৫ মে যায়, নিউজফিড ভরিয়ে দিয়ে যায় ২০১৩’র কানে ধরে বসে থাকা হেফাজত কর্মীদের ছবিতে।
প্রায় দেড় বছর হল আমার ভাই মরেছে, তাদেরই কারো হাতে হয়তো। তবুও আমি বলছি, ২০১৩’র ৬ মের সকালটা আমার শুরু হয়েছিল কিছু শিশুর নিষ্পাপ মুখ মনে করে।
যারা দু টুকরো গরুর গোস্ত আর ভাতের আশায় দূর দুরান্ত থেকে কিছু ভুল পথিকের পিছু পিছু চলে এসেছিল মতিঝিল।
আমি মা, সন্তান হারানোর ব্যাথা বোঝার ক্ষমতা আমাকে সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন। সেজন্যই তাৎক্ষনিক ভাবে যে শিশুদের সেসময়ে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, তাদের মা বাবার মুখ বারবার আমার সামনে ভেসে উঠছিল। ইচ্ছে করছিল দৌড়ে মতিঝিল যেয়ে বাচ্চাগুলোকে আঁচলে ঢেকে নিয়ে আসি।
পরের দিনটা কেটেছে নানান দুশ্চিন্তায়–
* পথ হাড়িয়ে যদি ওরা বাড়ি ফিরতে না পারে।
* যারা বলছে যে অনেক শিশু মারা গেছে তারা নিজেরাই যদি কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য ওদের মারে?
* পথে এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে, খিদে পেলে খাবে কি ওরা?
* হুজুর দেখলেই পুলিশের ধরাধরি বেড়েছে, ওদের আবার ধরবে না তো?
আমি যাদের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করেছি তারা দু দলে বিভক্ত। এক দল বলল: “এরা বড় হয়ে এক একটা জঙ্গি হবে, এদের জন্য মায়া কান্না থামান।” আরেক দল বলল- “আল্লাহ্র পথে শহীদ হইছে, আমীন বলেন, কাইন্দেন না।”
আমি দু পক্ষের দিকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম!! হায়রে মানবজন্ম !! কত আস্তিক কত নাস্তিক, মানুষের দেখা নাই?
এক বছর পনের দিন আগে আমার ভাইটাকে সেই ভুল পথের পথিকেরা মেরে ফেলল। ওয়াশিকুরের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই। তাতে কিছু এসে যায় না, সে নিশ্চিত ভাবেই আমার ভাই। ওর মৃত্যুর পর পত্রিকাওয়ালারা আর কাউকে খুঁজে না পেয়ে আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছিল- “কেমন ভাই আপনার? আপন ভাই? বলুন কেমন?”
আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। আমার শরীরে শক্তি ছিল না। ফিসফিস করে বললাম- ভাই, ও আমার ভাই।
ওয়াশিকুর বলত, “দিদি, তোমারে মা ডাকতে ইচ্ছে করে। তুমি আমার কতকালের আপন।” মরে যাবার পনের দিন আগে থেকে আমাকে একবার দেখার জন্য সে পাগল হয়ে গেল, আমি ব্যস্ত তাই বারবার দিন পিছাই। তিন দিন আগে বলল- “ভর্তা দিয়ে ভাত খাব দিদি। কতদিন ঠিক মত খাই না।”
আমি তাকে ভাত বেড়ে খাওয়াতে পারিনি।
হেফাজত ইসলামের বাচ্চাগুলোকে দেখে কেন যেন আমার মন বলত, ওদের মাথার ওপর যদি একটা স্নেহের হাত, আর্থিক সচ্ছলতা থাকতো তবে ওরা আজ অন্য কোথাও থাকতো।
তোমরা কেউ বিশ্বাস কর কি না জানি না, ওয়াশিকুরের বেলাতেও আমার সে একই জিনিস মনে হয়।
ওয়াশিকুর মারা যাবার ১৫/২০ দিন আগে ওর অফিস এলাকায় কারা যেন জঙ্গি সন্দেহে একজনকে পিটিয়েছে, ও শুনেই আমাকে ফোন করে কথা বলল। খুব রাগ, বিরক্ত সে। আমায় বলল- “পিটিয়ে কেন মারছে দিদি বলত? এটা কোন সমাধান? এভাবে কিছু হবে বল?”
অভিজিৎ দা মারা যাবার পর প্রথম ফোন পাই ওর কাছ থেকেই। অস্থির হয়ে ছিল। বারবার এক কথা বলছিল, “আরেকজন অভিজিৎ আর হবে নারে দিদি।”
আমার কষ্টটা অন্য জায়গায় ছিল, বোকা মেয়ে মানুষ আমি, বলছিলাম- “কেউ কেন ধরা পড়ল না বলতো? এটা খুব খারাপ হলো।”
বাবু উড়িয়ে দিল আমার কথা। ধরা পড়া নিয়ে সে চিন্তিত না। বলে- “কি হবে ধরে দিদি? যারা বিশ্বাস করে ‘বাঁচলে গাজী, মরলে শহীদ’ তাদের ধরে লাভ নেই। এভাবে হবে না দিদি। দেশ থেকে দারিদ্রতা দূর করতে হবে, ওদের সাধারণ শিক্ষার আলোয় আনতে হবে। সুন্দর জীবন দিতে হবে।”
আমার ওয়াশিকুর মায়ের আদর জানে না, স্নেহ জানে না, পেট ভরে আরামের ভাত জানে না। সে তোমাদের সকল আস্তিক নাস্তিক আনন্দযজ্ঞের থেকে কত দূরে দাড়িয়ে একা একা সৃষ্টিকর্তার সাথে কত কথা বলেছিল তোমরা জানলে না। কেন কেউ একবার বুঝল না ওর সকল কথা একজনকে উদ্দেশ্য করে!!!!
কোন শক্ত মায়ার বাঁধন তো নয়, পৃথিবীর সাথে একটা নরম সুতো দিয়ে বাঁধা ছিল আমার ভাইয়ের প্রাণটা। সে সুতোটা কাটতে পাঁচ পাঁচটে কোপ?
আমাকে আজ অনেক নাস্তিকেরা গালি দেবে, বলবে- একজন সাক্ষাত নাস্তিককে আপনি বিশ্বাসী প্রমাণ করতে চাইছেন? ছিঃ ছিঃ!
আমাকে আজ আস্তিকেরাও গালি দেবে, বলবে- একজন নাস্তিক মুরতাদকে তুই ভালো মানুষ, সৃষ্টিকর্তার কাছের মানুষ বলে প্রমাণ করতে চাইছিস?
বিলাসি আস্তিক আর বিলাসি নাস্তিকদের থেকে আমার আজ আর কিছু শেখার নেই।
তোমরা যারা আমার ভাইকে মারলে আমি তাদের স্নেহ করি। আমার মন বলে, আমার ভাই আমাকে বলেছে যে, তোমাদের স্নেহের অভাব, আলোর অভাব।
তোমরা যাদের মারছ, যারা তোমাদের মারছে তারা কত কাছাকাছি অবস্থানেই না দাড়িয়ে!!
একদিন ভোর হবে এই দেশে। গরম ভাতের সাথে চকচকে ইলিশের টুকরো আমি তুলে দেবো তোমাদের পাতে। কোন ক্ষুধার্ত পথিক এসে আমার বাড়ির আঙ্গিনায় বলবে না- “আল্লাহ কি নাই, দেখে না আমার ক্ষুধা।”
একদিন ভোর হবেই। সমৃদ্ধির পথে হেঁটে যাবো আমরা। কোন ক্ষুধার্ত পথিক আর বেহেশ্তি ফলের আশায় সারাটা জীবন পেটে পাথর বেধে আমার ভাইকে মেরে ফেলবে না।
আমি জানি, একদিন ভোর হবে। হবেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)