্ঠান, অফিস, আদালত, গণপরিবহন, শপিংমল, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় মার্কেট লকডাউন করে এই কাজটি বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। সিঙ্গাপুর শুরু থেকেই তা করেছে। শ্রমিকদের বাড়িতে বসেই কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছে দেশটি।
পঞ্চম শিক্ষা: জনসাধারণকে সঠিক তথ্য দিয়ে পাশে রাখা
জনসাধারণের সহযোগিতা ছাড়া এতো বড় দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া নিদারুণ কঠিন। কর্তৃপক্ষকে মহামারীর কথা স্বীকার করে জনগণের মাঝে সঠিক তথ্য সরবরাহ করতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে গেলে তা থেকে বাঁচার উপায় থাকবে না।
ষষ্ঠ শিক্ষা: ব্যক্তিগতভাবে সচেতন মনোভাব
সাধারণত এশিয়ার দেশগুলোতে সরকারের নির্দেশনা বেশি মান্য করে থাকে জনগণ। হংকংয়ে দীর্ঘ দিন ধরে জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে। এরপরও তারা করোনা ভাইরাসের সময় সরকারি নির্দেশনা মেনে নিজেদের আলাদা করে রাখছে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করছে। এটি জনগণের নৈতিক দায়িত্ব যে, মহামারীতে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করে আসন্ন বিপদ থেকে জাতি ও দেশকে নিরাপদে রাখতে সহযোগিতা করা।