চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

এ দেশ আমাদের সবার

এবার আমাদের সব থেকে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান, দূর্গাপুজা আমরা ৫ দিনের জায়গায় ৩ দিনেই শেষ করলাম। বলা যায়, করতে বাধ্য হলাম। এই যে আমরা মানসিক ভাবে মহাঅষ্টমীতেই মায়ের অকাল বোধন করলাম, বিসর্জন দিলাম সঠিক সময়ের আগে, যে কষ্ট, দাগ হৃদয়ে লেগে গেল তা হয়ত কোন কালেও ঘুঁচবে না। এই কষ্টটা রয়েই যাবে, সাথে যোগ হবে আবার আগামী বছর কি আসলেই পুজা করতে পারবো কিনা, এই সন্দেহটাও! অনেক কিছুই ঘটে গেল, দেখলাম, জানলাম ও বুঝলাম।।

এতো কিছুর মাঝেও শান্তি ও ভরসার একটা জায়গা আমরা দেখতে পেলাম। আমাদের এই কঠিন সময়ে ইসলাম ধর্মের যে মানুষগুলো ধর্মের বেড়াজাল ঠেলে আমাদের মানসিকভাবে সাহস, ভালোবাসা, সহানুভূতি যুগিয়েছেন দিনের পর দিন, এখনও আমাদের প্রতি এই অত্যাচার নিয়ে প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্নভাবে আমাদের পক্ষ নিয়ে কলম ধরেছেন, ফোন করে খোঁজ খবর নিয়েছেন। আপনি ও আপনারা হৃদয় নিংড়ানো আশির্বাদ ও ভালোবাসার দাবীদার। আপনারা আমাদের আত্মার ভাই, বন্ধু, একটা ধন্যবাদ আপনাদের অবশ্যই প্রাপ্য। আমি জানি ধন্যবাদ বা আশির্বাদ পাওয়ার আশায় কেউই এসব করেননি। যারা আমাদের সাপোর্ট দিয়েছেন, বা দিচ্ছেন তারা অবশ্যই জানেন ধর্ম হলো সারা পৃথিবীর সকলকে নিয়ে বাঁচার নাম। তারা জানেন ধর্ম হলো অন্যায় না করা, তারা এও জানেন ধর্ম কাউকে হিংসুক হতে শেখায় না। আমার কাছে এই মানুষগুলোই হলো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের একমাত্র ধারক ও রোল মডেল। তাই ধন্যবাদ জানাই আপনাদের।

এবারের এই সহিংসতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে কে বন্ধু, কে শত্রু, কে ভালো চায় আর কে উপরের ভালো মানুষ আর ভেতরে বড্ড কালো। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম বন্ধু তালিকার বহু শিক্ষিত, অনেক দিনের চেনা জানা মানুষগুলো, উন্নত দেশের প্রবাসী বাঙ্গালী বন্ধুদের অদ্ভুত আচরণ। যারা আজীবন একই থালায় খেয়েছে, একই সাথে উৎসব পালন করেছে, যাদের সাথে জীবনের অনেকগুলো দিন কাটানো হয়েছে, তাদের সাম্প্রদায়িক তীর্যক মন্তব্য, ইনিয়ে বিনিয়ে সহিংসতাকে বৈধতা দিতে চাওয়া। যুক্তি দিয়ে এ প্রমাণ করতে চাওয়া যে যা হয়ছে তা ভারতের সংখ্যালঘুদের সাথে ঘটা ঘটনার পরিণাম এগুলো। আবার অনেকেই এটি ভারতের কুট কৌশল বলেও চালিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যা ভাবা দরকার ছিলো তা কিন্তু তারা ভাবে নাই যে- “আমরা সবাই কিন্তু বাংলাদেশী”। শুধু মাত্র এই একটা লাইন ভাবলেই আর কোন সহিংসতার কিন্তু কোন স্থানই হতো না এই দেশে।

১৯৭১ এর পর থেকে বাংলাদেশে আমাদের হিন্দু তথা সংখ্যালঘুদের উপর বিভিন্ন রঙে ঢঙ্গে কম অত্যাচার হয়নি। তার ফলাফল এদেশের সংখ্যালঘু কমার পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই বুঝবেন। আমরা ফুটবলের মতো গুঁতো খেয়ে খেয়ে আজ কেবল মাত্র একটা সংখ্যায় রূপান্তরিত হয়েছি। এখনো এখানে আলোচনা চলে আমরা আদতে কতো পার্সেন্ট। আমরা বাংলাদেশী হতে পারলাম না হয়ে গেলাম বরং পার্সেন্টেজ বা সংখ্যা।

এত বড় একটা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস হয়ে গেল, এতোগুলো মানুষ মারা গেল, এতোগুলো মন্দির ধ্বংস করা হলো, তবুও কেউ কেউ বিষয়টাকে একেবারে মামুলী পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। কেউ বললেন অতো বেশি কিছু হয়নি। এরা এমনিতেও পান থেকে চুন খসলেই মায়া কান্না জুড়ে দেয়, এতো হৈচৈ এর কী আছে? ঐ পাড়ে এমন কতো হয়, এখানে তো তেমন কিছুই নয়। ওখানের সংখ্যালঘুদের তুলনায় এরা এখানে মহা সুখেই আছে। কেউ বললেন এটা ভিন্ন কারো চক্রান্ত, আমরা এমন নই। কেউ আবার এক কাঠি সরেশ, এক মুহুর্তে উড়িয়েই দিলেন কিছুই হয়নি সব বানোয়াট, স্বাভাবিক। যা হয়েছে তা বাড়িয়ে গুজব তৈরি করা হয়েছে, যারা মরেছে তারা স্বাভাবিকভাবেই মরেছে।

এদেশে গুজবের বড্ড কদর। গুজব এখন আর শুধু ভিলেজ পলেটিক্স না, সারা দেশেই দেদার বিকচ্ছে। এখানে সন্দেহ করা হয়, প্রশ্ন তোলা হয়, যা স্পষ্ট, যা সঠিক, যা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার তা নিয়ে, কিন্তু যা গুজব, যা ঘটেনি আদৌ, যা মিথ্যা, তা দেদারসে গিলে খায় এরা। শুধু গিলে খেয়ে মরে গেলে তো ভালো হতো, তা তো মরেই না উলটা এরা বিশৃঙ্খলা দিয়ে সমাজ দূষিত করে।

বাংলাদেশ তো আর এক ধর্মের মানুষের আবাসস্থল না কে বুঝে এ কথা? মুক্তিযুদ্ধে সারা বাংলাদেশে খালি এক ধর্মের মানুষই নিহত হন নাই। ৩০ লক্ষ মানুষের মাঝে হিন্দু মুসলিম আলাদা করবো কী করে? তাদের সবার রক্তের রঙ ও তো আলাদা করা সম্ভব না। এখানে এখন চর্চা হয়, প্রশ্ন তোলা হয়: বীর শ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীর বিক্রম, বীর প্রতিক একজন হিন্দুও তো নাই। আর তাই লজ্জায় আর বলবো না আমার বাবার বড় ভাই একজন মুক্তিযোদ্ধা, আমরা গর্বিত মুক্তিযোদ্ধার পরিবার। যুগ যুগ ধরে সহবস্থান ও ঐতিহ্যগতভাবে সকল ধর্মের মানুষ তাদের নিজস্ব ধর্মকর্ম, উৎসব, রীতিনীতি পালন করে আসছিল। হঠাৎ এমন কী হলো যে আমাদের বিভাজন তৈরি করতে হলো?

পরিশেষে শুধু এইটুকুই বলতে চাই, আদতে ক্ষতিটা কার হলো? বিবেক আছে? থাকলে একবার বিবেককে প্রশ্নটা করেন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)