বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে অনিশ্চয়তা আর আলোচনা চলছে। গঠনের মাত্র এক বছরের মাথায় সংগঠনটির শীর্ষ নেতৃত্ব বড় ধরনের সমালোচনার মুখে পড়েছেন। এই সমালোচনা থেকে ক্ষোভ খোদ প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত গড়িয়েছে। আলোচনা হয়েছে মন্ত্রিসভায়ও। প্রধানমন্ত্রী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ওপর বিরক্ত হয়ে কমিটি ভেঙে দেওয়ার কথাও বলেছেন বলে গণমাধ্যমের খবর।
যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শুরুতেই জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে কমিটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তবে কমিটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি। ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যে আছে স্বীকার-অস্বীকারের দুই কথা। আলোচনা হয়েছে জানিয়েছেন তিনি। আবার বলছেন কমিটি ভেঙে দেওয়ার কথা হয়নি। পরবর্তীতে অবশ্য আওয়ামী লীগের এই সাধারণ সম্পাদক বলছেন, কমিটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনার।
রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনা করছে বলে ছাত্রলীগ ‘সরকারের’ ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন নয়। সরকারের এমন কোন সংগঠন থাকার কথাও নয়। তাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে এইধরনের আলোচনা অপ্রত্যাশিত এবং অনুচিত। মন্ত্রিসভার বৈঠক সরকার পরিচালনার বৈঠক, রাষ্ট্রীয় কার্যাদি সম্পাদন এবং এ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনার বৈঠক। ওখানে কোন ছাত্র সংগঠনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করা উচিত নয়। বাস্তবতা হলো- সেটাই হচ্ছে। রাজনৈতিক দল ও সরকারের মধ্যকার সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলো বিলোপ, অস্বীকার কিংবা অমনোযোগিতার কারণেই সেটা হচ্ছে। এই বিষয়টি খেয়াল রাখা দরকার সরকারকে।
মন্ত্রিসভা যেখানে ছাত্রলীগ নিয়ে আলোচনার কথা হচ্ছে, সেখানকার সকলেই কি ছাত্রলীগ হয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে মন্ত্রিসভার অংশ নেওয়া লোকজন? সেখানকার সকলের কি দীর্ঘ ও উজ্জ্বল রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড আছে? সেখানকার সকলের কি ছাত্রলীগ কিংবা আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, সাংগঠনিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার, মতামত দেওয়ার ‘যোগ্যতা’ রয়েছে? হ্যাঁ, শব্দটা ‘যোগ্যতা’ সম্পর্কিতই; কারণ ওখানে থাকা অনেকের ছাত্রলীগের রাজনীতি করার গৌরবোজ্জ্বল অভিজ্ঞতা নেই, ওখানকার অনেকই ছাত্রলীগ সম্পর্কে মতামত দেওয়ার কোনও পর্যায়ের কর্তৃপক্ষ নন। ওখানে ‘সাংগঠনিক প্রধান’ হিসেবে শেখ হাসিনাই ছাত্রলীগ নিয়ে বলতে পারেন, মতামত ও সিদ্ধান্ত দিতে পারেন; আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওবায়দুল কাদের হয়ত বলতে পারেন, তবে সেটা কতখানি যৌক্তিক সে আলোচনারও দাবি রাখে। এর বাইরের বাকি সবাই তৃতীয় পক্ষ। এই তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে ছাত্রলীগ নিয়ে আলোচনা যৌক্তিকতার নিরিখে কতখানি যৌক্তিক সেটাও প্রশ্ন।
ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক রাজনীতি নিয়ে বিতর্ক মূলত সংগঠনটির নীতিনির্ধারণীতে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সংগঠনটির নেতৃত্ব নির্ধারণের ক্ষমতা ছিল নেতাকর্মীদের, কিন্তু সেটা এখন আর হচ্ছে না। কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন হচ্ছে না। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক যেখানে ‘নির্বাচিত’ হওয়ার কথা সেখানে এখন নেতা ‘নিয়োগ’ দেওয়া হচ্ছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন যেখানে ছিল গঠনতান্ত্রিক সেখানে ভর করে প্রশাসক নিয়োগের মত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিয়োগ। কাউন্সিলররা সংগঠনের নেতা নির্বাচন করতে না পারার কারণে সংগঠনটির মধ্যে গণতান্ত্রিক আবহ বিলুপ্ত প্রায়। এই নিয়োগদান প্রকারান্তরে চাকরির মত, ‘অদৃশ্য মালিকপক্ষ’ কর্তৃক স্বনির্ধারণী যোগ্যতা নিরূপণ শেষে নিয়োগ। যা যেকোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের জন্যে অপ্রত্যাশিত।
ছাত্রলীগের ‘সাংগঠনিক প্রধান’ বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও ২০০৯ সালের এপ্রিলে ছাত্রলীগের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের কারণে বিরক্ত হয়ে তিনি ওই পদ থেকে সরে গিয়েছিলেন। নিজেকে ওই পদ থেকে মৌখিক বক্তব্যে সরিয়ে নিলেও কাগজে কলমে এবং বাস্তবে তিনি দায়িত্বেই আছেন। যার প্রমাণ ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি গঠনে তার হস্তক্ষেপ এবং সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে নিজের বিরক্তি প্রকাশসহ কমিটি ভেঙে দেওয়ার আলোচনা।
শেখ হাসিনা তার সরকারি পরিচয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ছাত্রলীগের ‘সাংগঠনিক প্রধান’ নন, তার এই দায়িত্ব কিংবা পদগ্রহণ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা হিসেবে। আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের সদস্যদের কাছে তিনি যেমন প্রধানমন্ত্রী পরিচয়ে পরিচিত নন, তেমনি সরকারি পরিচয়, রাজনৈতিক পরিচয়সহ তার নানা পরিচয় আছে; এই পরিচয়ের কারণে জায়গাভেদে তার দায়িত্বের মধ্যেও ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক। তার সরকার রাজনৈতিক সরকার- সন্দেহ নাই। প্রধানমন্ত্রিত্বের সরকারি পরিচয়ে তিনি সকল দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সকলের, কিন্তু আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে তিনি আওয়ামী লীগেরই। এখানে দুই পরিচয়কে একীভূত করার সুযোগ নাই। দেশে তিনি সরকারি কর্মসূচিতে সরকারেরই প্রতিনিধিত্ব করেন, দেশের বাইরে বৈশ্বিক কোন কিছুতে তিনি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন, তার ওই প্রতিনিধিত্ব আওয়ামী লীগ প্রধান হিসেবে নয়। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে একাধিক পরিচয় থাকলে জায়গা ভেদে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বা আলোচনা করাই সঙ্গত। মন্ত্রিসভা ছাত্রলীগের কমিটি ও শীর্ষ নেতাদের নিয়ে কথা বলার উপযুক্ত জায়গা নয়, ওখানে কথা বলা যায় তখন, যখন এই কমিটি বা শীর্ষ নেতাদের নিয়ে সরকারের করণীয় কিছু থাকে। এখানে সরকারের করার কিছুই নেই, মন্ত্রিসভার সদস্যদেরও করার কিছু নেই, ওখানে উপস্থিত আমলাদের করার কিছু থাকার কথাও না।
যাইহোক, ছাত্রলীগের এই কমিটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গঠন করে দেওয়া কমিটি। ২০১৮ সালের মে মাসে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে কমিটি গঠনে ব্যর্থ হন কাউন্সিলররা। এরপর শেখ হাসিনা নিজেই কমিটি গঠনের দায়িত্ব নিয়ে সম্মেলনের আড়াই মাস পর কমিটি গঠন করে দেন। ওই সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক নির্ধারিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নামের ঘোষণা দেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এরপর এ বছরের ১৩ মে ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটির ঘোষণা দেন সভাপতি রেজওয়ানুর রহমান চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী।
কয়েকটি সিন্ডিকেটের কাছে বন্দি ছাত্রলীগ- এমনই আলোচনার সময়ে সিন্ডিকেটের বাইরে চলমান কমিটি করেছিলেন শেখ হাসিনা। কমিটি করতে সংগঠনটির ‘সাংগঠনিক প্রধান’ বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য নিয়ে তবেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন। কিন্তু সেই কমিটি গঠনের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এবার নাখোশ স্বয়ং শেখ হাসিনাই।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই অপছন্দ কিংবা ক্ষোভের জের ধরে এখন ছাত্রলীগ দোদুল্যমান অবস্থায়। কমিটি ভাঙার সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনার- এমন সংবাদ আসার পর থেকে সংগঠনটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মিডিয়া ট্রায়াল এবং ফেসবুক ট্রায়ালের মুখে। বিভিন্ন মিডিয়ায় নানামুখী বক্তব্য আসছে। এতে করে একদিকে ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি যেমন ক্ষুণ্ণ হচ্ছে তেমনি সংগঠনটির দুই নেতাও হচ্ছেন আরও বিতর্কিত। এই অবস্থা চলতে থাকলে তাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
শোভন-রাব্বানীর এই কমিটি ভেঙে দেওয়া হবে, নাকি এই কমিটির বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ-ভুলগুলোর সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হবে, এনিয়ে কেউ কিছু বলতে পারছে না। পুরো বিষয়টি শেখ হাসিনার হাতে বলে সুনির্দিষ্টভাবে কেউ কিছু জানে না। এতে করে গুজব-আলোচনা ডালপালা মেলছে। যে যার মত গল্প লিখছে, গল্প বলছে। এতে করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ভবিষ্যৎ রাজনীতিও হুমকির মুখে পড়ছে।
ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি ভেঙে দেওয়া হবে, নাকি নেতাদের ‘ভুল’ সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হবে- এনিয়ে সুস্পষ্ট কিংবা শর্তসাপেক্ষ সিদ্ধান্ত আসলে সংগঠনটি ও এর শীর্ষ নেতারা নানামুখী ও বিচিত্র সমালোচনার কবল থেকে মুক্ত হতে পারবে বলে মনে হচ্ছে। তাদেরকে ঝুলিয়ে রাখা স্রেফ দুই নেতাকে শাস্তি দেওয়াই নয়, এর মাধ্যমে দেশের হাজার-হাজার ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও সংগঠনকেও শাস্তি দেওয়া হয়ে যায়। কমিটি নিয়ে সিদ্ধান্ত তাই যত দ্রুত আসবে দুই নেতা ও সংগঠনের জন্যে ততই মঙ্গল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)