টেস্ট ক্রিকেটের লোকগাথা হয়ে যাওয়া ব্রায়ান লারার অপরাজিত ৪০০ রানের রেকর্ডটা কি ভেঙে যাবে? যাকে দেখে কথা, তিনি তখন বিধ্বংসী। চোখধাঁধানো কাভার ড্রাইভ, নিখুঁত টাইমিংয়ে কাট, গোলার মতো পুল ছিটকে বেরিয়ে আসছে ব্যাট থেকে। যেন অ্যাডিলেড ওভালে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে ঘনঘন। এমন সাবলীল অথচ ভয়ঙ্কর তাণ্ডব চালাচ্ছেন যিনি, তিনি কোথায় থামবেন, তা নিয়ে তো আলোচনা চলবেই। লারা কি ওই সময় টেনশনে পড়ে গিয়েছিলেন খুনে মেজাজের ডেভিড ওয়ার্নারকে দেখে?
গোলাপি টেস্টের ইতিহাস খুব একটা লম্বা নয়। সবে শুরু হয়েছে দিন-রাতের ক্রিকেট। তার মধ্যে গোলাপি বলেই বিস্ফোরক ট্রিপল সেঞ্চুরি করে বসেছেন ওয়ার্নার। ২০১৬ সালে গোলাপি টেস্টে প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছিলেন পাকিস্তানের আজহার আলি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। তারপর ওয়ার্নারের ব্যাটে এল দ্বিতীয় ট্রিপল। বাঁহাতি ওপেনার থেকে যান ৩৩৫ রানে অপরাজিত। ডন ব্র্যাডম্যানের ৩৩৪ রানের রেকর্ডটা ভাঙার পরই ইনিংস ঘোষণা করে দেন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক টিম পেইন।
ডেভিড ওয়ার্নারকে কেন ব্রায়ান লারার গড়া টেস্টে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটি তাড়া করতে দেয়া হল না, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে তীব্র বিতর্ক। কাঠগড়ায় অজি অধিনায়ক পেইন। শেন ওয়ার্ন, ব্রেট লি, সাইমন ক্যাটিচদের মতো সাবেকরা সরাসরি পেইনকে অভিযুক্ত করে বলেছেন, ইনিংস ঘোষণা করার জন্য এত তাড়াহুড়ো না করলেও পারতেন।
বিতর্কে মূলত তিনটি কারণ তুলে ধরা হচ্ছে। এক- ওয়ার্নার দারুণ ফর্মে ব্যাট করছিলেন। দুই- সবে অ্যাডিলেড টেস্টের দ্বিতীয়দিন। তিন- পাকিস্তানের মতো ‘দুর্বল দল’ (বিশেষ করে ব্যাটিংয়ে) পেয়েও কেন সুযোগ নিতে দেয়া হল না ওয়ার্নারকে?
ব্রেট লি সোজাসুজি বলেছেন, ‘এমনকিছু বৃষ্টি পড়ছিল না, যার জন্য এত তাড়াহুড়ো করতে হল! বিশ্বরেকর্ড করার এমন সুযোগ পেয়েও ওয়ার্নারকে করতে দেয়া হল না। এমন একটা ইনিংস খেলার জন্য মানুষ বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করে।’
কমেন্ট্রি বক্সে আরও একধাপ এগিয়ে শেন ওয়ার্ন বলেছেন, ‘বিশ্ব ক্রিকেটে এ মুহূর্তে কেউ যদি ৭-৮ ওভারে ৬০ রান তোলার ক্ষমতা রাখে, সে একমাত্র ওয়ার্নার। অস্ট্রেলিয়ার হঠাৎ ইনিংস ঘোষণা আমাকে অবাক করে দিয়েছিল। যে ছন্দে ওয়ার্নার ব্যাট করছিল, মনে হচ্ছিল রেকর্ডটা করেই ফেলবে। কিন্তু দলের কথা ভেবে ইনিংস ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। তারপরও বলব, ওয়ার্নারকে রেকর্ড তাড়া করতে দেখলে খুশি হতাম।’
টিম পেইন একমাত্র পাশে পাচ্ছেন সাবেক অধিনায়ক মার্ক টেলরকে। তিনিও ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড ছুঁয়েছিলেন। কিন্তু ক্রিকেটের অন্যতম সেরা নায়কের প্রতি সম্মান জানিয়ে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন ইনিংস। সেই টেলর বলেছেন, ‘খেলাটা ব্যক্তিগত রেকর্ডের নয়। খেলাটা জেতা, হারার। ওয়ার্নারের ব্যাটিং দেখতে ভালো লাগছিল। আগ্রাসী মনোভাব ফুটিয়ে তুলেছিল।’
সাইমন ক্যাটিচ অবশ্য সমালোচনাই করেছেন পেইনের, ‘ওয়ার্নারের সামনে তখন শুধু লারাই ছিল। যেভাবে দ্রুত রান তুলছিল ওয়ার্নার, তাতে কিন্তু লারার রেকর্ডটা ভেঙেও দিতে পারত। হয়তো পরের দশটা ওভারের মধ্যেই ঘটে যেত সেটা।’
যার ইনিংস নিয়ে এতো আলোচনা বা বিতর্ক, সেই ওয়ার্নার বিষয়টাকে দেখছেন অন্যভাবে। বলেছেন, ‘আমি মোটেও ভাবি না (এটি একটি সুযোগ হাতছাড়া হয়েছিল)। আমরা সত্যিই কালকের (শনিবার) ঘিরে থাকা আবহাওয়ার দিকে নজর দিয়েছি। আমরা নিজেদের অনেকবেশি সময় দিতে চেয়েছিলাম। আগামীকাল (শনিবার) যদি কিছুটা বৃষ্টি হয় এবং বোলাররা যদি বল করতে না পারেন, তবে শেষদিনেই প্রতিপক্ষের ১৪ উইকেট তুলে নিতে হবে বোলারদের। রেকর্ড অর্জন করার কথা আমাদের মনে ছিল না। আমাদের নজর ছিল সামনে। এটা ব্যক্তিগত অর্জনের চেয়ে টেস্ট জয়ের পক্ষেই নিজেদের দাঁড় করানো বিষয় ছিল।’
বিতর্ক যা নিয়েই হোক, এই ইনিংসটাকে সেরাই বলছেন ওয়ার্নার। ওয়ার্নারই আপাতত গোলাপি বলে সর্বোচ্চ রানের মালিক। অবশ্য ২২৬ রানের মাথায় প্রথম টেস্ট খেলতে নামা মোহাম্মদ মুসার বলে আউট হয়েছিলেন। সেই ডেলিভারি নো বল হওয়ায় বেঁচে যান। আগের টেস্টেও আরেক অভিষিক্ত নাসিম শাহ’র নো বলে আউট থেকে বেঁচে যাওয়ার পর সেঞ্চুরি করেছিলেন ওয়ার্নার।
দিনের শেষে ওয়ার্নার বলেছেন, ‘নিজের ডিফেন্সটা যথেষ্ট শক্তপোক্ত রেখে খেলছিলাম। এতদিন যা খেলেছি, সেগুলোর থেকে এই ইনিংসটা সেরা। আমার তো মনে হয়, মোহাম্মদ আব্বাসদের মতো কোয়ালিটি বোলিংয়ের বিরুদ্ধে ট্রিপল সেঞ্চুরিটা করেছি।’
চার বছর আগে একটা টুইট করে ওয়ার্নার বলেছিলেন, ‘টেস্টে ট্রিপল সেঞ্চুরি করার মতো ধৈর্য আমার নেই।’ সেই টুইট এখন ভাইরাল হয়ে গেছে। ওয়ার্নার বলেছেন, ‘অপেক্ষা করছিলাম আব্বাসের ওভার পিচ বলগুলোর জন্য। এটা যেমন একটা দিক, আর একটা দিক হল, ধৈর্যশীল হওয়ার চেষ্টা করে গেছি। সেটা যাতে হয়, তার জন্য কঠিন পরিশ্রমও করেছি।’
আগের টেস্টে সেঞ্চুরি করেছিলেন, এই টেস্টে আরও ছাপিয়ে গেলেন। ওয়ার্নারের ব্যাখ্যা, ‘এই দুটো ম্যাচে আমি নিজেকে তুলে ধরেছি। প্রমাণ করেছি আমি কী করতে পারি। যেভাবে নিজের ডিফেন্সটা জমাট রেখেছিলাম, তাতে আমি গর্বিত।’
প্রথম ইনিংসে ওয়ার্নারের অবিস্মরণীয় ট্রিপল সেঞ্চুরির দাপটে অস্ট্রেলিয়া ৩ উইকেটে ৫৮৯ রান তুলে ইনিংস ঘোষণা করে।