১৩ জুন, ১৯৭১। যুক্তরাজ্যের দৈনিক পত্রিকা সানডে টাইমসে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় সেদিন। যেখানে তুলে ধরা হয় ‘বাংলাদেশ’ নামের এক জাগরণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ভয়াবহ দমন-পীড়নের চিত্র।
লেখাটি প্রকাশ হওয়ার পর প্রতিবেদকের পরিবারকে গা ঢাকা দিতে হয়েছিলো সত্যি। কিন্তু ওই একটি লেখার কারণে যে পৃথিবীর ইতিহাসটাও সেদিন বদলে গিয়েছিলো সেটাও কম সত্যি নয়।
দক্ষিণ এশিয়ার সাংবাদিকতার গত অর্ধ শতাব্দীর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখার একটি এই প্রতিবেদন, যার শুরুটা এরকম:
‘আব্দুল বারীর ভাগ্য ফুরিয়ে গিয়েছিলো। পূর্ববঙ্গের অন্য হাজারো মানুষের মতো সে একই ভুল করেছিলো – মারাত্মক একটা ভুল – পাকিস্তানি সেনা টহলের সামনে পড়ে যাওয়া। তার বয়স ২৪ বছর, রোগাপাতলা এই মানুষটার চারদিক ঘিরে সৈন্য। ভয়ে কাঁপছিলো সে, কারণ এখনই তাকে গুলি করা হবে।’
প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন পাকিস্তানেরই এক রিপোর্টার, নাম অ্যানথনি মাসকারেনহাস। তার লেখা এই প্রতিবেদনটিই প্রথমবারের মতো বিশ্ববাসীর সামনে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের মুক্তির সংগ্রামকে ঠেকাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পরিচালিত নৃশংস অভিযানের চিত্র।
মাসকারেনহাসের ওই লেখাটির ওপর প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তানের নিপীড়ন সম্পর্কে বিবিসি লিখেছে, পাকিস্তানের ওই কৌশল ব্যর্থ হয়েছিলো। বাংলাদেশ এখন প্রতি বছর তার জন্মবার্ষিকী পালন করে।
বিবিসি লিখেছে, ‘কেউ নিশ্চিতভাবে জানে না যুদ্ধে ঠিক কতজন মারা গিয়েছিলো। তবে সংখ্যাটা যে বিশাল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অনেক গবেষকের মতে, নিহতের সংখ্যা ৩ লাখ থেকে ৫ লাখের মধ্যে। বাংলাদেশ সরকারের মতে সংখ্যাটি ৩০ লাখ।’
মাসকারেনহাসের লেখা সেই রিপোর্ট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তির পেছনে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। এর কারণেই সারা বিশ্ব ওই সময় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলো এবং ভারতকে উৎসাহিত করেছিলো বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য।
প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সানডে টাইমসের সে সময়কার সম্পাদক হ্যারল্ড ইভানসকে বলেছিলেন, লেখাটি তাকে এতো গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে যে, তিনি ‘ব্যক্তিগতভাবে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে ইউরোপের রাজধানীসমূহ ও মস্কোকে রাজি করেছিলেন যেনো তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সশস্ত্র অংশগ্রহণে সাহায্য করে।’
এটাই যে মাসকারেনহাসের উদ্দেশ্য ছিলো, তা অবশ্য নয়। ইভানসের ভাষায়, ‘তিনি শুধু খুব ভালো একজন সাংবাদিকের মতো সততার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করছিলেন।’
শুধু তাই নয়, মাসকারেনহাস খুবই সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন প্রতিবেদনটি লেখার মধ্য দিয়ে। ওই সময় পাকিস্তান ছিলো সামরিক সরকার নিয়ন্ত্রিত। মাসকারেনহাস খুব ভালো করেই জানতেন, তার এই লেখা সংবাদপত্রে প্রকাশের আগেই তাকে এবং তার পরিবারকে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। ওই সময়টাতে খুব সহজ কাজ ছিলো না সেটা।
১৯৭১-এর মার্চে যখন পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হলো, মাসকারেনহাস ছিলেন করাচির একজন গণ্যমান্য সাংবাদিক। দেশের কর্তাব্যক্তিদের সুনজরে ছিলেন তিনি। তিনি পাকিস্তানের সংখ্যালঘু গোন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের একজন সদস্য ছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচনে সে বার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও তাদেরকে সাথে সাথে সরকার গঠনের সুযোগ দিলো না পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকার। সরকার গঠন নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তৎকালীন সরকারের টানা আলোচনায় বাঙালিদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, পশ্চিম পাকিস্তান চাইছে না বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দিতে। ইচ্ছা করে আটকে রাখছে সব প্রক্রিয়া।
সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। আওয়ামী লীগ নাগরিক অভ্যুত্থানের ডাক দেয়। দলটির বেশ কয়েকজন সমর্থক কিছু অ-বাঙালি বেসামরিক লোকজনের ওপর হামলা চালায়। ফলাফল হয় ভয়াবহ। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছুটে আসে হাজারো সেনার দল।
আওয়ামী লীগসহ পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী, হিন্দু সম্প্রদায় এবং অন্য যাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকার নিজেদের শত্রু মনে করতো, তাদের নিধন করতে এবং আন্দোলনকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে ২৫ মার্চ রাতে সেই সরকার পূর্ব পাকিস্তানে চালায় এক ধ্বংসাত্মক অভিযান।
কুখ্যাত ওই যুদ্ধাপরাধের ইতিহাসের প্রথম পাতাটি লেখা হয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের রক্তে। ঢাকাকে রক্তাক্ত করার পর সেনারা অগ্রসর হয় মফস্বল ও গ্রাম এলাকাগুলোর দিকে। সেখানে হামলা চালিয়ে তারা যুদ্ধ করে ছোট ছোট স্থানীয় বিপ্লবী দলগুলোর সঙ্গে।
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিলো সেনা অভিযান সফল হয়েছে। সাফল্যের আতিশয্যে সেনাবাহিনী কয়েকজন নামীদামি পাকিস্তানি সাংবাদিককে নিয়ে এলো তারা ‘মুক্তি’ সমস্যা কতো সহজে সামলে নিয়েছে তা দেখানোর জন্য।
ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সব বিদেশী সাংবাদিককে বের করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিপক্ষ কী বিশৃঙ্খলা করছে সেটাও সবাইকে দেখানো দরকার। তাই মাসকারেনহাসসহ ৮ পাকিস্তানি সাংবাদিককে ১০ দিনের এক বিশেষ সফরে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসা হলো।
সফর শেষে দেশে ফিরে প্রতিবেদনে সাংবাদিকরা তাই লিখলেন, সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যা তাদের শিখিয়ে দেয়া হয়েছিলো; শুধু একজন ছাড়া।
মাসকারেনহাস পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিধ্বস্ত অবস্থায় ফেরা চেহারার কথা মনে করে স্ত্রী ইভন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি আগে কখনো আমার স্বামীকে এমন অবস্থায় দেখিনি। তিনি ছিলেন একেবারে স্তম্ভিত, বিপর্যস্ত এবং ভয়ানকভাবে মর্মাহত। তিনি বলেছিলেন, আমি যা দেখে এসেছি তা নিয়ে যদি লিখতে না পারি, তবে আমি আর কোনোদিন আর কিছু লিখতে পারবো না।’
ওই সময় সরকারের কাজের বিরুদ্ধে লেখা পাকিস্তানে সম্ভব ছিলো না। কারণ পত্রিকার প্রতিটি প্রতিবেদন সেনাবাহিনী যাচাই করে প্রকাশের অনুমতি দিতো। মাসকারেনহাস এমন কিছু চেষ্টা করলেই যে তাকে গুলি খেয়ে মরতে হবে তা তিনি খুব ভালো করেই জানতেন।
তাই বোনের অসুস্থতার অজুহাতে তিনি লন্ডনে চলে যান। সেখানে গিয়েই সানডে টাইমসের সম্পাদকের সঙ্গে তিনি সরাসরি যোগাযোগ করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভয়াবহতার কথা তুলে ধরেন। সম্পাদক ইভানস তার আত্মজীবনীতে লেখেন, ‘তিনি (মাসকারেনহাস) মার্চে বাঙালিদের সহিংসতা দেখে হতবাক হয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু এটাও বলেছিলেন যে, সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ সার্বিকভাবে আরো অনেক বেশি ভয়াবহ ছিলো।’
মাসকারেনহাস আরো বলেছিলেন, তিনি একটি সুশৃঙ্খল গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি সেনা কর্মকর্তাদের এ-ও বলতে শুনেছিলেন যে, এই হত্যাকাণ্ডই হচ্ছে ‘চূড়ান্ত সমাধান’।
ইভানসের পরামর্শ অনুসারে রিপোার্টটি প্রকাশের আগেই মাসকারেনহাস তার স্ত্রী-সন্তানদের করাচি থেকে সরিয়ে নিয়ে আসেন। ‘অ্যানের অপারেশন সফল হয়েছে’ এই সংকেতের টেলিগ্রাম পেয়েই অনেক কষ্টে পাকিস্তান সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে করাচি থেকে লন্ডনে পালিয়ে যান স্ত্রী ইভন ও পাঁচ সন্তান।
মাসকারেনহাস প্রথম থেকেই পাকিস্তান সরকারের আস্থাভাজন ছিলেন। তাই ওই পাকিস্তান সরকারেরই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তার লেখাটির বিশ্বাসযোগ্যতা ও শক্তি ছিলো অনেক বেশি।
‘আমি আর্মি ইউনিটগুলোর নৃশংসতা দেখেছি। দেখেছি তাদের ‘শাস্তি’ দেয়ার প্রক্রিয়াতে পুরো একেকটি গ্রাম ধ্বংস হয়ে যেতে। আর অফিসারদের মেসে শুনেছি সাহসী এবং সম্মানীয় জানতাম এমন কর্মকর্তাদের মুখে হত্যাকাণ্ড নিয়ে অবিশ্বাস্য সব হাস্যরসাত্মক আলাপচারিতা।
‘তুমি কয়টা মারলে?’ উত্তরগুলো আমার মাথায় গেঁথে আছে।’
পাকিস্তান সরকারের দৃষ্টিতে মাসকারেনহাসের রিপোর্টটি ছিলো এক চরম বিশ্বাসঘাতকতা। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর তাকে শত্রুপক্ষের এজেন্ট হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। পাকিস্তান এখনো মাসকারেনহাসের রিপোর্টে বর্ণিত হত্যাযজ্ঞকে অস্বীকার করে আসছে। তাদের দাবি, এই অভিযোগগুলো সবই ভারতের প্রোপাগান্ডা।
এসব কিছুর পরও মাসকারেনহাস পাকিস্তানের খোঁজ-খবর খুব ভালোই রাখতে পারতেন। পাকিস্তান নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরি করেছে – ১৯৭৯ সালে এ তথ্য ফাঁস করা প্রথম সাংবাদিক তিনিই ছিলেন।
পাকিস্তান মাসকারেনহাসকে দেশদ্রোহী হিসেবে দেখলেও বাংলাদেশ কিন্তু তাকে যথেষ্ট সম্মানের দৃষ্টিতেই দেখে। তার লেখাটি এখনো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ লেখাগুলোর মধ্যে এটি একটি,’ জানান জাদুঘরের ট্রাস্টিদের একজন মফিদুল হক, ‘এটা এমন সময় বেরিয়েছিলো যখন আমাদের দেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিলো এবং এটিই পুরো পৃথিবীকে জানিয়েছিলো আসলে ওই সময় এখানটায় কী হচ্ছিলো।’