বাড়তি আয় দরকার। সবে মাত্র বিয়ে করেছি। ২০০৭ সাল। তাকে জানাতেই বললেন আমার কিছু লেখা আছে সেগুলো এডিট কর। কাজ শেষে সম্মানী নাও। এভাবে আত্মসম্মানবোধের রাস্তা ঠিক রেখে পথ বাতলে দিতেন।
এরও আগে জানুয়ারিতে ১১ তারিখে কোন একটা কাজে গেছি। আটকে গেছি রাতে। জরুরী অবস্থা জারির ফলে। তারেক ভাই তার শয়নকক্ষে ডাকলেন। বললেন, ইতিহাসের অংশ হও। সেনাবাহিনীর কৌশলী ক্ষমতা দখল দেখ। কিন্তু এভাবে টিকতে পারবে না। সেনাবাহিনীর কাজ ক্ষমতা দখল না। ক্যাথরিন মাসুদ ছিলেন সেসময়। কিছুটা অবাক হয়েই তাকিয়ে ছিলেন তারেক মাসুদের দিকে।
সিলেটের স্থানীয় লোকসঙ্গীত নিয়ে গবেষণার কাজে নিভৃতে প্রথমবার যখন ঢাকা আসেন মৌসুমী ভৌমিক। ‘যশোর রোড’ খ্যাত মৌসুমী ভৌমিকের আসার খবরটা পেয়ে যাই টিংকু (এরশাদুল হক টিংকু) ভাইয়ের মাধ্যমে। তারেক ভাইয়ের কাছে আবদার মৌসুমী আপার সঙ্গে সফরসঙ্গী করাতে হবে। তিনি হালকা আপত্তি জানিয়ে বললেন, খুব ভোরে মৌসুমী ঢাকা ছাড়বে। যদি আসতে পারো তবে যেতে পারবে।’
খুব ভোরে পৌঁছে গিয়েছিলাম তারেক ভাইয়ের বাসায়। গাড়িতে উঠে রওনা দিচ্ছিলেন মৌসুমী ভৌমিক। জয়ন্তিকাতে সে এক অসাধারণ ভ্রমণ। সঙ্গে হাকিম বাউল। অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে সেই সফর অনেক কিছু জমা করেছে। লেখালেখিতে যার গুরুত্ব আজো অনুভব করি।
সবসময় তরুণদেরকে এগিয়ে দিয়েছেন সামনে। তরুণদের নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন নিরন্তর। তাদের জন্য পথ তৈরী করেছেন। পথে আটকে গেলে সেই বাঁধা অতিক্রমের পথও বাতলে দিয়েছেন। বাতিঘর হয়ে থেকেছেন তিনি চলচ্চিত্রপ্রেমী সকল তরুণের সামনে। এমনকি জীবনকে গুছিয়ে নিতে চাওয়া সুন্দর পথের খোঁজে হাঁটা সকল তরুণের কাছেও তিনি বাতিঘর হিসেবে দাঁড়িয়েছেন।
সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে ভরাট কণ্ঠে দিল খোলা হাসিতে আদ্যেপান্ত পারিবারিক মানুষটা কত প্রমিতভাবে কথা বলতেন তা ভাবলে ঈর্ষা হতো। তার মত করে কথা বলার চেষ্টা করেছি। হয়নি। হবেও না কখনো। অগাধ পড়াশোনা, জানা-বোঝা আর বিনয় তাকে দিয়েছিল অসীম চিন্তার উচ্চতা। মাঝে মধ্যে টেবিল টেনিস খেলতেন। সেই খেলায় কয়েকবার সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। শারীরিক সক্ষমতা ধরে রাখার স্বাভাবিক প্রয়াস ছিল নিরন্তর কাজ পাগল মানুষটির।
‘অন্তর্যাত্রা’ সিনেমার প্রিমিয়ার শো শেষে প্রশ্ন করেছিলাম, আচ্ছা এখানে কি আতিক (নুরুল আলম আতিক) ভাই অভিনয় করেছেন। পাসিং শট? তিনি বলেছিলেন, বুঝলে কী করে? আতিকতো পেছন ঘুরে ছিল! দেখার এ চোখটা ধরে রেখ। কাজে লাগবে!
আপনাকেই তো আর কখনও দেখা হবে না তারেক ভাই। এ দুঃখ আজন্ম বয়ে বেড়াতে হবে। ২০১১ সালের আজকের দিনে মেজর আখতারের বাসায় একটি সংবাদ সম্মেলন হচ্ছিল সেটির মাঝখানে খবর আসে তারেক মাসুদ-মিশুক মনির সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। বিশ্বাস করতে পারিনি। পরে নিশ্চিত হলেও মানতে কষ্ট হয়েছে। আজও মানতে কষ্ট হয়। তাকে শেষবারের মতো দেখতে যাইনি শহীদ মিনারে। কারণ হাসিমাখা যে মুখের ছবি অন্তরে গেঁথে আছে তা মুছে ফেলতে চাইনি।
সে বছরের ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে শহীদ মিনারে। ভিডিও করছিলেন। সস্ত্রীক দেখা হয়ে যায় তার সঙ্গে। অনেকদিনের বিরতির পর। দেখেই হেসে বললেন, বাহ স্নিগ্ধতো। বেঁচে আছো তবে। স্ত্রীর নাম জেনে নিয়ে বললেন, স্ত্রীকে নিয়ে বাসায় এসো।
ভিড়ে তিনি হারিয়ে গেলেন। ভিড়ে মিশে গেলাম আমরা। কিন্তু আপনি তো অসীমের ভিড়ে নিজেকে লুকিয়ে নিলেন। আর তো দেখা হবে না। প্রীতিলতা আর প্রবর্তন আপনার সঙ্গ পেল না। এ দুঃখবোধ তাড়িয়ে বেড়াবে এক জীবন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)