সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিতর্ক জন্ম দেয়ার খবর নতুন নয়, তবে তিনি নতুন করে আবারও আলোচনায় এসেছেন। এবারের বিতর্কিত আলোচনার বিষয় তার লেখা বই। ‘এ ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ নামে ৬ শতাধিক পৃষ্ঠার বই লিখে তিনি নতুনভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন।
এস কে সিনহার দাবি: এ বইয়ে তিনি তার বিচারকের জীবন ও অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ: এর স্বাধীনতার সংগ্রাম, বিচার ব্যবস্থা ও রাজনীতিকদের মূল্যবোধের অবক্ষয়, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, বিভিন্ন বিষয়ে তার বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি, পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার, জরুরী অবস্থা এবং ডিজিএফআই কর্তৃক ব্যবসায়ীদের ওপর চাঁদাবাজিসহ নানা বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। এ বর্ণনায় তিনি তার দীর্ঘ বিচারিক জীবনের অভিজ্ঞতা এবং ন্যায় পরায়ণতা থেকে বলার চেষ্টা করেছেন।
এ বইয়ের পুরোটা যেহেতু এখনও পড়া হয়নি তাই বইয়ে তিনি কী লিখেছেন সেটা আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। তবে বইয়ের নাম এবং মুখবন্ধে তিনি যে দাবি করেছেন সেটা নিয়ে কিছু কথা রয়েছে। বইটির মুখবন্ধে তিনি দাবি করেছেন: ‘এ বর্ণনায় আমি আমার দীর্ঘ বিচারিক জীবনের অভিজ্ঞতা এবং ন্যায় পরায়ণতা থেকে বলার চেষ্টা করেছি…।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো- তিনি তার বিচারিক জীবনে কতোটা ন্যায় পরায়ণ ছিলেন?
এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের নিউজে। তার বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনসহ প্রায় শতাধিক অভিযোগ রয়েছে। টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন গ্রুপের পক্ষে রায় দেয়ার খবরও আমরা দেখেছি। তার সন্দেহজনক ও অস্বাভাবিক ব্যাংকিং লেনদেনের তথ্য দেয়া হলেও এসব খবর কতোটা সত্য কিংবা কতোটা মিথ্যা এই বিতর্কও বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মী ও সমর্থকরা তুলেছেন। তাই সেই পুরনো বিতর্কেও যাবো না, যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না।
সাবেক এই প্রধান বিচারপতি স্বীয় পদে থাকাকালীন বিভিন্ন কোম্পানী থেকে রায়ের বিনিময়ে যে টাকা গ্রহণ করতেন তার বাস্তব তথ্য আমি নিজেও জানি। সাংবাদিকতার বাইরেও একাধিক কোম্পানীতে কাজের সুবাদে আমি বিষয়টা জানি। রায়ের বিনিময়ে ব্যাংকিং লেনদেনের বাইরে তিনি স্বয়ং নিজে তার সরকারি বাসভবনে বসে লাগেজ ভর্তি কোটি টাকা গ্রহণ করেছেন। হলফ করে বলতে পারি, এটা তার প্রতি বিরাগভাজন হয়ে মিথ্যা আরোপ করা নয়। বরং এটাই বাস্তব সত্য। আর এ কারণেই বিচার বিভাগ নিয়ে তার ‘পাকিস্তানি স্টাইল বিতর্কের’ শুরু থেকেই তার বিরোধিতা করে আসছি। যে ব্যক্তি নিজে চেয়ে এবং পিএস কে দিয়ে বিভিন্ন কোম্পানী থেকে টাকা নিয়ে তাদের পক্ষে রায় দিতে পারে, তার বিচারিক জীবন কতোটা ন্যায় পরায়ণ তা সহজেই অনুমেয়।
তার স্বপ্নভঙ্গের এ বইকে তিনি নিজের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আত্মজীবনী লেখার অন্যতম ‘ইথিক’ হচ্ছে, অপ্রিয় এবং নিজের বিরুদ্ধে গেলেও সত্যটা আপনাকে লিখতেই হবে। আত্মজীবনীতে কোনো কিছু বিশেষ করে নিজের মন্দ দিকও গোপন করা যাবে না। গোপন করলে তা পাঠকের সঙ্গে প্রতারণা হিসেবে বিবেচিত হয়। অথচ বিচারিক জীবনে চরম দুর্নীতিবাজ এস কে সিনহা বলেছেন, তিনি এ বইতে তার দীর্ঘ বিচারিক জীবনের অভিজ্ঞতা এবং ন্যায় পরায়ণতা থেকে বলার চেষ্টা করেছেন। এখানেও তিনি পাঠকদের সঙ্গে বিশেষ করে তার লেখা বই নিয়ে খুশিতে আত্মহারা হওয়া বিএনপি-জামায়াতসহ এন্টি আওয়ামী লীগারদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।
স্বপ্নভঙ্গের এ বই প্রকাশের পর নিউইয়র্ক ভিত্তিক একটি বাংলা সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাতকার দিয়েছেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। সেখানেও নানা বিষয় তিনি খোলামেলা ভাবে আলোচনা করেছেন। কিন্তু সেখানে তাকে যখন দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলো- তখন তিনি তা এড়িয়ে যান। তবে তিনি ওই অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করতে পারেননি। বরং তিনি বলেন: ষোড়শ সংশোধনীর পর আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি এটা বলতে পারেননি যে, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। কিংবা আমার বিচারিক জীবনে আমি কখনও ঘুষ নেইনি, টাকার বিনিময়ে কোনো রায় দেইনি, অথচ সরকার আমার বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা অভিযোগ এনেছে।’ তিনি এটা বলতে পারবেন না। কারণ তিনি একজন দুর্নীতিবাজ প্রধান বিচারপতি ছিলেন। স্বীয় পদবী ব্যবহার করে অঢেল সম্পদ গড়ে তিনি ‘প্রধান বিচারপতি’র মতো শ্রদ্ধার পদকে কলঙ্কিত করেছেন। এ কারণে তিনি দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করতে পারেননি।
টাকা কামানোর ধান্দা তাকে কতোটা পেয়ে বসেছিল তা ফুটে উঠেছিল সিনিয়র সাংবাদিক স্বদেশ রায়ের কলামে। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন ৭১-এর অন্যতম নৃশংস খুনী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায়ের আগে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সিনহার বৈঠকের বিষয়ে। তিনি লিখেছিলেন: ‘পিতা মুজিব! তোমার কন্যাকে এখানেও ক্রুশে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। তাই যদি না হয়, তাহলে কিভাবে যারা বিচার করছেন সেই বিচারকদের একজনের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের লোকেরা? তারা কোন পথে বিচারকের কাছে ঢোকে, আইএসআই ও উলফা পথে না অন্য পথে? ভিকটিমের পরিবারের লোকদেরকে কি কখনও কোনো বিচারপতি সাক্ষাত দেয়। বিচারকের এথিকসে পড়ে! কেন শেখ হাসিনার সরকারকে কোন কোন বিচারপতির এ মুহূর্তের বিদেশ সফর ঠেকাতে ব্যস্ত হতে হয়। যে সফরের উদ্যোক্তা জামায়াত-বিএনপির অর্গানাইজেশান। কেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী আগে গিয়ে সেখানে অবস্থান নেয়। কী ঘটতে যাচ্ছে সেখানে…’।
এ লেখার জন্য দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ এবং নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়কে এসকে সিনহা নিজের দপ্তরে ডেকে নিয়েছিলেন। সিনহা বাবুর নিজের দপ্তর বলছি এ কারণে স্বদেশ রায় এবং তার সম্পাদককে তলব করা বেঞ্চ ছিল স্বয়ং প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন। যেখানে তিনি নিজে অভিযুক্ত সেখানে তার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ ওই সাংবাদিকদের তলব করে কীভাবে? এটা কোন ইথিকসের আওতায় পড়ে? নাকি সেখানে শত কোটি টাকার স্বপ্ন ভঙ্গ হওয়ায় সিনহা বাবু বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন?
একাত্তরে পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করা ‘পিস কমিটি’র স্বঘোষিত কর্মী এস কে সিনহার আরও একটি স্বপ্ন ছিল। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ছিল তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রাথমিক পর্ব। সে ভেবেছিল বিচারক অপসারণের ক্ষমতা যদি সংসদের হাতে যায় তাহলে তার জুডিশিয়াল ক্যু বাস্তবায়ন হবে না। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা যদিও সমর্থনযোগ্য নয়, তবুও প্রশ্ন হচ্ছে সামরিক শাসকদের মেয়াদকাল যখন প্রশ্নবিদ্ধ তখন তাদের সময়ে করা ফরমান এসকে সিনহার এত প্রিয় ছিল কেন? আর এমনও তো নয় যে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি বা সংসদের হাতে এই প্রথম এসেছিল। বাংলাদেশেই এর আগে এমন বিধান ছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রবর্তন করা হয়।
এছাড়া জুডিশিয়াল ক্যু’র আখড়া পাকিস্তানের প্রতি তার অতি প্রীতির কারণে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনা অনিবার্য ছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শেখ হাসিনার কাছে সে নিজে এভাবে বোল্ড আউট হয়ে যাবে সেটা হয়তো সে কল্পনাই করতে পারেনি। এমনকি বোল্ড আউটের বিষয় বুঝতে পেরে সে তার সমগোত্রীয় পাকিস্তানপ্রেমিক ড. কামালকে দিয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তাকে ‘বাস্টার্ড’ বলেও গালি দেয়ার ব্যবস্থা করেছিল! কিন্তু তাতেও যখন কাজ হয়নি তখন ব্যর্থ প্রেমিক দেবদাসের মতো স্বপ্নভঙ্গের বয়ান দিচ্ছেন বই লিখে। নির্বাচনের আগে সেই ড. কামালদের উৎপাতের সময় প্রকাশিত এ বইয়ে কী উল্লেখ থাকবে তা সহজেই বোঝা যায়।
এছাড়া এস কে সিনহার বই প্রকাশের সময়ের দিকে তাকালে আমরা দু’টি জিনিস দেখতে পাই। প্রথমত, বিএনপি মহাসচিবের যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে বইটি তিনি প্রকাশ করেছেন। সুতরাং মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলের যুক্তরাষ্ট্র সফরের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার আগে তিনি এই বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন, যাতে রোহিঙ্গা ইস্যুসহ নানা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী জোরালো ভূমিকা রাখতে না পারেন। কিন্তু তার এসব অপচেষ্টা হালে পানি পাবে বলে মনে হয় না। সবশেষে বলা যায়, শুধু সুরেন্দ্র কুমার সিনহার এই স্বপ্ন নয়, বরং বাংলাদেশবিরোধী যেকোনো স্বপ্নই এখন মাঠে মারা যাবে। কারণ, সময়টা এখন জন্মশত্রু পাকিস্তানের নয়, সময় এখন বাংলাদেশের।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)