বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক প্রবৃদ্ধি সমানুপাতিক নয়। সামাজিক শৃংখলার জন্য সবচেয়ে জরুরী উপাদান সাংস্কৃতিক আলোকায়ন। সাংস্কৃতিক আলোকায়ন ঘটানোর দায়টি সমাজের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। আমাদের সমাজের গার্মেন্টস কর্মী, একজন অনাবাসী শ্রমিক; প্রত্যন্তের কৃষক এইসব মেহনতী জনতা বাংলাদেশকে আশা জাগানিয়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উপহার দিয়েছে। মধ্যবর্তী দালাল বা ফড়িয়া শ্রেণীটি পেশী ও কালো টাকার জোরে রাজনীতি ও গণতন্ত্রের নামে নীতি নির্ধারক হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে যে বিপুল সম্পদ লুন্ঠন হয়েছে; তা লুন্ঠিত না হলে বাংলাদেশের আজ বিশ্বব্যাংক বা আই এম এফ-এর ঋণ নেবার কোন প্রয়োজন থাকতো না। এই লুন্ঠকদের সহযোগী হয়ে ব্যবসায়ী, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা সম্পদের পাহাড় গড়েছে। আর আজ দেশে যে ধনীর সংখ্যা বেড়েছে তা দরিদ্রকে আরো দরিদ্র করে।
এই অধিকার বঞ্চিত মানুষের পক্ষে অধিকারের লড়াইটি করার কথা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের। কারণ আগে ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধের সংগ্রামে মধ্যবিত্তই প্রান্তিক মানুষকে বুঝিয়ে মুক্তির সংগ্রামের পথে নিয়ে গিয়েছিলেন। ওই মুক্তি সম্ভব হয়েছিলো; কারণ স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতৃত্বও এসেছিলো মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে। বৃটিশ ও পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক অপশক্তির বিরুদ্ধে মুক্তির সংগ্রামে আজকের মতো রাজতান্ত্রিক, ব্যবসায়ী, সাবেক আমলা, সাবেক মাস্তান নির্ভর রাজনৈতিক নেতা যদি নেতৃত্ব দিতো; বাংলাদেশ কখনোই স্বাধীন হতে পারতো না। আর রাজনীতি থেকে মধ্যবিত্ত নেতাদের বিদায়ের পর বাংলাদেশ আবার নিজভূমে অবরুদ্ধ। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন বা পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনের সময়ে যে মধ্যবিত্ত সমাজ সক্রিয় ছিলো; তাদের মধ্যবিত্ত জীবনের গর্ব ছিলো-সততার-প্রজ্ঞার-অল্পে তুষ্ট থাকার। সে সময় সমাজে একজন শিক্ষকের মর্যাদা ছিলো সবার ওপরে। এর ফলে প্রতিটি উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন সূচিত হয়েছে সাংস্কৃতিক আলোকায়নের মাধ্যমে। ইউরোপের নবজাগরণ ঘটিয়ে ছিলো মধ্যবিত্ত সমাজ। আজো ইউরোপের মধ্যবিত্ত সমাজ আলোকায়নের কাজটি করে যাচ্ছে।
পুঁজিবাদ পশ্চিমে জন্ম নিলেও তার নীল দংশন বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ায় অধিক দৃশ্যমান। ইউরোপের মধ্যবিত্ত বাসে-ট্রামে ঘুরে;আর বাংলাদেশের মধ্যবিত্তকে ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে গাড়ী কিনতে হয়; কারণ রাজনীতি-আমলাতন্ত্রের-ট্রান্সপোর্ট ব্যবসার মাস্তানরা মিলে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থাকে অকেজো করে রেখেছে। যাতে মধ্যবিত্ত অফিস শেষে বাসে ভোগান্তিক্লিষ্ট হয়ে বাড়ী ফিরে চারটে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।যেন মানুষের মুক্তির চিন্তা করার ক্ষমতা তার না থাকে। মধ্যবিত্তকে ক্ষমতা কাঠামোর লুন্ঠক শ্রেণীটি চেষ্টা করছে জীবন যুদ্ধের চাকায় ফেলে হয় দরিদ্র করে ফেলতে; বা তাদের সামনে আত্মসমর্পণ করে একটু সুযোগ সুবিধা নেবার জন্য নতজানু দলদাস হয়ে ঘুরাতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে দেখেছি ইংরেজী বিভাগের নবীন-প্রাক্তন পুনর্মিলনীতে আমাদের চোখে সবসময় নায়ক ছিলেন আমাদের শিক্ষকেরা। ঐ বিকেলটি আবর্তিত হতো প্রিয় শিক্ষকদের ঘিরে। ২০০১ সাল পর্যন্ত এমনই ছিলো ছবিটা। তারপর হঠাত এক পুনর্মিলনীতে দেখলাম হঠাত কেন যেন এক পুলিশ কর্মকর্তাকে ঘিরে জটলা বাড়ছে। অর্থাৎ সমাজের চোখে পুলিশ একজন বাতিঘর শিক্ষকের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তার মানে সমাজের মনোজগতে ভীতি ঢুকেছে এবং আগ্রহ কেন্দ্রীভুত হচ্ছে রাজনীতির মাস্তান, পুলিশ, স্পন্সর দিতে পারবে এমন ব্যবসায়ীর দিকে।
এ দৃশ্য আগে গ্রামে দেখেছি, পুলিশের এস আই, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব, রাজনীতির আদুভাই গরীব মানুষের ঈশ্বর হয়ে ঘুরছে; মানুষ তাদের ঘিরে মিথ তৈরী করছে; এইভাবে দ্রুত গ্রাম থেকে গ্রামে এমনকী ঢাকা ইউনিভার্সিটির টিএসসিতে গ্রামীণ মনোজগত এসে উপস্থিত। কারণ মধ্যবিত্তকে এখন পুলিশ বা মন্ত্রী বা তাদের হাতাদের সঙ্গে ছবি তুলে ফেসবুকে সেলফি আপলোড করে অন্যদের বোঝাতে হয় যে, সে ক্ষমতা কাঠামোর কাছাকাছি আছে। এ কেবল মনের দৈন্য নয়; এ কেবল সমাজের সাফল্যের সংজ্ঞা বদলে যাওয়া নয়। এ হচ্ছে ভীতিপ্রদ পরিবেশে টিকে থাকার জন্য মধ্যবিত্তের প্রাণপণ চেষ্টা। পুলিশ কর্মকর্তা বিরাট গাড়ী নিয়ে এসে টিএসসি’র সামনে নামে; ওয়াকিটকি নিয়ে চারটে এস আই এদিক ওদিক দৌড়ায়; কর্মকর্তা গাড়ী থেকে নেমে ‘সফল যারা কেমন তারা’ তারকা হয়ে প্রবেশ করে ঐতিহ্যবাহী ইংরেজী বিভাগের পুনর্মিলনীতে।
এমন সময় একজন প্রবাদ প্রতীম শিক্ষক তখন রিক্সা থেকে নামলেন; পুলিশ কর্মকর্তা তাকে সালাম দিলে টিএসসির গ্রামে সাড়া পড়ে যায়; এ শুধু পুলিশ নয়; মহৎ হৃদয় স্যারকে সালাম দিতে ভোলে নাই। এরপর কোথায় রইলো সে শিক্ষক; পুলিশ ভাইয়াকে ঘিরে আরবান ফোক; একটু যদি পুলিশ ভাইয়ার সঙ্গে পরিচয় ঝালিয়ে নেয়া যায়; বিপদে আপদে সাহায্য চাওয়া যাবে। এইসময় কোন অর্ধোন্মাদ মন্ত্রী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলে সেখানেও তেলের নহরটি বয়ে যায়। এবং এই যে ভীতির মধ্যে বসবাস করা লোকজনের ক্ষমতার প্রতি ভীতি মিশ্রিত আকর্ষণ; এই দাস মনোবৃত্তিটি বৃটিশ আমলে ছিলো; পাকিস্তান আমলে ছিলো। হঠাত ২০০১ সালের পর থেকে বাংলাদেশে কেন একই রকম ঔপনিবেশিক ক্ষমতা কাঠামো জনিত ভীতির সংস্কৃতিটি ফিরে এলো!
এই যে সাংস্কৃতিক নিমজ্জন; এই যে মধ্যবিত্তের আত্মবিশ্বাসের অবনমন ও অবদমন; এখানে কলুর বলদের মতো খেটে যে ছোট খাট মানুষেরা বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ অবস্থানে নিয়ে গেলো; তাদের প্রাপ্য অধিকারের জন্য এখন লড়াই করবে কে!
গার্মেন্টস কর্মীদের আগুনে পুড়িয়ে মারা বা দালান ধসিয়ে মারার যে গণহত্যা তার বিচার কে করবে! কোন মধ্যবিত্ত ‘জাহানারা ইমাম’ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবেন! এখন তো মধ্যবিত্ত থেকে পেকে একটু উচ্চ মধ্যবিত্ত হলেই নারীরা সংরক্ষিত আসনে সাংসদ হবার জন্য দৌড়ায় অথবা এনজিও’র দোকান খুলে অমুক আপা তমুক আপা হয়ে ঘুরে। বিদ্রোহী কোন কবিকে একটা ‘একুশে পদক’ দিলে লেজ গুটিয়ে বাঘ থেকে বেড়াল হয়ে যায়। এক খন্ড জমি দিলে জ্বালাময়ী সাংবাদিক ঠান্ডা বরফ হয়ে যায়। একটা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য হবার জন্য দাসখত দিয়ে নির্লজ্জ শিক্ষক দলীয় রাজনীতিতে নেমে পড়ে ।
দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশের ইন্টারনেটের স্পিড বাংলাদেশের চেয়ে বেশী; অথচ বাংলাদেশের মাথা বিক্রি করা হীনমন্য কতিপয় মধ্যবিত্ত ক্ষমতা কাঠামোকে খুশী করতে এমন সব আকাশ-কুসুম ডিজিটাল গল্প ফাঁদে; যেন বাংলাদেশ উন্নয়নের প্যারাসুটে করে মঙ্গলগ্রহে যাত্রা করেছে। সে সবকিছুতেই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ।
এই যে আরিচা ঘাটের দাঁতের মাজন বিক্রেতার মত উন্নয়ন হকার সেজে ব্যক্তিত্বহীন কিছু মধ্যবিত্ত ঘুরছে; এদের মনোজগত একাত্তরের ঘাতক দালালের মতো।পাকিস্তানী ঘাতক টিক্কা খানের পিছে দাঁড়িয়ে যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামান ছবি তুলে যেভাবে পুলক অনুভব করেছিলো; বিরাট ক্ষমতার চৌম্বক আবেশ; এই একই আবেশে ২০০২ সাল থেকে ২০১৫ সালের কামারুজ্জামানরা ঘাতক অমুক ভাই তমুক ভাইয়ের সঙ্গে ছবি তুলছে। একাত্তরে কামারুজ্জামানের ছবিটি যখন পত্রিকায় এসেছিলো; কামরুজ্জামান তখন সমাজে নিজের ক্ষমতার জানান দিয়েছিলো। কিছুদিন আগে ফাঁসির দড়িতে সেই ক্ষমতার মোহজনিত ঘাতকতার দায় তাকে শোধ করতে হয়েছে।
বাংলাদেশের পুরো ছবিটাই তো অন্ধকার নয়; এখানে রয়েছে সম্ভাবনার আলোক উদ্ভাস। শিক্ষিত তারুণ্যের বিকাশ ঘটছে; যারা এই নরভোজী উন্নয়ন অপসংস্কৃতির অন্তঃসারশূণ্যতা অনুধাবন করতে পারে। সৎ উপার্জনে শিরদাঁড়া ঋজু করে দাঁড়ানোর মত একটি প্রজন্ম আসছে। হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত এই নবজাগরণের অভিঘাত ধেয়ে আসছে; ঔপনিবেশিক আদলের পুলিশী রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ছিলোনা। অসংখ্য স্ববিরোধিতা নিয়ে নিরংকুশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য যে দুষ্টচক্র আজ সক্রিয়; তারা জানেনা; তোমাকে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে। শাসক-শোষক-কোলাবরেটরদের ফেসবুকে রাজসিক নির্লজ্জ জীবন উদযাপনের চিত্র; ক্লিনিকাল লায়ার হিসেবে সরকারের যে কোন ভুলকে জাস্টিফিকেশন দিতে যে দালাল-রাজাকাররা আজ সক্রিয়, তাদের ‘অমুক ভাই’ ও ‘তমুক ভাইদের’ সঙ্গে সেলফিগুলো জমা হচ্ছে আগামীর মানবতা বিরোধী অপরাধ ট্রাইবুনালে প্রামাণিক চিত্র হিসেবে জমা দেবার জন্য। জার্নালিজম এবং সিটিজেন জার্নালিজম যেভাবে বিকশিত হয়েছে; দুষ্টচক্রের সমুদয় অপরাধের খবর উন্মোচিত হচ্ছে প্রতিদিন।
নবাগত প্রজন্মকে মনোজগতে সাম্যভাবনা নিয়ে এদেশের ক্ষমতা কাঠামোর ফাঁদে জিম্মী জনমানুষকে মুক্ত করতে হবে। নতজানু মধ্যবিত্তের আত্মকেন্দ্রিকতার ‘কেঁচো’ জীবন প্রত্যাখান করে আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন সমাজ গঠনে সক্রিয় হতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটিকে ব্যবহার করতে যুক্তির আলোকায়নের বাহন হিসেবে। কিছু দলদাস উপমানব এসে যুক্তিহীনতা জনিত অশ্লীল শব্দাবলী ব্যবহার করবে। যার যুক্তি নেই; তার আছে গালি; হতভাগাদের মনোজগতের বিকৃতি আর্কাইভ হয়ে থেকে যায় আন্তর্জালে; অথচ যুক্তিবাদী মানুষের কথা সম্ভাবনার আলোক উদ্ভাস হয়ে রয়ে যায় সেখানে। মানুষের মূল আকর্ষণ শুভ’র প্রতি। সমাজে অশুভ’র দোর্দন্ড প্রতাপে হয়তো তারা সেটা প্রকাশ করতে পারে না।
নববর্ষের নারী নিগ্রহে মাত্র ৩০-৪০টি বিকৃত উপপুরুষ সক্রিয় ছিলো; বাকী সবাই এর বাইরের মানুষ; পুরো রাষ্ট্রিক নিগ্রহে ঐ ৩০-৪০টি বিকৃত ক্ষমতারোগীই সক্রিয়। এখান থেকে আমাদের মোট জনসংখ্যার মাঝে মন্দ মানুষের সংখ্যা বা শুভ-অশুভ অনুপাতের ধারণা পাওয়া যায়। নববর্ষে ৩০-৪০ জন বিকৃত উপপুরুষ নারীর প্রতি যৌন সন্ত্রাস করে পার পেয়ে যাবার কারণ; হাজার হাজার মানুষের নিষ্ক্রিয়তা। তেমনি রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার জনিত সন্ত্রাসীর সংখ্যা কম হলেও কোটি কোটি মানুষের নিষ্ক্রিয়তা বাংলাদেশে নিজভূমে ঔপনিবেশিক চরিত্রের শাসকগোষ্ঠীকে নিরংকুশ পীড়নতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সাহস দিয়েছে। এই সাহসটি ভেঙ্গে দিতে একটি সক্রিয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উন্মেষ সময়ের দাবী। একটি সামষ্টিক নবজাগরণ সন্নিকটে; কারণ নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)