মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি জন্ম নেওয়ার পর বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন তখন কেউ ঘূর্ণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেননি যে মাত্র সাড়ে চার বছরের মধ্যে কী বর্বরোচিত, নৃশংস এবং রক্তাক্ত ইতিহাসের অংশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ! পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা করা হয়। এমনকি বুলেটে ঝাঁঝড়া করে দেওয়া হয় তার শিশুপুত্র শেখ রাসেলকেও। তারপরও খুনীদের রক্তপিপাসা মেটেনি। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়া জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে ওই বছরেরই ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে হত্যা করা হয়। ইতিহাসে এমন হত্যাকাণ্ড নজীরবিহীন। ওই কালরাতে সরাসরি বঙ্গভবন থেকে ফোন করে খুনিদের কারাগারের ভেতরে ঢুকতে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ক্ষমতা দখলকারী খন্দকার মোশতাক আহমেদ। খুনের নির্দেশদাতা এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার চার জাতীয় নেতা– সকলেই বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর ছিলেন। কিন্তু, একজন যখন জাতির জনক হত্যাকাণ্ডের অংশ হয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ক্ষমতাসীন হয়েছেন, অন্য চারজন তখন নেতার প্রতি আনুগত্যের পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এভাবে তারা পাঁচজনই হয়তো ইতিহাসের অংশ। তবে, জাতীয় চার নেতা যেখানে ইতিহাসে গৌরবোজ্বল ভূমিকায় সমাসীন, সেখানে খন্দকার মোশতাক ইতিহাসের আঁস্তাকূড়ে নিক্ষিপ্ত। এমনকি দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধু এবং চার জাতীয় নেতার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকার পরও তাদেরকে হত্যার মতো নৃশংস ঘটনার অংশ হওয়ার মতো চরম অমানবিকতাও দেখিয়েছেন খন্দকার মোশতাক। এখানে অবশ্য ব্যক্তিগত কোন বিষয় ছিল না; যা ছিল তার সবই আদর্শ, রাজনৈতিক আদর্শ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে আদর্শ থেকে বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই একই আদর্শ থেকে বঙ্গবন্ধু কারাবন্দী থাকার সময় চার জাতীয় নেতা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছেন। আর ঠিক তার বিপরীত আদর্শ ধারণ করে ছদ্মবেশী হিসেবে খন্দকার মোশতাকরাও স্বাধীনতাযুদ্ধে শরিক হয়েছিলো ঠিকই, কিন্তু, সবসময়ই তারা পাকিস্তানী ভাবাদর্শে বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে গেছে। চরমতম নৃশংসতা ঘটিয়ে তারা প্রথমে ৭৫’র ১৫ আগস্ট সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে এবং পরে ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেছে। তাদের ধারণা ছিল, এদেশের মানুষের হৃদয় এবং মস্তিষ্ক থেকে বঙ্গবন্ধু এবং তার আদর্শকে মুছে দিয়ে আবারও পাকিস্তানী ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠা করা যাবে। কিন্তু, ইতিহাস সাক্ষী অপআদর্শ কখনও জয়লাভ করতে পারে না। আজ তাই বাংলাদেশের মানুষের মনে আরো বেশি সমুজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু এবং চার জাতীয় নেতা। শোকের এ জেলহত্যা দিবসে আমরা শ্রদ্ধাভরে তাদেরকে স্মরণ করছি। পাশাপাশি আমরা এও মনে করি, খুনিদের শাস্তি হলেও যে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র থেকে জাতির জনক এবং তার চার সহচরকে হত্যা করা হয়েছে সেই ষড়যন্ত্র পুরোপুরি জাতির সামনে উন্মোচিত হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে এজন্য একটি কমিশন গঠন করার আহ্বান জানাই।