হয়তো আবারো দেখা হবে। হয়তো নয়। এটাই এখন সবচেয়ে সহজ সত্য। লুকানোর কিছু নাই। কিছু বাস্তবতা মেনে নেয়াই ভালো। করোনা ভাইরাস এমন এক অদৃশ্য শত্রু-যাকে দেখা যায় না। তাই এই যুদ্ধ বড্ড ভয়ঙ্কর। জানা নাই রণকৌশল। এ যেনো ঘরের ভেতর লুকিয়ে থাকা কালো বেড়ালের মতো। আছে কোথাও, কিন্তু তাকে পাওয়া দুষ্কর।
ব্যস্ত পৃথিবীর রাস্তাগুলো আজ ফাঁকা পড়ে আছে। থমকে গেছে পুরো পৃথিবী। রাস্তাগুলোর দিকে তাকালে খুব অদ্ভুত লাগে। স্তব্ধ সড়কগুলো যেন অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার কথা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। যেখানে প্রিয়জন হারানোর ভয় জেঁকে বসেছে আমদের অন্তরে। কিছু মানুষ তাকিয়ে আছে শুধু দু’বেলা খাবারের আশায়। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে আজ হাজারও মানুষ। শুধু সরকার, ডাক্তার, নার্স, সাংবাদিক নয়; অনেক সাধারণ জনগণ এই যুদ্ধের রণক্ষেত্রে।
তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই, যারা এই পরিস্থিতিতে ত্রাণ দিয়ে সহযোগিতা করছেন। তবে ত্রাণ দেয়ার সময় দয়া করে যাদের সহযোগিতা করছেন তাদের ছবি প্রচার করবেন না। এতে অনেকের আত্মসম্মান বোধে লাগতে আঘাত লাগতে পারে। পরিস্থিতির ফেরে অনেকে আজ নিরুপায় হয়ে আমার, আপনার কাছে সাহায্যের জন্য রাস্তায় নেমেছে। তাই বলে তার সামাজিক অবস্থানের কথা ভুলে গেলে চলবে না। যারা ত্রাণ দিচ্ছেন আপনারা নিজেদের ছবি প্রকাশ করুন। আপনাদের দেখে আরো অনেকে হয়তো সহযোগিতার অনুপ্রেরণা পাবে।
এই আন্তর্জাতিক সংকট কবে দূর হবে? আমরা কেউই জানি না। সকাল থেকে রাত অবধি একটাই সংবাদ- মৃত্যু। প্রতিটি দিন সারাবিশ্ব এই অদৃশ্য শত্রুকে মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিজেদের রণকৌশল পরিবর্তন করছেন। যুদ্ধরত সুপার হিরোরা প্রতিটি ক্ষণ নতুন কৌশল যুক্ত করছেন । তারপরও ফলাফল একটাই- মৃত্যু। কোনোভাবেই এই লাশের সংখ্যা কমছে না। অসহ্য এক অনুভূতি মনের শক্তিকে হ্রাস করছে প্রতিনিয়ত। শেষ অবধি পারবো তো আমরা মানুষ জাতি টিকে থাকতে? একটাই প্রশ্ন। যার উত্তর নাই কারো কাছে। উন্নত, অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ সবাই আজ হিমশিম খাচ্ছে এই করোনা ঠেকাতে।
যোগাযোগের প্রতিটি অধ্যায় আজ করোনা ভাইরাসের আলোচনায় ব্যস্ত। ঘুমাতে যাবার আগে সবার মনে একটাই জিজ্ঞাসা আগামীকাল আমি থাকবো তো ? কিংবা কে এই পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছেন? করোনা ভাইরাস তো নিজেকে নিয়ে ভাবা শিখিয়ে ফেলেছে। আমরা তো সত্যিই শুধু নিজের জন্য ভাবতে চাইতাম। অনেককে বলতে শুনেছি ‘বিচ্ছিন্নতা জীবনের অংশ।’ তাই করোনা ভাইরাস জানান দিলো, ‘এতো যখন একা নিজের মতো থাকার মনোবাসনা, তবে তাই হোক।’ শুরু হয়ে গেলো প্রকৃতির তাণ্ডব। করোনা একটি উপলক্ষ্য বা নাম মাত্র। আর আমাদের হতে হলো বিচ্ছিন্ন।
এখন আর আয়নায় নিজেকে ছাড়া কাউকে দেখা হয় না। আয়নার ধুলোর সাথে নিজেদের ধুলোগুলোও পরিষ্কার করার লম্বা সময় পাওয়া গেলো। ভালোই তো হলো- তাই না বলুন? কেউ আর কাউকে বিরক্ত করার সুযোগ পাবে না। ভাগাভাগি করার প্রয়োজন হবে না। আমারটা আমার থাকলো, আপনারটা আপনার। আমরাই তো এমন বিচ্ছিন্ন জীবন চেয়েছিলাম। ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ ব্যবস্থা ভেঙ্গে শুরু হলো ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ ব্যবস্থা। এমন ব্যবস্থা আমাদের চাওয়ারই ফলাফল, প্রকৃতি সহযোগিতা করছে মাত্র।
এবারে সংক্ষেপে সারাবিশ্বের মানুষের যোগাযোগ প্রক্রিয়া কি অবস্থায় আছে তা নিয়ে বলছি। সারাবিশ্বজুড়ে মানুষের ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাত্রা বেড়ে গেছে। কেননা এখন আমরা নিজের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সময় কাটাচ্ছি। কথা বলছি নিজের ভাবনার সঙ্গে। আবার আন্ত:ব্যক্তিক যোগাযোগও বেড়েছে বৈকি! দলীয় যোগাযোগও সমান তালে তার জায়গা দখল করেছে। হয়তো দুজন কিম্বা পাঁচজন একসাথে মুখোমুখি বা পাশাপাশি বসার সুযোগ হচ্ছে না। কিন্তু ডিজিটাল ব্যবস্থা আমাদের সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে আমাদের কাছাকাছি আনায় সফল। নেই শুধু চায়ের কাপে ঝড় আর সেলফি তোলার আনন্দটুকুন! আর সবই তো ঠিক মতো চলছে।
এদিকে যোগাযোগের অন্যতম গণযোগাযোগ প্রক্রিয়াও বসে নেই। গণমানুষের সঙ্গে প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমের সহযোগিতায় সারাবিশ্বের মানুষ আজ যুক্ত। ঘরে বসেই আমরা সব তাজা খবর পেয়ে যাচ্ছি। চব্বিশ ঘণ্টা করোনা সংবাদ প্রধান সংবাদ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘ফেইসবুক’ এর প্রভাবের কথা না বললেই নয়। মূলধারার সংবাদ আমরা ফেইসবুকে পেয়ে যাচ্ছি খুব দ্রুত। সংবাদ বা গুজব কারা ছড়াচ্ছে এই বিতর্কে যাবো না। তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা আরো যোগ্য ব্যক্তিরা রয়েছেন।
এখন যুদ্ধের সময়। সংকটকালীন সময়। এখন সকল হিসাব নিকাষ মিলাবার সময় নয়। আমাদের হয়তো এই অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে আরো কিছুদিন যুদ্ধ করতে হবে। কতো দিন, না কতো মাস জানা নাই। এখন অপেক্ষা মাত্র। বিশ্বের সবাই নিরাপদে ফিরে আসুক নিজ পরিবারে। প্রত্যাশায় আছি, আবারো সবার সামাজিক দূরত্ব দূর হবে। তবে এই মুহূর্তে আমরা জীবনের অনেকগুলো নিয়ম এর মুখোমুখি হয়েছি। আশা করি করোনা যুদ্ধ শেষ হবার পর যেন এই নিয়মগুলো পালনে খামখেয়ালি না করি।
শেষ করার আগে গোপাল ভাঁড়ের একটি গল্প বলছি। একবার গোপাল ভাঁড়ের খুব পেটে ব্যথা শুরু হলো। ব্যথার যন্ত্রণায় গোপাল ভাঁড় ঘরে শুয়ে শুয়ে দেবি মাকে বলছিলো, ‘মা এবারের মতো আমার পেটে ব্যথা দূর করে দাও। আমি তোমার মন্দিরে, তোমার চরণে কবুতর, দই, নারকেল, চন্দন আরো অনেক কিছু দিয়ে পুজো দেবো। এরপর কিছুদিন পর গোপাল ভাঁড় সুস্থ হয়ে উঠলেন। এবং তিনি দেবী মাকে দেয়া কথা দিব্ব্যি ভুলে গেলেন। মন্দিরের সামনে দিয়ে আসা যাওয়া করেন বটে। কিন্তু দেবী মায়ের চরণে চন্দনের ফোঁটা দিতে ভুলে যান।
একদিন হলো কি গোপাল ভাঁড়ের আবারো পেটে ব্যথা শুরু হলো।ব্যথায় কুঁকড়াতে কুঁকড়াতে গোপাল ভাঁড় দেবি মাকে বললেন, ‘মা গতবার পেটের ব্যথায় আমি তোমাকে পুজো দেবার কথা দিয়ে ছিলাম। কিন্তু সেই কথা রাখিনি। এবার দিবো। তুমি এবারের মতো আমার ব্যথা সারিয়ে দাও। ও মা তুমি এতো কিছু বোঝো, রসিকতা বোঝো না।’
আমরাও আজ এই দুর্যোগকালীন সময়ে নিজ, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকে অনেক কথা দিয়ে ফেলছি। আশা করি সংকট কেটে গেলে আমরা সেই প্রতিজ্ঞাগুলো ভুলে যাবো না। কেননা প্রকৃতি যে কতো নিষ্ঠুর হতে পারে নিশ্চয় করোনা ভাইরাস আমাদের সেই বোধ তৈরী করতে সক্ষম।ফেইসবুকে ক্ষমা না চেয়ে একটি ফোন বা ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে জানান-ভুল হয়েছে, ক্ষমা চাই। সকল ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ঘরে প্রার্থনায় ক্ষমা চান। বেঁচে থাকলে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডায় গিয়ে আবারো হাজারো মানুষ একসাথে প্রার্থনা করা যাবে। কিন্তু এখন ঘরে থাকুন। ধর্মের বাহানায়ও বাইরে যাবেন না। নিশ্চয় বুঝতে পারছেন- প্রকৃতি রসিকতা বোঝে না। প্রমাণ কিন্তু দৃশ্যমান।
এদিকে জনগণ যখন অবাধ্য হয়ে ঘরের বাইরে যাবেন নীতিতে অটল, তখন সরকার একটু শক্ত হাতে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ নীতিকে অনঢ়।এক্ষেত্রে জনগণ আপনারা আপনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। আর যারা বাইরে নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করছেন তাদের সহযোগিতা করুন। সরকার এবং আইন রক্ষাকারী বাহিনী আপনারা যারা আমাদের জনগণের জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাইরে আছেন, আপনাদের ধন্যবাদ। এবং অনুরোধ করতে চাই যারা এখনো কিছু অফিস যেমন, ব্যাংক, মেডিকেল সেন্টার, ফার্মেসী, বাজারে যারা যাচ্ছেন তাদের যাতায়াতে সহযোগিতা করুন। এই যুদ্ধ আমাদের সবার। তাই একসাথে যুদ্ধ করতে হবে। দয়া করে প্রতিপক্ষ ভাববেন না পরস্পরকে।
সবশেষে এতটুকুন বলবো এখন শুধুই প্রতীক্ষা। করোনা যুদ্ধ একদিন থামবেই। পৃথিবী আবার শান্ত হবে। আবারো আমরা ডিজিটাল মাধ্যমের যোগাযোগ ছেড়ে পাশাপাশি, মুখোমুখি বসবো। তখন আমাদের পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মিলিয়ে নেবো। নচিকেতার গানের কথাগুলো এই করোনা যুদ্ধের সংকটকালীন সময়ে সত্যিই বাস্তব মনে হচ্ছে–
একদিন ঝড় থেমে যাবে,
পৃথিবী আবার শান্ত হবে।
বসতি আবার উঠবে গড়ে,
আকাশ আলোয় উঠবে ভরে,
জীর্ন মতবাদ সব ইতিহাস হবে – পৃথিবী আবার শান্ত হবে।
আজ অশান্ত দিন,
বেঁচে থাকা আশা ক্ষীণ,
তবু পথ চাওয়া অবিরাম।
ধুসর আকাশ আজ,
কাল নেবে বধু-সাজ
এই বিশ্বাসেই সংগ্রাম।
একঘেয়ে একটানা অভ্যেসে তাই,
গান গেয়ে স্বপ্ন বেঁচে যায়,
প্রশ্নেরা তবু সুধোয়,
“কবে?”
পৃথিবী আবার শান্ত হবে।।
দু’চোখ আষাঢ় হায়!
খরা আজ চেতনায়,
প্রত্যাশা ফানুসে বদলায়।
ভাষা আর সেতু নয়,
ভাষা আজ অন্তরায়,
কাব্যেরা কাঁদে যন্ত্রণায়।
এই শরশয্যায় আজ অর্জুন
নেভাতে এসে তৃষার আগুন,
বহু প্রানে যদি মিশে যায় – তবে –
পৃথিবী আবার শান্ত হবে।
একদিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)