আইসিসি টি-টুয়েনটি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচ নিয়ে বাংলাদেশে যা হলো এবং হচ্ছে, তা এক কথায় অভাবনীয়। এ এক আশ্চর্য বাংলাদেশকে দেখলাম। খেলা হলো ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে, জিতল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আর বিচিত্র এক আনন্দের ধারা বয়ে গেল পুরো বাংলাদেশে।
খোদ ওয়েস্ট ইন্ডিজেও এতো উল্লাস হয়েছে কি-না সন্দেহ! চলমান দ্বিতীয় দফা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা, অন্তত ৮ জনের মৃত্যুর ঘটনা ছাপিয়ে বাংলাদেশের মধ্য-বিত্তমানস জুড়ে রইল কেবলই ভারতের পরাজয়ে এক তিক্ততাজনিত উল্লাস, সন্তুষ্টি!
প্রথমেই বলা ভালো, ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়টি ছিলো অকল্পনীয়, অসাধারণ। দলটিতে বেশ কিছু প্রতিভাবান খেলোয়ার থাকলেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ছিলেন গেইল। যারা ক্রিকেটের খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন, গেইলের বাইরে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে জেতানোর মত আরো একজন খেলোয়ার আছেন, তার নাম স্যামুয়েলস। তো ভারতের যে টিম স্পিরিট, যে বোলিং-ফিল্ডিং, দর্শক সমর্থন, তাতে ১৯২ রান তাড়া করে জেতা কঠিন। ভরসা গেইল আর স্যামুয়েলস। কিন্তু শুরুতেই এই দুই ‘ভরসা’ বিদায় হয়ে যান। এই দুই জনের বিদায়ের পর কোথাকার কোন সিমন্স-চার্লস-আর রাসেল ভারতের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে জেতাবে-এটা কোন অতি আশাবাদীর ক্ষেত্রেও ভাবা সম্ভব হয়নি। অথচ, সিমন্স-চার্লস-আর রাসেল এক অলৌকিক খেলা উপহার দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে জিতিয়েছে। এমন সুন্দর, উত্তেজনায় ঠাসা ক্রিকেট দর্শকরা বহুদিন মনে রাখবে।
আমি খুশি হয়েছি ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বিজয়ে, অসম্ভব ভালো ক্রিকেট খেলে ভারতের মাটিতে ভারতকে হারানোর গৌরব অর্জন করার জন্য। এই ম্যাচটি আবারো প্রমাণ করলো, ‘বিজয়ী দলের’ সব স্ট্র্যাটেজিই ভালো, প্রশংসিত। যাচ্ছে তাই ফিল্ডিং, গেইল আর স্যামুয়েলসের কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যাটিং, তাদেরকে দিয়ে বল না করানো, এমনকি বিরাট কোহলিকে আউট করতে না পারার ক্ষমাহীন ব্যর্থতাও কোন আলোচনার বিষয় হচ্ছে না।
কারণ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ‘জিতেছে’। যারা জেতে তাদের সবই ভালো। কিন্তু চরম সমালোচনার মুখে পড়েছেন বেচারা ধোনি। কাল তার সব স্ট্র্র্যাটেজিই মাঠে মারা গেছে। বয়ে যাচ্ছে সমালোচনার ঝড়। হাতে উইকেট থাকা সত্ত্বেও কেন ব্যাটসম্যানরা আরো বেশি মারমুখী হয়নি, চার-ছয় মারতে পারেনি। কেন সুরেশ রায়নাকে দিয়ে বল করানো হয়নি। কেন ওভার থাকা সত্ত্বেও অশ্বিনের হাতে বল তুলে না দিয়ে কোলিকে দিয়ে বল করালেন। শুধু গেইলকে নিয়ে গেম-প্ল্যান করা হয়েছে, কেন অন্যদের ব্যাপারে যথাযথ ভাবনা ভাবা হয়নি।
কেন সিমন্স দু-দুবার আউট হলেও নো বল হওয়ার কারণে সেটা বাতিল হলো। রাতে শিশিরের কারণে পিচ্ছিল আউটফিল্ডে বল ধরা কঠিন হতে পারে জেনেও কেন দলকে নিয়ে রাতের বেলা বেশি বিশি প্র্যাকটিস করেনি-এমনি কত কত অভিযোগ ধোনির বিরুদ্ধে। কেন টস জিততে পারেনি-পারলে কেউ কেউ ধোনির বিরুদ্ধে এই অভিযোগও আনে! আসল কথা হলো, এই ম্যাচে ভারত মোটে খারাপ খেলেনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বিশেষ করে সিমন্স একটা অলৌকিক খেলা খেলেছে। আর তাতেই ভারত হেরেছে।
আমাদের দেশের মানুষ যতোটা না ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ে খুশি হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি আপ্লুত ও উচ্ছ্বসিত হয়েছে ভারতের পরাজয়ে! কারণ আমাদের অন্তকরণ জুড়ে ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ। ক্ষোভ-রোষ-ঘৃণা। এই ম্যাচের পর ভারতের বিরুদ্ধে ডান-বাম-উগ্র-উদার এমন ঐক্য অতীতে অন্য কোন ইস্যুতে আর দেখা গেছে বলে মনে হয় না! ভারতের পরাজয়ে বাংলাদেশের মানুষের এতো আনন্দের কারণ কি? ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল হেরেছে বলে? কিন্তু সেই পরাজয়ে সত্যিই কি ভারতের ‘হাত’ ছিলো? যারা ক্রিকেট বোঝেন, তারা সবাই মানবেন, সেদিন বাংলাদেশ হেরেছে নিজেদের আহাম্মকির জন্য, অপরিপক্কতার জন্য। তাহলে ক্রিকেট নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে এতো ক্ষোভের যথার্থ কারণ আদৌ আছে কি?
সানি-তাসকিনদের বোলিং অ্যাকশন নিয়ে আইসিসি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার সঙ্গে ভারতের সংযোগ আছে বা আম্পায়ারদের বিষয়টির সঙ্গে ভারতকে সরাসরি দায়ী করার মতো পর্যাপ্ত প্রমাণ কারও কাছে কি আছে? তাহলে কেন ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের এতো ক্ষোভ? এতো ঘৃণা? বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পেছেনে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পেছনে, ভারতের সমর্থন আর সহযোগিতার কথা আমরা ভুলে যাবো? ক্রিকেটে তো বরং আমাদের কিছুটা ক্ষোভ থাকা উচিত অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। অষ্ট্রেলিয়া আমাদেরকে সরাসরি অবহেলা, উপেক্ষা, অপমান করেছে। নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে আমাদের এখানে দলই পাঠায় নি!
পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কি হয়েছে-সেটা নতুন করে উল্লেখ করার কোনো কারণ নেই। অথচ তাদের পরাজয়ে তো এমন ডান-বাম-উগ্র-উদার ঐক্য দেখা যায় না! বাংলাদেশে বর্তমানের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সমর্থক কয়জন, তা ক্রিকেট সচেতন ব্যক্তি মাত্রই জানেন। তাহলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ে পুরো বাংলাদেশ জুড়ে, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যম জুড়ে এমন বাঁধভাঙ্গা উছ্বাস কেন? কেন ভারতবিরোধী এই মাতম?
ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণে অনেকেই ক্রিকেটে পাকিস্তান কিংবা ইংল্যান্ড হারলে খুশি হন। কিন্তু এ রকম বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস দেখা যায় না। নিজের জয় নয়, বরং অপরের পরাজয়ে অত্যানন্দিত হওয়টা কী স্বাভাবিক? এরকম প্রতিক্রিয়াটা বরং সন্দেহজনক, এমন কি বিপজ্জনক মনে হচ্ছে। আমরা সবক্ষেত্রেই তাহলে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যাচ্ছি?
পুনশ্চ: আমার এক ভারতীয় বন্ধু দলের পরাজয়ে ফেসবুকে হতাশা ব্যক্ত করেছে। আমি তাকে লিখেছি: পরাজয়ে ডরে না বীর! ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই ভারত জিতবে! প্রতিক্রিয়ায় সে লিখেছে: আমরা তো পরাজয় মেনে নিয়েছি, কিন্তু তোমরা তো পরাজয় স্বীকারই কর না!
এই প্রতিক্রিয়ায় আমি প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছি। তাইতো, পরাজয়কে সহজ ভাবে নেবার বা পরাজয় মেনে নেবার শিক্ষা সত্যিই কী আমরা পেয়েছি? আমরা কখনই মনে করি না, যে আমরা হেরেছি। আমরা হারতে পারি। আমরা সব কিছুতে, সব সময় ধরে নিই, আমাদের হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা আমাদের ব্যক্তি জীবনে যেমন প্রয়োজ্য, ক্রিকেট-রাজনীতি সব খানে প্রযোজ্য। ক্রিকেটে আমরা হারি না, আমাদের হারিয়ে দেওয়া হয়। নির্বাচনে হেরে আমরা সূক্ষ্ম কারচুপি কিংবা ভোট ডাকাতির অভিযোগ আনি। চাকুরি না পেলে বলি, ঘুষ দিতে পারলাম না বলে হলো না!
পরাজয়কে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারি না বলেই আমরা এমন হিংস্র, বিদ্বেষপরায়ণ, কুচক্রি, ঝগড়াটে জাতিতে পরিণত হচ্ছি! স্বাভাবিক আনন্দ-উচ্ছ্বাস নয়, বিকৃতিতাড়িত পৌশাচিক উল্লাস আমাদের বোধবুদ্ধিকে অনে ক্ষেত্রেই আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। আমরা পরিণত হচ্ছি সংকীর্ণ মানুষে! খেলাটাকেও পরিণত করছি অন্য খেলায়!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)