বাবা-মাকে খুনের জন্য ঐশী একাই দায়ী নয় বরং গভীরভাবে দেখলে দায়ী তার পরিবার ও সমাজ। বর্তমানে টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে সন্তান ছুটে যাচ্ছে বাবা-মায়ের হাত থেকে। বন্ধনহীন পারিবারিক আবহে সন্তান বিপথে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রণহীন ব্যয়ের ভোগবাদী সমাজে সন্তান হচ্ছে বিপথগামী। নেশার অন্ধকারে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ঘটাচ্ছে ভয়ংকর ঘটনা। পরিবার থেকে বিপুল টাকা না পেলে হয়তো ঐশীর পুরো পরিবার এভাবে ধ্বংস হতো না।
ঐশীর ফাঁসির রায়ের প্রতিক্রিয়ায় চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে এসব কথা তুলে ধরেছেন মোটিভেশনাল স্পিকার ও পরামর্শক ড. মো: আলমাসুর রহমান, নাগরিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান শরিফ।
মোটিভেশনাল স্পিকার ও কাউন্সেলর ড. মো: আলমাসুর রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন,‘ ঐশীকে একা দায়ী করাটা ঠিক হবে না। এজন্য পারিবারিক বন্ধনহীনতা এবং সামাজিক অবক্ষয় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
বর্তমান সময়ে বাবা-মাকে টাকার পেছনে ছুটতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ যাদের জন্য এতো ছোটাছুটি তারাই কিন্তু ছুটে যাচ্ছে বাবা-মায়ের হাত থেকে। সমাজ বাস্তবতায় এখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র এমন একটি মাত্রায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে যেখানে সবার মনোভাব, বিশেষ করে কৈশোর পার করাদের মনোভাব অনেকটা “আমাকে একা থাকতে দাও” ধরণের হয়ে যাচ্ছে।
এখন পরিবার থেকে এই দূরত্ব তৈরি হচ্ছে কৈশোর থেকেই। বিশেষ করে দূরত্ব বাড়ছে বাবার সঙ্গে। টাকা ‘দিচ্ছি, যখন যা চাইছে তা-ই দিচ্ছি’ বাবাদেরও ধারণা অনেকটাই এরকম।
অথচ এই সময়ে প্রতিটি সন্তানের প্রয়োজন বাবা-মায়ের সান্নিধ্য। এখন বাবা-মা বাচ্চাকে কোয়ালিটি টাইম অর্থাৎ একান্তে সময় দিচ্ছেন না। যেহেতু সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের সম্পর্ক গভীর হচ্ছে না সেহেতু বন্ধুবান্ধবের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে তারা। সব কিছু শেয়ার করছে তাদেরই সমবয়সীদের সঙ্গে। আর তখনই খুব সহজে মিস গাইডেড বা বিপথগামী হচ্ছে। মাদকাসক্তদের পাল্লায় পড়ে হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হয়ে ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ঘটাচ্ছে।
তাই বাবা-মায়েদেরকে নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে হবে তারা এতোসব করছেন আসলে কাদের জন্য। তাদের অসাবধানতা,অবহেলায় সন্তানের মধ্যে নৈতিকতাবোধ আসছে না। গড়ে উঠছে না সেলফ-কন্ট্রোল বা আত্মনিয়ন্ত্রণ। এ কারণে সে ‘না’ বলা শিখছে না। দ্রুত অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে প্রিয় সন্তান।
ঐশীর আজকের রায়ে সমাজ দায়মুক্তির তৃপ্তি পেতে পারে না বলেই মনে করেন নাগরিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান শরিফ।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন,‘ কেউ আইনের উর্ধে নয়। মানবিকতার প্রশ্ন থাকতে পারে তবে আইন চলে নিজস্ব পথে। এক সময়ের নিষ্পাপ ঐশীকে ভুলের মাশুল গুণতে হলো আজ।
তবে ঐশী কিন্তু অনেকটাই পরিস্থিতির শিকার। ঐশীর জীবন নেতিবাচক মোড় নিয়েছিলো কৈশোর শেষের দ্বারপ্রান্তে। সে জড়িয়ে পড়ে মাদকাসক্তদের চক্রে। এর দায় ঐশীর একার নয়। দায়ী ওর পরিবার, সমাজব্যবস্থা। বিশৃঙ্খল সমাজ ব্যবস্থায় অসংলগ্ন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলো ঐশী।
মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের যোগান দিয়ে গেছে ওর পরিবার। অথচ নৈতিক দায়িত্ব পালন করেনি ওর পরিবার। আজ ঐশীর শাস্তিতে তৃপ্তি পাচ্ছেন অনেকে বরং এই ঐশীই কিন্তু চোখে আঙুল দিয়েই দেখিয়ে দিলো সমাজের অবক্ষয়। ঐশীতো একা অপরাধ করেনি,অপরাধ ওর পরিবারের এবং ভোগবাদী সমাজের। এই সমাজের এক প্রান্তে স্কুলে যেতে পারছে না এক শিশু আবার অপর প্রান্তে দামী গাড়ি হাকাচ্ছে ধনীর দুলাল-দুলালিরা। বিপুল টাকা না ঢাললে হয়তো ঐশীও বিপথে যেতো না। নিয়ন্ত্রণহীন আয়-ব্যয়ের বিষয়টি সামনে চলে আসছে বারবার। ঐশীর ঘটনা যেনো সমাজকে জাগায়, শিক্ষা দেয়।