এক প্রজন্মের চিন্তাধারা আর অনুভূতিতে আমূল পরিবর্তন এনে দেয় একটি গান। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল। ভারতের এইচএমভি সেদিন প্রকাশ করে কবির সুমনের প্রথম অ্যালবাম ‘তোমাকে চাই’। আর এই একটি মাত্র অ্যালবাম বদলে দেয় অনেক কিছু। ভালোবাসা প্রকাশের চমত্কার একটি ভাষা যেন খুঁজে পায় বাংলা গানের শ্রোতারা।
আজ ২০১৭ সালের ২৩ এপ্রিল। ২৫ বছর পূর্ণ করেছে একটি গান, একটি অ্যালবাম। নাম ‘তোমাকে চাই’।
কবির সুমন তার গান নিয়ে বলেছেন, ‘পণ্ডিত জ্ঞান প্রকাশ ঘোষ, প্রেমেন্দ্র মিত্র থেকে শুরু করে বব ডিলান—এঁদের সবার গানেরই প্রভাব রয়েছে আমার গানে।’
কবির সুমন সম্পর্কে গায়ক সুজন মুখার্জি নীল বলেছেন, ‘পঙ্কজ মালিক, অনুপম ঘটকসহ বেশ কয়েকজন গুণী সংগীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন সুমনদা। তাঁর একটি গান শোনার পর আমার বাবা আমাকে গান ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। বাণিজ্যিক কনসার্ট কিংবা হিট অ্যালবাম প্রকাশে কখনোই ব্যতিব্যস্ত দেখা যায়নি গুণী এই শিল্পীকে। তার পরও আধুনিক বাংলা গানের ইতিহাসে সংগোপনে নিজের নাম লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি। তাঁর কণ্ঠের অজস্র গান আজও আমাদের সবাইকে বিমোহিত করে রেখেছে।’
কবির সুমনের জন্ম ১৯৫০ সালের ১৬ মার্চ। একেবারে ছেলেবেলাতেই বাবা এবং মায়ের হাতে তাঁর গানের হাতেখড়ি। বাবা মা দুজনেই ছিলেন ভালো সংগীতজ্ঞ। বললেন, ‘আমি সঙ্গীত কতটা জানি তা আসলে জানিনা, তবে আমি ভালো সঙ্গীতের ছাত্র।’
আসলেই তিনি সঙ্গীতের মনযোগী ছাত্র। আজকের দিনে দাঁড়িয়েও সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ ছেঁকে ফেললে তাঁর মতো এমন ওয়ার্ল্ড মিউজিকের একনিষ্ঠ ছাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে।
‘তোমাকে চাই’ গানের কথা
প্রথমত আমি তোমাকে চাই
দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই
তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই
শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই।
নিঝুম অন্ধকারে তোমাকে চাই
রাতভোর হলে আমি তোমাকে চাই
সকালের কৈশোরে তোমাকে চাই
সন্ধের অবকাশে তোমাকে চাই
বৈশাখী ঝড়ে আমি তোমাকে চাই
আষাঢ়ের মেঘে আমি তোমাকে চাই
শ্রাবণে শ্রাবণে আমি তোমাকে চাই
অকালবোধনে আমি তোমাকে চাই।
কবেকার কলকাতা শহরের পথে
পুরোনো নতুন মুখ ঘরে ইমারতে
অগুন্তি মানুষের ক্লান্ত মিছিলে
অচেনা ছুটির ছোঁয়া তুমি এনে দিলে
নাগরিক ক্লান্তিতে তোমাকে চাই
এক ফোঁটা শান্তিতে তোমাকে চাই
বহুদূর হেঁটে এসে তোমাকে চাই
এ জীবন ভালোবেসে তোমাকে চাই।
চৌরাস্তার মোড়ে পার্কে দোকানে
শহরে গঞ্জে গ্রামে এখানে ওখানে
স্টেশন টার্মিনাস ঘাটে বন্দরে
অচেনা ড্রয়িংরুমে চেনা অন্দরে
বালিশ তোশক কাঁথা পুরোনো চাদরে
ঠান্ডা শীতের রাতে লেপের আদরে
কড়িকাঠে চৌকাঠে মাদুরে পাপোশে
হাসি রাগ অভিমানে ঝগড়া আপোসে
তোমাকে চাই,তোমাকে চাই,তোমাকে চাই,তোমাকে চাই
এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
ডাইনে ও বাঁয়ে আমি তোমাকে চাই
দেখা না দেখায় আমি তোমাকে চাই
না-বলা কথায় আমি তোমাকে চাই।
শীর্ষেন্দুর কোন নতুন নভেলে
হঠাত্ পড়তে বসা আবোলতাবোলে
অবোধ্য কবিতায় ঠুংরি খেয়ালে
স্লোগানে স্লোগানে ঢাকা দেয়ালে দেয়ালে।
সলিল চৌধুরীর ফেলে আসা গানে
চৌরাশিয়ার বাঁশি মুখরিত প্রাণে
ভুলে যাওয়া হিমাংশু দত্তর সুরে
কোন্ কবেকার অনুরোধের আসরে
তোমাকে চাই,তোমাকে চাই,তোমাকে চাই,তোমাকে চাই
অনুরোধে মিনতিতে তোমাকে চাই
বেদনার আর্তিতে তোমাকে চাই
দাবীদাওয়া চাহিদায় তোমাকে চাই
লজ্জাদ্বিধায় আমি তোমাকে চাই
অধিকার বুঝে নেওয়া প্রখর দাবীতে
সারারাত জেগে আঁকা লড়াকু ছবিতে
ছিপছিপে কবিতার ছন্দে ভাষায়
গদ্যের যুক্তিতে বাঁচার আশায়
শ্রেণীহীন সমাজের চির বাসনায়
দিনবদলের খিদে ভরা চেতনায়
দ্বিধাদ্বন্দের দিন ঘোচার স্বপ্নে
সাম্যবাদের গান ঘুমে জাগরণে
বিক্ষোভে বিপ্লবে তোমাকে চাই
ভীষণ অসম্ভবে তোমাকে চাই
শান্তি অশান্তিতে তোমাকে চাই
এই বিভ্রান্তিতে তোমাকে চাই।
কবির সুমনের ‘তোমাকে চাই’ গান :