কোভিড-১৯ জাতীয় করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি ও বিস্তার নিয়ে নানামুখী বিতর্ক রয়েছে। মূলত সারা বিশ্বে মহামারী সৃষ্টিকারী এই করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) ২০০২-২০০৩ সনে চীন, হংকং ও তাইওয়ানে বিস্তার লাভকারী মারণব্যাধি সার্স-এর জ্ঞাতি ভাই। ঐ সময়টাতে সার্স, বার্ডফ্লু, সোয়াইনফ্লু ইতাদির বিস্তার নিয়ে বিশ্ববাসী যখন উৎকন্ঠিত ঠিক সেই সময়টাতে ব্যক্তিগতভাবে আমি এইচআইভি এপিডেমিয়োলজি এবং ঐ রোগের প্রতিষেধক নিয়ে গবেষণায় লিপ্ত।
ঐ গবেষণার বিষয়টি যখন National Institute of Allergy and Infectious Diseases (NIAID) কে জানাই তখন ড. অ্যানথনি ফাউসি তাদের এইডস ডিভিশনের শীর্ষ কর্মকর্তা ড. জোনাথন ক্যাগানকে নির্দেশ দেন আমার গবেষণা রিভিউয়ের জন্য।
ঐ গবেষণায় (Reference: AIDS Preventive Drug, July 2002, NIAID, USA) ভাইরাস বিস্তার প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ও অ্যানথ্রাকুইনের মত ওষুধের ব্যবহারের কথা বলা হয়। এ সময় ইম্যুউনরেসপন্স বেগবান করার জন্য জিঙ্ক ও সেলেনিয়াম প্রয়োগের কথা বলা হয়। এই ওষুধগুলো সার্স ভাইরাস ও হারপেস ভাইরাস প্রতিরোধে কিছুটা কার্যকর ছিল।
এই গবেষণায় স্পষ্ট হয় যে, পরিবেশের উপর আঘাতের কারণে কার্বন ডাই-অক্সাইডের আধিক্য ও মহাজাগতিক রশ্মির নেতিবাচক প্রভাবে জুনোটিক ভাইরাস এইচআইভি বিবর্তিত হয়ে মানব দেহে আশ্রয় নেয়। এটা হয়েছিল আফ্রিকার মাটিতে।
এই সব গবেষণার আলোকে করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি ও বিবর্তন বিশ্লেষণ করা গেছে। প্রায় ৬ লক্ষ বছর পূর্বে যে ভাইরাসটি কখনও উষ্ণ কখনও শীতল পৃথিবী ও বরফের সাথে মিলেমিশে ছিল তা কি করে পরিবেশের বিবর্তনের সাথে সাথে অক্সিজেনের অভাব ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের আধিক্যের মাঝে সূর্যহীন দিনগুলোতে মাইক্রোরেডিয়েশনের কারণে বিবর্তিত হয়ে সার্স, মার্স ও পরিশেষে কোভিড-১৯-এ বিবর্তিত হল তা পর্দার অন্তরালে রয়ে গেছে।
এইচআইভি সংক্রান্ত গবেষণার (Reference: Basic Questions on AIDS & Field Level Research, Dr. M A Hasan, ISBN-984-32-3562-2) আলোকে এটাই ছিল কোভিড-১৯ এর বিবর্তন বিষয়ক হাইপোথিসিস। এ ভাবেই উহানের মৎস ও জীবজন্তুর আড়তে করোনা নামক আরএনএ ভাইরাস আপন চেহারা ছেড়ে কোভিড-১৯-এ বিবর্তিত হয়।
মনে রাখা প্রয়োজন এইচআইভি ভাইরাসের মত এটি একটি জুনোটিক ভাইরাস যা কিনা জীবজন্তুু থেকে বিবর্তিত হয়ে মানুষের শরীরে এসেছে এবং আক্রান্তের কোষে লক্ষ লক্ষ ছায়া ভাইরাস তৈরি করেছে যা কিনা আকৃতি, চেহারা, গড় ওজন এবং প্রকৃতিতে একেবারে মূল ভাইরাসের মত। এই ভাইরাস আক্রান্তের ফুসফুস ও ফুসফুসের পর্দায় ভয়াবহ প্রদাহ সৃষ্টি করে তা অকার্যকর করে তুলে।
স্বাভাবিকভাবে ৮৫ ভাগ আক্রান্ত রোগী বিনা চিকিৎসায় ভাল হলেও ৫ ভাগ ভয়াবহ পরিনতির দিকে এগিয়ে যায়। আক্রান্তদের মধ্যে যারা বুড়ো, যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, যারা অ্যাজমা, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে ভুগছে তাদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশী হলেও ক্ষেত্রবিশেষে এটি তরুণ, স্বাস্থ্যবান এমন কি ১৩ বছরের বালককেও রেহাই দেয়নি। এটা প্রমাণিত হয়েছে যুক্তরাজ্যে।
এই ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট নিউমোনিয়া প্রতিরোধে জিঙ্কের ভূমিকা থাকলেও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের ভুমিকা কতটুকু নিরাপদ তা ভাববার বিষয়। ২০০২-২০০৩ এইচআইভি ভাইরাস প্রতিরোধে আমি ২০০ মি. গ্রাম হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ২বার করে ব্যবহার করতে বলেছিলাম।
দীর্ঘ মেয়াদে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বিবেচনা করে দৈনিক ১০০ মি. গ্রাম ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। এটা ভাইরাসের বৃদ্ধি অর্থাৎ রিপ্লিকেশন এবং টার্গেট ফিক্সেশন প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে আক্রান্তের শরীরে লক্ষ্যস্থল কমিয়ে আনে। এটা প্রদাহও কমায়।
৬০-৭০ ভাগ অ্যালকহল, ক্লোরিন, আয়োডিনের মত হ্যালোজেন যেভাবে এই ভাইরাস বিনাশ করে তেমন করে কোন খাবার ওষুধ দিয়ে এটি মেরে ফেলা যাবেনা বা এটাকে শতভাগ ঠেকিয়ে রাখা যাবেনা।
এই ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট এন্টিবডি যেমন অনেককে সারিয়ে তুলতে পারে তেমনি এই ভাইরাসের অংশ বিশেষ অর্থাৎ প্রোটিন অনুবিরোধী ভ্যাকসিন একে প্রতিরোধ করতে পারে। এ মুহূর্তে কিছু ইতিবাচক কাজ করা প্রয়োজন তা হল- মাস্ক ও পিপিই-এর মত সুরক্ষা এবং সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণ করা। সামাজিক দূরত্ব ১ মিটার নয়, ১.৫ – ২ মিটার হওয়া উচিত। এটা নতুন আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে আনবে; চিকিৎসা সহজ করে তুলবে। আমার মতে, এটাই এ মুহূর্তে সেরা প্রতিরোধ।
মনে রাখা প্রয়োজন যে, ২৫-৩০ ভাগ উপসর্গবিহীন আক্রান্ত নিরন্তর করোনা ভাইরাস ছড়াচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে ব্যাপক টেস্টের উদ্যোগ নিতে হবে এবং তা এখনই। এটাই আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখবে।
করোনা ভ্যাকসিন কবে আমাদের হাতে আসবে এবং তা একজনকে কতদিন সুরক্ষা দিবে সেটাও ভাববার বিষয়। আপাতত সামাজিক দূরত্বের সাথে সাথে ভাইরাসবিরোধী কেমিক্যালস ও রেডিয়েশন প্রধান অবলম্বন হতে পারে। সেই সাথে ফ্যাভিপিরাভির-এর মত ভাইরাসনাশক ওষুধ এবং উপরোক্ত চিকিৎসা আমাদের জন্য ভরসা। রোগের ব্যাপকতা পরীক্ষা এবং এর বিস্তার প্রতিরোধ করা আমাদের আশু লক্ষ্য।
নতুন করে আরো ভয়াবহ ভাইরাস যেন ছড়িয়ে না পড়ে তার জন্য দৃষ্টি ফেরাতে হবে কার্বন নিঃসরণসহ বৈশ্বিক দূষণ প্রতিরোধ ও ব্যাপক বনায়নের দিকে। এটা না হলে মানুষের বিনাশ অনিবার্য। স্বাস্থ্য ও শান্তিকে জীবনের সকল লক্ষ্য ও উন্নয়নের সূচক হিসাবে দেখতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)