ঈদ, ঈদুল ফিতর এসেই গেল। মাসব্যাপী রোজা রাখা শুরু হয়েছিল ৩ এপ্রিল। তাই যদি ৩০ দিন পাওয়া যায় ঈদ হয়তো ৩ মে তারিখে অনুষ্ঠিত হবে।
কিন্তু এবারের ঈদ-রোজাদার জীবনে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে তা বর্ণনাতীত। শুধু রোজদারদের নয়-সমগ্র দেশবাসী নানা সমস্যায় জর্জরিত-তাদের জীবন অতিষ্ঠ। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত, বিত্তহীন এবং মধ্যবিত্তেরও।
কারণ বাজারে আগুন। এ আগুন জ্বালাতে দৃশ্যত সরকারের ভূমিকাও কম নয়। তারা তেলের দাম বাড়িয়েছে অস্বাভাবিক হারে গ্যাসের (সিলিন্ডার) দামও তাই। বিদ্যুতের দামও বাড়াবেন বলে কর্তাব্যক্তিদের অনেকে মাঝে মাঝে উচ্চারণ করছেন।
চালে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং বিস্তর চাল সরকারের গুদামে মজুদ আছে-সুতরাং মাভৈ। এটা আমাদের খাদ্য ও বাণিজ্যমন্ত্রীদের জোরালো আশ্বাস। ওই আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে ঝোলা হাতে বাজারে গিয়ে ক্রেতারা দেখছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। যিনি ১০কেজি চাল কিনবেন বলে প্রস্তুতি নিয়ে বাজারে এসেছিলেন-দাম শুনার পর তিনি একবার পকেটে হাত দেন-একবার দোকানদারের দিকে তাকান অসহায়ভাবে। মনে মনে হয়তো ভাবেন দুই মন্ত্রীকে যদি এখন কাছে পেতাম-বলতাম, চালের দাম বাড়বে না বলেছিলেন, প্রচুর পরিমাণে মজুদ আছে আপনাদের গুদামে, ধান-চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত- তবে কে জিতে দুইদিনের মধ্যে ৫/৭ টাকা করে চালের দাম বাড়লো কেন? কিন্তু ওঁরা তো হিমশীতল তেল মেখে দিব্যি এসি চালিয়ে আরামে কথাগুলি বলে থাকেন। বাধ্য হয়ে ১০কেজির স্থলে ৫/৭ কেজি চাল নিয়ে বাড়ীতে ফিরে আসেন।
চলছে রমজান মাস। ফল খাওয়া জরুরী। সময় পেরিয়ে গেলেও আম-কাঁঠালের খবর নেই। কলা, বাঙ্গি, তরমুজ, আপেল, মাল্টা সব কিছুর দাম বেড়েছে তিনগুণ।
অপরদিকে মাছ-মাংসের বাজারে তো ঢুকতেই ভয়। শাক, তরিতরকারী, তেল, মসলা-কোন কিছুই তাঁদের পকেটের আওতাধীন নয়। অপরদিকে প্রচন্ড দাবদাহ পুরো তিনমাস যাবত অব্যাহতভাবে চলছে। যেন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্য্যন্ত অগ্নিকান্ড করতে হচ্ছে কিন্তু ধরা কি শুচি হচ্ছে? গরমে রাতের ঘুমও হারাম। সন্ধ্যায় কোন ক্রমে ইফতারি সেরে রাতের ঘুমের প্রতীক্ষা। সারাদিনের রোদে উত্তপ্ত ঘরের দরজা-জানালা খুলে রাখলে কেউ কেউ হয়তো খানিকটা ঘুমাতে পারেন কিন্তু বেশীর ভাগের কপালে ঘুম জোটে না।
গৃহিণীদের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন। রোদের উত্তাপের সাথে উনুনের উত্তাপ মিলে মিশে ইফতারি রান্না নিজে রোজা রেখে যে সীমাহীন কষ্ট তাঁদের সইতে হয় তা অবর্ণনীয়। তবু বাড়ীর সবার জন্যে ইফতারি তৈরী করে সাজিয়ে রেখে নিজে ইফতার ও নামায সেরে ক্লান্তদেহে এলিয়ে পড়লেও সত্ত্বরই উঠতে হয় সবাইকে খেতে দিয়ে নিজেও চারটি খেয়ে ২/১ ঘণ্টার জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে আবার সেহরি রান্না। এই ঘানি নির্বিবাদে তাঁরা টেনে চলেছেন মাসব্যাপী।
দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত এবং অস্বাভাবিক বৃদ্ধি কেন ঘটছে প্রতিটি ঈদে এবং বছরের নানা সময়ে তার নির্ভরযোগ্য জবাব কোনদিনই কোন মহল থেকে পাওয়া যায় না। আছেন বাণিজ্যমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, আমদানী দফতর, ভোক্তা অধিকার ফোরাম, আছে পুলিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন আরও কত কি? কিন্তু বাজারে দোকানে দোকানে ও গুদামে গুদামে বিস্তর পণ্য মজুদ থাকা সত্ত্বেও কেন পণ্যমূল্য এভাবে বাড়বে? এর সমাধানের পথই বা কি?
এবার খেয়াল করিনি। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে রমজান মাস শুরু হওয়ার বেশ কিছু আগে থেকেই ব্যবসায়ীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলতে শুনা গেছে, রমজান মাসে কেউ কোন পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করলে সরকার তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যতবার মন্ত্রীরা এমন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতেন-ততবারই দেখা যেত পণ্যমূল্য অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়ে যেত।
তখন সরকার ব্যবসায়ীদেরকে ডেকে সভা অনুষ্ঠিত করে রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য অবশ্যই না বাড়িয়ে তা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে সীমিত রাখতে হবে নতুবা সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হবেন। অপরদিকে ব্যবসায়ীরা ওই সভায় যাবার আগে একবার মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে সভায় গিয়ে উপস্থিত হতেন আবার ঐ সভায় সরকারি হুঁশিয়ারি মেনে নিয়ে পবিত্র রমজানে মূল্যবৃদ্ধি ঘটাবেন না-এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসে পরদিনই আর এক দফা মূল্যবৃদ্ধি ঘটাতেন। সরকার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতেন মজুতদার-মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে-বলতেন এই অপরাধগুলি যাঁরাই করবেন তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে কোন প্রকার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যেত না। তারা দিব্যি তাদের কাজ করে যেতেন পণ্যমূল্যবৃদ্ধি, মওজুতদারী, মুনাফাখোর নির্বিবাদে অক্ষুন্ন রাখতেন।
এবার জনমতের দিকে তাকিয়ে সরকারকে তো কিছু করতেই হয়। তাঁরা বের করে দিতেন ভ্রাম্যমান আদালত একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে। তিনি পুলিশ বাহিনী নিয়ে বাজারে ঢুকে যারা বাড়তি মূল্যে পণ্য বিক্রি করছেন তাদেরকে জরিমানা করতে শুরু করলেন। দেখা যেত, যে সব দোকানে ভ্রাম্যমান আদালত ঢুকছে তারা বাদে আর সব দোকানদার দোকান বন্ধ করে দূরে অন্য কোথাও গিয়ে অপেক্ষা করতেন। বাধ্য হয়ে ভ্রাম্যমান আদলতকে আর কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ফিরে যেতেন। খানিক পরে যে কে সেই-বন্ধ দোকান পাটগুলি যথারীতি খুলে যেত। ঠিক যেন কানামাছির খেলা।
এই লুকোচুরির খেলা তো আরও বড় অপরাধ। আদালতের বিচারকে সচেতনভাবে এড়ানোর অধিকার কারও নেই। কিন্তু কদাপি দেখা যায়নি ঐসব দোকানগুলিতে সীলগালা করতে বা তাদের মালিকে বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারী করতে। ফলে ভ্রাম্যমান আদালতের উদ্যোগ কার্যত: ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতো।
অপরদিকে মজুতদারী-মুনাফাভোগীর বিরুদ্ধে কঠোর আইন বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও আমার এই সুর্দীঘ জীবনে এই অপরাধে কোন মুনাফাখোর-মজুতদারের বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের গ্রেফতার বা তাদের গুদাম সীলগালা করা বা অপরাধী ব্যবসায়ীদের দ্রুত বিচার ও শান্তি বিধান করতে।
ফলে, সরকারি নিষ্ক্রিয়তার কারণে ওই অসৎ ব্যবসায়ীরা দিন দিন দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে এবং তাতেই কারা ক্ষান্ত না হয়ে নিজেরা সরকারি দলে যোগ দিয়েছে, স্থানীয় এমপি-মন্ত্রী ও ব্যবসায়ীরা মিলে আজ অসংখ্য সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে এবং প্রতিটি পণ্যের বাজার তারা নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। তাই সরকারি হুঁশিয়ারিকে তারা থোড়াই পরোয়া করে।
তাবৎ ভোগান্তি জনগণের কাঁধে বর্তায়। সরকারের উচ্চতম পর্যায় থেকে কঠোর হস্তে এ সকল বে-আইনী ও গণ-বিরোধী সিন্ডিকেট জনগণের স্বার্থে ভেঙ্গে দেওয়া হবে কি?
অত:পর পরিবহন খাত
এই খাতটি সারাটি দেশ জুড়ে যাত্রী পরিবহন করে চলেছে প্রতিদিন-প্রতিরাত। দেশের সকল জেলা-উপজেলা তো বটেই-পরিবহন বা যানবাহন আজ ছড়িয়ে পড়েছে বহুক্ষেত্রেই ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত। বাল্যকালে আমরা এমন দৃশ্য দেখার সুযোগ পাইনি। তখন নৌকা আর ট্রেন ছিল যানবাহনের মধ্যে প্রধান। রুচিৎ-কদাচিত ২/১ টি বাস চলাচল করতো।
বাস চলাচল কম হওয়ার কারণ পাকা রাস্তার অভাব। জেলা পরিষদের কিছু কাঁচা রাস্তাই ছিল বাসগুলির প্রধান অবলম্বন। ফলে আজ বাসে এক ঘণ্টায় যতদূর যাওয়া যায়। তখন সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে অন্তত: তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগতো-আর কাঁচা রাস্তার ধুলায় যাত্রীদের চেহারা সাহেব-মেম সাহেবদের মত হয়ে যেতন। তাই সর্বাধিক যাত্রী পরিবহন ঐ যুগে করতো নৌকা আর তারপরই ট্রেন।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ-এটি আজ বই-কিতাব থেকে বহুকষ্ট করে বের করতে হয় কিন্তু তখন এটাই ছিল বাস্তব।
তখন ইংরেজদের রাজত্ব তারা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে হলেও সারা ভারত জুড়ে বিস্তর রেলপথ তৈরী করেছি-অসংখ্য ট্রেন চলাচল করতো চলাচল করতো পণ্যবাহী ট্রেনও। নৌকা ও ট্রেন উভয়েরই ভাড়া ছিল অনেক কম।
ইংরেজরা চলে যেতে বাধ্য হওয়ার পর ক্ষমতায় বসলো পাকিস্তান জুড়ে মুসলিম লীগ সরকার। তারা বাঙালি বিরোধী। তাই একের পর এক রেল সার্ভিস বন্ধ করে দিতে লাগলো। পরিচর্যাহীন অবস্থায় নদীপথগুলি শুকিয়ে যাওয়ায় নৌ-যান চলাচলও কমে যেতে থাকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও এই অবস্থায় কোন উন্নতি হলো না। তাই চলাচলকারী যাত্রীর বড় জোড় ৫ভাগ রেলপথে যাতায়াত করেন। নদীপথে সর্বোচ্চ দুইভাগ। বাদবাকী ৯৩ ভাগ যাত্রী বাসের উপর নির্ভরশীল। রাস্তাঘাট ও মোটামুটি হয়েছে-তবে যথেষ্ট নয়। পরিবহন মালিকেরা তাই এমন যাত্রী পরিবহনে একচ্ছত্র অধিকারী। ঈদের ১০দিন আগে থেকে ঈদের পরের ১৫দিন ‘টিকিট নাই’ অজুহাতে কালোবাজারি ভাড়া অস্বাভাবিক বৃদ্ধি প্রভৃতির মাধ্যমে যাত্রীদের সংকট বাড়িয়ে তোলে। তদুপরি লক্কর ঝক্কর মার্কা গাড়ি, ছাদে ও ভেতরের অসংখ্য যাত্রী নিয়ে বহু দুর্ঘটনা প্রতিবছর ঘটালেও জনগণের দাবী সত্ত্বেও এর সমাধানে অধিক রাস্তা নির্মাণ, ভাঙাচোরা গাড়ি বন্ধ লাইসেন্স বিহীন চালক বন্ধ করতে উদ্যোগী নন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)