সরকার থেকে প্রয়োজনীয় সব সুবিধা আদায় করে নিয়ে এবং ঘোষণা দিয়েও প্রতিশ্রুতি রাখেনি দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। ঋণের সুদ হার সিঙ্গেল ডিজিটে (এক অংকে) নামিয়ে আনেনি অধিকাংশ ব্যাংক।
দেশের ব্যবসায়ী মহল ও উৎপাদনকারীরা বলেছে, এতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যার প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।
আর অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, সরকার ব্যাংকগুলোকে সুবিধা না দিয়ে, ব্যাংকের মালিকদের সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু ঋণের সুদ হার কমাতে বলেছে ব্যাংকগুলোকে। এতে ব্যাংকগুলোর উপর চাপ পড়েছে। তাই সুদ কমানোর ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বিলম্ব করছে।
ঋণের সুদ এক অংকে নামিয়ে আনার জন্য এখনই মোক্ষম সময় বলে মনে করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি শফিউল ইসলাম (মহিউদ্দিন)।
শফিউল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, এখনই ব্যাংকগুলোকে এই সুদ হার কার্যকর করা উচিত। কয়েকটি ব্যাংক সীমিত কয়েকটি খাতে এক অংকে সুদে ঋণ দিচ্ছে। এটা সব খাতে বাস্তবায়ন করা দরকার। ডাবল ডিজিটের সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রণালয়ের উদ্দেশে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, বিনিয়োগ ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে সুদ হার কমানোর বিকল্প নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রণালয়কে এই বিষয়ে জোর পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ সুদ হার না কমালে শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দিবে। কর্মসংস্থান কমে যাবে। যার প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতিতে।
এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, অনেক ব্যাংকই এক অংক সুদে ঋণ দিচ্ছে। তবে ৬ শতাংশ সুদে আমানত নিয়ে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া কষ্টকর। এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ব্যাংক খাত কিছুটা সমস্যায় পড়েছে। এটা পুরোপুরি বাস্তবায়নে কিছু সময় লাগবে।
চলতি বছরে তারল্য সংকট মেটাতে ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার (সিআরআর) ১ শতাংশ কমিয়ে দেয়া, সরকারি আমানতের ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেসরকারি ব্যাংকে রাখার বিধান চালু করা, রেপোর হার (সঙ্কট মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ধারের হার) পৌনে ১ শতাংশ কমিয়ে পৌনে ৭ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার সুযোগ দেয়া এবং ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) সমন্বয়ের সময়সীমা প্রায় এক বছর বাড়িয়ে দেয়া হয়।
ব্যাংকগুলোকে এসব সুবিধা দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, সরকার ব্যাংকিং খাতে সুবিধা দেয়নি। উল্টো সুবিধা দিয়েছে ব্যাংকের মালিকদের। কিন্তু ব্যাংকগুলোর উপর কেন আমানতে ৬ শতাংশ আর ঋণে ৯ শতাংশ সুদ হার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে তা বোধগম্য নয়। মালিকদের সুবিধা দিয়ে ব্যাংকের উপর চাপ বাড়ানো মোটেও ঠিক হয়নি। এ কারণে হয়তো ব্যাংকগুলো ঋণের সুদ হার কমাতে পারছে না বলে জানান তিনি।
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যাংকের সুদ হার নির্ধারণ করার দায়িত্ব স্ব স্ব ব্যাংকের, গভর্নর বা মন্ত্রীর নয় এমন মন্তব্য করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এভাবে সুদ হার নির্ধারণ করা আইনত অন্যায় হয়েছে। কারণ ‘ল অব কম্পিটিশন অনুযায়ী’, যারা ব্যবসায় কম্পিটিটর বা প্রতিযোগী তাদেরকে আইন অনুযায়ী, কোনো পণ্যের মূল্য বেঁধে দেয়া যায় না। অতএব ব্যাংকের মালিকদের ব্যক্তিগতভাবে সুবিধা দেয়া এবং সুদ হার নির্ধারণ করে দেয়া দুটোই অন্যায় হয়েছে বলে আমি মনে করি।
ব্যাংক মালিকেরা বলেছিলেন, জুলাই মাস থেকে সব ব্যাংক ঋণের সুদহার এক অংকে নামিয়ে আনবে। সে অনুযায়ী, ৩৭ ব্যাংক এটি বাস্তবায়ন করেছে। তবে সব ধরনের ঋণে সুদ হার এক অংকে নামায়নি এসব ব্যাংক। শুধু উৎপাদনশীল খাতে এই হার কার্যকর করা হয়েছে। কিন্ত গ্রাহক ভেদে এই হার ২২ শতাংশ পর্যন্ত রাখা হচ্ছে।
গত ২০ জুন ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবি এক বৈঠক থেকে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণের সিদ্ধান্তের কথা জানায়। তিন মাস মেয়াদি আমানত নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয় সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদে।
এরপর ২৭ জুন এবিবির এক বৈঠক থেকে মালিক পক্ষের ঘোষণা কার্যকরের কথা জানানো হয়। ওই সময় বলা হয়, ১ জুলাই থেকে ঋণের সুদ হার এক অংকে কার্যকর করা হবে। কিন্তু অনেক ব্যাংকই তা করেনি। পরে ২ আগস্ট বৈঠক করে ৯ আগস্ট থেকে কার্যকর করা হবে বলে জানানো হয়।
সুদ হার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর অবস্থানে রয়েছে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, এটি কার্যকর করা হচ্ছে কি না তা জানতে সব ব্যাংককে চিঠি দেয়া হয়েছে। এটি পরিদর্শনের জন্য ১০টি টিম গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া আগে ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদ হারের তথ্য প্রতি মাসের ১৫ তারিখে মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক জমা দেয়ার নিয়ম থাকলেও চলতি মাস থেকে তা ১০ তারিখের মধ্যে জমা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, জুলাই মাসে মেয়াদি ও শিল্প ঋণের সুদ হার কমিয়ে এক অংক কার্যকর করেছে সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি মালিকানার ৩৭টি ব্যাংক। তবে এসব ব্যাংকের অনেকগুলোই মেয়াদি ও শিল্প ঋণের মধ্যে একটির সর্বনিম্ন সুদ হার ৯ শতাংশ কার্যকর করেছে। দেশের মোট ৫৮টি ব্যাংকের মধ্যে বাকি ব্যাংকগুলোতে চলতি মাসেই ঋণের সুদ হার ৯ শতাংশে কার্যকর করার কথা রয়েছে। এছাড়া কৃষি ঋণে সুদ হার আগে থেকেই ৯ শতাংশের কম রয়েছে সব ব্যাংকের।
তথ্য অনুসারে সরকারি ৮ ব্যাংকের মধ্যে জুলাইয়ে সুদ হার সিঙ্গেল ডিজিটে কার্যকর করেছে ৪টি। এ সময় সুদের হার কমাতে পারেনি বেসিক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল), রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (বিকেবি)।
এছাড়া দেশি ব্যক্তি মালিকানা ব্যাংকের মধ্যে ১১টি ব্যাংক জুলাইতে সুদের হার কমায়নি। তবে এর মধ্যে একটি ব্যাংক শুধু বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য ৯ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদের হার নির্ধারণ করেছে। বিদেশি ৯টি ব্যাংকগুলোর মধ্যে দুটি ব্যাংক ছাড়া বাকিগুলোর সুদ হার রয়েছে সিঙ্গেল ডিজিটে।