পৃথিবীর নানা দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে ধনী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা বিভিন্ন কৌশলে কর ফাঁকি দিয়ে নিজেদের সম্পদকে গোপন করে রাখছেন। পানামার একটি আইনি প্রতিষ্ঠানের এমন এক কোটি ১৫ লাখ গোপন নথি ফাঁসের পর আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ক্রাইম অব সেঞ্চুরি’।
পৃথিবীর নানান দেশের বর্তমান ও সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান, খেলোয়াড়, অভিনেতা, ব্যবসায়ী, ব্যাংকসহ প্রায় ২ লাখ ১৪ হাজার নাম রয়েছে ওই তালিকায়। গোপন নথিতে উঠে এসেছে, কীভাবে তারা কর ফাঁকি দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
ফাঁস হওয়া নথিগুলোতে দেখা যাচ্ছে, অর্থ পাচার করতে, কর ফাঁকি দিতে এবং বিভিন্ন রকম নিষেধাজ্ঞাকে ফাঁকি দিতে এই আইনি প্রতিষ্ঠানটি তার মক্কেলদেরকে পরামর্শ দিয়ে আসছে।
পানামার আইনি প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকার গোপন নথি কারা ফাঁস করেছে তা জানা যায়নি। তবে এসব নথি প্রথমে জার্মান দৈনিক সুদেস্ক জেইটাংয়ের হাতে আসে। পরে এগুলো সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টের (আইসিআইজে)কাছে পাঠায় পত্রিকাটি।
বিবিসি ও গার্ডিয়ান, ভারতের ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসসহ বিশ্বের ১০৭টি মিডিয়ার হাউজের ৩২৫ জন সাংবাদিক এবং ৭৮টি দেশ এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে।
ফাঁস হওয়া গোপনীয় এই নথি-পত্রগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর নানান দেশের মোট ৭২ জন বর্তমান ও সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান তাদের নিজেদের দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করছেন। ২শ দেশ ও টেরিটরি সব মিলিয়ে ২ লাখ ১৪ হাজার লোকের নাম রয়েছে। এদের ১৪০ জনের বেশি রাজনীতিবিদ। এরমধ্যে রয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক, লিবিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান মুয়াম্মার গাদ্দাফী এবং সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ।
শুধু রাজনীতিবিদই নন, ফাঁস হওয়া তালিকায় রয়েছে মুদ্রাপাচারকারী, মাদক ব্যবসায়ী, সেলিব্রেটি ও ক্রীড়া তারকাদের নামও।
ফাঁস হওয়া নথিতে নাম রয়েছে অনেক ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে ইউএসবি ও এইচএসবিসির মতো জায়ান্ট ব্যাংকও রয়েছে।
নথিতে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন কালো তালিকাভুক্ত ৩৩ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে তালিকায়। এর মধ্যে মেক্সিকান মাদক সম্রাট, লেবাননের শিয়া সংগঠন হিজবুল্লাহ, নর্থ কোরিয়া ও ইরান।
সেলিব্রেটিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মুভি সুপারস্টার জ্যাকি চেন ও আর্জেন্টিনা ও বার্সেলোনার ফুটবল তারকা লিওনেল মেসি। এছাড়াও উইয়েফা সভাপতি ও ফরাসি তারকা মিশেল প্লাতিনি ও চিলির ইভান জামরানো এবং সাবেক ফিফা কর্মকর্তাদের নাম রয়েছে।
নাম রয়েছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ, সৌদি বাদশাহ সালমান, মরক্কোর বাদশাহ ষষ্ঠ মোহাম্মদ ও আজারবাইজানের প্রেসিডেন্টের। এতে নাম রয়েছে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেট্রো পেরেসেঙ্কোর।
গোপন নথি নিয়ে ভারতের কাজ করেছে দেশটি অন্যতম মিডিয়া হাউজ ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস। আট মাসের অনুসদ্ধানে ৫০০ বেশি ভারতীয়র সংশ্লিষ্টতা পেয়েছেন তারা। যার মধ্যে রয়েছেন বলিউড মেগা স্টার অমিতাভ বচ্চন, তার ছেলে বৌ ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন, ভারতীয় কংগ্রেস দলের সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর মেয়ে পিয়াঙ্কা গান্ধীর স্বামী রবার্ট ভদ্র, ব্যবসায়ী সামির জেলুত, ডিএলএফ ইন্ডিয়ার কেপি সিং ও আদানী গ্রুপের গৌতম আদানী।
এছাড়া এক ব্যাংকের মাধ্যমে অন্তত প্রায় বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচারের সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগীও রয়েছেন। নাম রয়েছে আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমান্দুর গানলুগসনেরও। আছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান।
পানামার ওই আইনি প্রতিষ্ঠানটি বলছে, কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই তারা গত ৪০ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে আসছে।
ধনী ও ক্ষমতাবানেরা কত কৌশলে কর ফাঁকি দিয়ে নিজেদের সম্পদ লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে রাখেন সেই কথা প্রকাশ্যে এসেছে এই ব্যাপক সংখ্যক নথি ফাঁসের ঘটনায়।
গোপনীয়তা রক্ষাকারী হিসেবে পৃথিবীর অন্যতম প্রতিষ্ঠান মোওস্যাক ফনসেকা, যেটি পানামার একটি আইনি প্রতিষ্ঠান, সেখান থেকেই সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে ১১ দশমিক ৫ মিলিয়ন নথিপত্র।
এই নথিগুলো প্রমাণ দিচ্ছে যে মোওস্যাক ফনসেকা তার মক্কেলদেরকে অর্থ পাচার ও কর আদায়ের ক্ষেত্রে আইনি পরামর্শ দিয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি বলছে গত ৪০ বছর ধরে কোনো প্রকারের কোনো সমস্যা বা সংকট বা নিন্দা ছাড়াই তারা এটি পরিচালনা করে আসছেন।
ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস বা আইসিআইজে-এর ডিরেক্টর, জেরার্ড রাইল বলেছেন, গত ৪০ বছর ধরে মোওস্যাক ফনসেকা তার দৈনন্দিন যে সকল কাজকর্ম করেছে সেগুলোর নথি রয়েছে এই ফাঁস হওয়া ডকুমেন্টগুলোয়।
পানামার এসব নথি আলোচিত উইকিলিকস ও মার্কিন হুইসেল ব্লোয়ার এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁসকৃত নথির তুলনায় পরিমাণে অনেক বেশি।
রাইল, ‘এসব নথির যে গুরুত্ব, তাতে আমার মনে হয়, এটাই হবে বিশ্বে গোপন নথি ফাঁসের সবচেয়ে বড় ঘটনা’।