আমানত, ঋণ বিতরণ, ব্যবসা, মুনাফা প্রবৃদ্ধিসহ ব্যাংকিং খাতের প্রায় সবকটি সূচকে দেশের প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর চেয়ে এগিয়ে রয়েছে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো সুদকে মুনাফা হিসাবে আখ্যায়িত করা, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকের শাখা বিস্তৃত করা, গ্রাহকদের বন্ধু সুলভ সেবা দেয়া, মুনাফা বা সুদ ও ক্ষতি ভাগ করে নেয়া, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সৃষ্টি করাসহ বিভিন্ন কারণে এগিয়ে যাচ্ছে। আর তুলনামূলক পিছিয়ে রয়েছে প্রচলিত ধারা ব্যাংকগুলো।
২০১৭ সালের জুন প্রান্তিকের তথ্য নিয়ে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৬ সালের জুনে ব্যাংক খাতে মোট আমানতের ২২ দশমিক ১০ শতাংশ ছিল ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর। চলতি বছরের জুনে শূন্য দশমিক ৬২ শতাংশ বেড়ে তা দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ৭২ শতাংশে।
এছাড়া শাখা বৃদ্ধি ও ঋণ বিতরণেও ইসলামী ব্যাংকগুলোর অংশ বেড়েছে। ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত মোট ঋণের ২৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ বিতরণ করে ইসলামী ব্যাংকগুলো। চলতি বছরের জুনে শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৯৮ শতাংশে। আর ব্যাংকগুলোর মোট শাখার ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ এখন ইসলামী ব্যাংকিং করছে যা গত বছর জুনে ছিল ১১ দশমিক ৪ শতাংশ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, রেমিট্যান্স আহরণেও এগিয়ে রয়েছে তারা। এতে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর অবদান ৩০ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এসব ব্যাংকে গত এক বছরে নতুন করে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় দেড় হাজার লোকের।
বর্তমানে দেশে পূর্ণাঙ্গ ধারার ইসলামী ব্যাংক রয়েছে ৮টি। ব্যাংকগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, এক্সিম ব্যাংক লিমিটেড, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, আইসিবি ইসলামীক ব্যাংক লিমিটেড ও ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড।
এছাড়া দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রচলিত ধারার ৯টি ব্যাংকও ইসলামী ব্যাংকিং শাখা চালু করেছে আর ৮টি ব্যাংক চালু করেছে ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডো। সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংকিং খাতের এক-পঞ্চমাংশই রয়েছে ইসলামী ধারার ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে।
কি কি কারণে ইসলামী ধারার ব্যাংক যাচ্ছেগুলো এগিয়ে রয়েছে বিষয়টি জানতে চাইলে এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকের মূলনীতি হলো- মুনাফা ও ক্ষতি ভাগ করে নেয়া। অর্থাৎ বিনিয়োগ করা হলে বিনিয়োগকৃত অর্থে যে পরিমাণ মুনাফা বা ক্ষতি হবে তা ব্যাংক ও গ্রাহকের মধ্যে ভাগ করে দেয়া। এসব ব্যাংকে সাধারণত পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ভিত্তিতে গ্রাহকের সঙ্গে লেনদেন হয়।
অনেকে বলে থাকেন ‘সুদ হারাম, ব্যবসা হালাল’ এই নীতিতে ভর করে চলে ইসলামী ধারা ব্যাংকগুলো- কথাটি সত্য কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি মূলনীতি নয় তবে স্লোগান। ইসলামী ধারা ব্যাংকগুলো গ্রাহককে শুধু গ্রাহক নয়, বন্ধুও মনে করে এমন মন্তব্য করে হায়দার আলী মিয়া বলেন, চাহিবা মাত্র দায়িত্বশীলতার সাথে তাদের সেবা দিয়ে থাকে। স্বল্প পুঁজির উদ্যোক্তাদের ঋণ সুবিধা দেয়া, ব্যবসায়ীদের ছোট ব্যবসাকে বড় করে তোলা, উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা-এসব কাজের কারণে সব শ্রেণির মানুষ ইসলামী ধারা ব্যাংকগুলোর প্রতি আস্থা রাখে, লেনদেনকে নিরাপদ মনে করে।
নতুন ধারার ইউনিয়ন ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সালেহ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর প্রতি গ্রাহকের আস্থা বেশি। কারণ এসব ব্যাংকে ক্ষতি খুব কমই হয়। কারণ স্বচ্ছতার সাথে লেনদেন করা হয়।
মুনাফার বিষয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে গ্রাহকদের থেকে আমানত নেয়ার সময় তাদের কমপক্ষে ৬০ শতাংশ মুনাফা দেয়ার কথা বলা হয়। আমরা তার চেয়ে বেশি দেয়ার চেষ্টা করি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুনে ব্যাংকগুলোর কাছে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল আট লাখ ৭৭ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের আমানত এক লাখ ৯৯ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। অথচ গত বছরের একই সময়ে আমানত ছিল এক লাখ ৭৫ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা।
ঋণ বিতরণেও এগিয়ে রয়েছে এসব ব্যাংক। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সব ব্যাংক মিলে ঋণ বিতরণ করেছে ৭ লাখ ৭২ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। যার মধ্যে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ রয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে বিতরণ করা মোট ঋণের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের অংশ ছিল ২৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
শাখা বিস্তৃতিতে ও এগিয়ে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশব্যাপী সব ব্যাংকের মোট শাখা রয়েছে ৯ হাজার ৭২০টি। এর মধ্যে ইসলামী ধারার ব্যাংকের শাখা আছে এক হাজার ১১২টি। যা মোট শাখার ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এসব শাখার মধ্যে পুরোদমে ইসলামী ধারার ব্যাংকিং আছে এক হাজার ৬৮টি। আর প্রচলিত ধারার বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ১৯টি ইসলামী ব্যাংকিং শাখা রয়েছে। এছাড়া ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডো খুলে কাজ করছে ২৫টি শাখা।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্ঠা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আমার মতে মূলত দুইটি কারণে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ভাল অবস্থানে রয়েছে। এক, প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো সুদকে সুদই বলে কিন্তু ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো সুদকে মুনাফা বলে দাবি করে। এটি মানুষ ইতিবাচক হিসাবে বিবেচনা করে। দুই, তারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে শাখা খোলায় আগ্রহী বেশি।
তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলোর শরীয়াহ বোর্ড আছে। সেই বোর্ডের মাধ্যমে তারা কোথায় কিভাবে বিনিয়োগ করে তা গ্রাহকদের জানায়। এছাড়া তারা গ্রাম পর্যায়ে শাখা বিস্তৃত করছে। সেখানে সাধারণ মানুষ সুদ পছন্দ করে না। কিন্তু ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো মুনাফা দেয় বলে গ্রাহকদের আস্বস্ত করে। এসব কারণে এই মতধারা ব্যাংকগুলো দিন দিন ভাল করছে বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।