করোনা ভাইরাস বদলে দিয়েছে মানুষের চিন্তা ভাবনাকে। বিগত বছর থেকেই বারবার লকডাউনের ঘর বন্দি সময় শিখিয়েছে পৃথিবীতে মানুষ এককভাবে ক্ষমতাধর নয়। তাই মুক্ত আকাশে প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নিতে না পারার যন্ত্রণাটা বড় তাড়া করছে নিজেকে। ২০২০ সালের শুরু থেকেই জীবনটা থমকে গেছে ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের কারনে। মানুষের সব দম্ভ, অহমিকা, প্রভাব প্রতিপত্তি এক নিমিষে তুচ্ছ হয়ে গেছে নোবেল করোনা ভাইরাস নামের এ অদৃশ্য শক্তির কাছে। সারা পৃথিবীকে ঘর বন্দি করে দিয়েছে এ ভাইরাস। চীনের উহান শহর থেকে সৃষ্ট ভাইরাস মানুষকে অনেক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক হিসাবে এ ভাইরাস মানব সৃষ্ট নাকি প্রকৃতি থেকে সে অন্য এক বিতর্ক। কিন্তু মানুষের অত্যাচারে জর্জরিত প্রাকৃতিক পরিবেশে ও জনজীবনের পরিবর্তন দেখে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়।
গত বছরের লকডাউনের সময় প্রকৃতি তার আপন রূপে ফিরে যে শিক্ষা দিয়েছে তা আগামী দিনের পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে এমনটাই আশা ছিল সকলের। কিন্তু তা হয়নি। বরং করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বেপরোয়া হয়েছে মানুষ। বলা হয়ে থাকে প্রকৃতি তার নিয়মের অনিয়মকে সহ্য করে না। তাই প্রকৃতির বিচারের কাছে মানুষ বড় অসহায়। যার প্রমান কোভিড-১৯।
করোনা ভাইরাসের শুরুতে সারা পৃথিবী একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। আর সে বিচ্ছিন্নতা মানুষকে যে বাস্তবতার সম্মুখীন করেছে তার অন্যতম একটি হলো – ‘পারস্পরিক সম্পর্ক’। মানুষের ছুটে চলা জীবনে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কগুলো অনেক বেশি যান্ত্রিক ও আলগা হয়ে গেছে আজকাল । বিশেষ করে পরিবারিক সম্পর্ক। চাওয়া পাওয়র বাইরে যে আত্মিক একটা জীবন আছে তা ভুলেই গেছে মানুষ।
করোনা ভয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে একটা অন্য রকম অনুভূতি এসেছে প্রায় সবার পরিবার। বাইরের জগতের ব্যস্ততার আড়ালে হারিয়ে যাও আবেগ, ভালোবাসা, বেদনা সব যেন নিজেকে চিনিয়ে দিয়েছে নতুন করে। নারীদের সংসার জীবনে কোভিড-১৯ কাজের চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। গৃহকর্মী ছাড়া সাংসারিক কাজ কেউ কেউ একা সামলিয়েছে । আবার কেউ কেউ সহযোগিতা পেয়েছে স্বামী, সন্তান বা পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে। হাউস ওয়াইফদের কি এমন কাজ- এ কথাটা বদলে দিয়েছে কোভিড ১৯। কারণ অফিসের কাজের চেয়ে ঘরের কাজ কোন অংশে কম নয় তা বুঝতে পেরেছে স্বামীরা।
ঘর সংসারের বাইরে একান্তভাবে নিজেকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে কখনো মনের আকাশে বিষন্নতা মেঘ এসে জমেছে। আবার কখনো মনে হয়েছে যদি বেঁচে থাকি জীবনের ভুলগুলো শুধরে হাসবো প্রাণ ভরে। চারদিকে করোনার আতংক এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করেছে সকলের মাঝে। ঘর বাহির সামলানো নারী জীবনে অনিশ্চয়তার শংকা তাড়া করছে এখন অবধি। সব কিছু ছাপিয়ে কেবল মনে হয়েছে, সবাইকে আগলে রাখতে রাখতে এই যে আমিকে হারিয়ে ফেলেছি; সে কথা কি কেউ মনে রেখেছে? নারী তার সম্মানটুকু পায় না বলে এ মহামারীর কালেও নির্যাতিত হচ্ছে। পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে অনেক নারীর অত্যাচারিত হবার খবর এসেছে গণমাধ্যমে। ঘর বন্দি জীবনে নিজেকে খুঁজতে গিয়ে মনে হয়েছে সময়ের ব্যবধানে কন্যা জায়া জননী হয়ে বেঁচে আছি কেবল। সেখানে সেই আমিটা নেই, যে আমি হবার স্বপ্ন দেখতাম।
একজন নারী সবার আগে একজন মানুষ। অথচ আধুনিক সমাজেও নারীর প্রতি মানসিকতা বদল হয়নি। পরিবার সমাজ যে কোন কাজে সবার আগে দোষী করে নারীকে। বিয়ে না টিকলে স্ত্রীর দোষ। কারণ নারীর একমাত্র দায় স্বামী ও তার পরিবারের মন যুগিয়ে চলা। সন্তান বিপথে গেলে মায়ের দোষ। কারণ মা সন্তানের দেখ ভাল করতে পারেনি। এমনিভাবে এ সমাজ হাজারো খুঁত ধরে নারীর।
জীবনযুদ্ধে পোড় খাওয়া নারীদের লড়াইকে সম্মান দেয়ার বদলে অপবাদটাই বেশি জুটে। অথচ তাদের চলার পথের যন্ত্রনাগুলো হয় একান্ত তার। করোনা ভাইরাসের কালে জীবনের ডায়রিটা যেন আপনাআপনি চোখের সামনে ভেসে উঠে। ঘরবন্দি কর্মহীন সময়ে আগামী দিনের দুঃশ্চিন্তার সাথে অতীতের মিল খুঁজে পায়। ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তিটা সব সময় এক হয় না। হয়তো সে কারনে আবেগ প্রশ্রয় পেয়ে প্রশ্ন করে নিজেকে। লড়াই করা চলা জীবনে করোনা ভাইরাস চেয়েও ভয়ংকর মনে হয় অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে। একজন নারী স্বাবলম্বী হতে গিয়ে পুরুষের চেয়ে কম সংগ্রাম করে না। তাই তার কাছে করোনা ভাইরাসের এ মহামারী আর দশজনের মতই চিন্তনীয় বিষয়। কারণ নারীর দায়িত্ববোধ, সামাজিক অবস্থান ও বাস্তবতার হিসাবকে তছনছ করে দিচ্ছে করোনা ভাইরাস।
প্রতিদিন মৃত্যু আর রোগে আক্রান্ত হবার খবর শুনতে শুনতে দমবন্ধ করা পরিবেশে হয় লকডাউনকালে। ভার্চুয়াল জগতে সবাই সবার কাছে থাকে। তবু্ও নিত্যদিনের চেনা শহর চেনা মানুষ আর ছুটে চলা জগতটাকে আবার ফিরে পাওয়ার আকুলতাতে কাটে রাত দিন। একটাই আরাধনা সকলের, ‘এ মহামারী থেকে মুক্তি।’
করোনা ভাইরাস পৃথিবীকে বদলে দিবে এ চিন্তাটা তাত্ত্বিক। দুঃখজনক হল, প্রকৃতি থেকে মানুষ শিক্ষা নিতে পারেনি বলে বদলে যেতে পারছে না। মানবিকতাকে ধারণ করতে পারেনি বলে অনিয়ম আর দুর্নীতি হয়েছে বা হচ্ছে এ করোনাকালে। তাই
সমাজ আর পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে প্রতিনিয়ত আহত হচ্ছে মানুষ। এতটা বৈরী পরিবেশ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে অনুধাবন করছে একটা সত্য। বোধ করি সে সত্যটা সবার জন্য এক৷ নারী বা পুরুষ নয় বরং একজন মানুষ হিসাবে ‘আমি কিংবা আপনি অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সবকালেই একা। সেখানে নিজের একাকীত্ব দিয়েই বুঝতে হয় নিজেকে। খুঁজে নিতে হয় জীবনের আপন সত্ত্বা ও বাঁচার কারণ।’