এক.
“একটা গণজাগরণের সঙ্গে আসলেই একটা গণমাধ্যমও খুব দরকার। দল দাস আর কর্পোরেট দাস গণমাধ্যম এখন শুধুই প্রচার মাধ্যম।”
গতকাল একজন গণমাধ্যমকর্মী তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে উপরের কথাগুলো লিখেছেন। সঙ্গে একটি ছবি দিয়েছেন, যেখানে দেখা যায় ১০/১২ বছর বয়সী শিশুরা ফেস্টুন হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তাতে অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে এটাও লেখা যে- “একটা গণজাগরণ চাই, একটা গণমাধ্যম চাই।”
উল্লেখিত দাবী নিয়ে এই সময়ে বাংলাদেশে গণভোট হলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ৯৯ শতাংশ ভোট এই দাবীর পক্ষে যাবে। শুধু এক শতাংশ মানুষ যারা শক্তিশালী গণমাধ্যমের সহায়তায় দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষের অধিকারকে ছল-চাতুরির আশ্রয় নিয়ে দাবিয়ে রেখেছে তারাই শুধুমাত্র এই দাবীর বিপক্ষে ভোট দেবে।
দুই.
দাবী-দাওয়া নিয়ে শিশু কিশোরদের এই ছবিটি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে নিজের কৈশোরে। যখন এই শিশুদের মতো আমরাও বিভিন্ন দাবী নিয়ে ফেস্টুন, ব্যানার হাতে মানববন্ধন ও র্যালী করতাম। আমাদের সময়ে স্কুলগামী শিশু, কিশোর-কিশোরীরা বিভিন্ন শিশু সংগঠন ও পাঠাগারের সঙ্গে যুক্ত ছিল। স্কুলে যেমন প্যারেড পিটি হতো, তেমনি শিশু সংগঠনেও শরীর চর্চা হতো, গান-বাজনা হতো, বইপড়া হতো এবং বিস্তর আলাপ-আলোচনা ও আড্ডা হতো। বার্ষিক সম্মেলন হতো। বিশেষ দিবসগুলোতে র্যালী ও আলোচনা অনুষ্ঠান হতো। সকল আয়োজনের মধ্যেই এক ধরনের শিক্ষা ছিল। সেই শিক্ষার মূল বক্তব্য ছিল- আমাদেরকে মানুষ হতে হবে।
আমাদের দাবী দাওয়ার মধ্যে ছিল- শিক্ষা উপকরণের দাম কমাতে হবে। স্কুলের বেতন বাড়ানো চলবে না। শিশু পার্ক চাই। শিশুদের জন্য আলাদা খেলার মাঠ চাই। ইত্যাদি। অর্থাৎ আমাদের দাবী দাওয়া যা কিছু সবকিছুই ছিল আমাদের মানে শিশুকেন্দ্রিক। শিশুদের অধিকার কেন্দ্রিক। সকল শিশুদের জন্য যা প্রযোজ্য। সেই শিশুরা একটি এলাকার হতে পারে কিংবা সারা বাংলাদেশের হতে পারে।
আমাদের সময়ে শিশুরা কোন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়নি। আমাদের গুরুজনেরা যারা আমাদের শিশু সংগঠনগুলোর উপদেষ্টা ছিলেন তারা এ ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। তারা আমাদেরকে এমনভাবে গাইড করেছেন যে, আমাদের মধ্যে দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম পুরোমাত্রাতেই বিকশিত হয়েছে কিন্তু সেজন্য আমাদেরকে সহিংসতা ও “বড়দের এজেন্ডা” বাস্তবায়নের হাতিয়ারে পরিণত হতে হয়নি। তারা আমাদের মধ্যে কখনো লোভ ঢুকিয়ে দেননি। বরং আমাদের মধ্যে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করা ও সবাই মিলেমিশে থাকার বাণী ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন।
আজকাল বিদ্যালয়ের চারপাশের আগাছা পরিস্কার করা কিংবা রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া কিংবা পুকুরের কচুরিপানা পরিস্কার করার যে ছবি বড় বড় করে পত্রিকায় ছাপানো হয় সেগুলো আমাদের ছোট বেলায় নিত্য নৈমিত্তিক ও সাধারণ কাজ ছিল। এগুলো যে প্রচার প্রচারণার বিষয় সেটা আমরা বুঝতে পারিনি। আমাদের সময়ে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান ও বার্ষিক সম্মেলন আয়োজন করার জন্য পাড়া মহল্লার গুরুজন, ছোট বড় ব্যবসায়ী, মফস্বলে হাটবারের দোকানদার, পথচারীদের কাছ থেকে চার আনা আট আনা কিংবা এক, দুই টাকা চাঁদা উঠানো হতো। সেই চাঁদা উঠানোর টাকার সঙ্গে আমাদের স্বেচ্ছাশ্রম থাকতো অনুষ্ঠান সফল করার জন্য। একটি পয়সাও আমরা অপচয় করতাম না। অর্থ আত্মসাতের কোন ঘটনাও তখন ঘটতো না। অর্থাৎ আমাদের সময়কার স্কুলে ও বাড়িতে এবং শিশু সংগঠনে মূলত শ্রদ্ধা, দায়িত্বশীলতা, সংবেদনশীলতা, সততা, যত্ন নেওয়া এবং মিলেমিশে থাকা শেখানো হয়েছে। যেকোন পরিস্থিতিতে ইতিবাচক চিন্তা করতে শেখানো হয়েছে।
তিন.
আলোচ্য ছবিটিতে শিশুদের দিয়ে মূল যে দাবীটি সামনে নিয়ে আসা হয়েছে সেটি মূলত “বড়দের এজেন্ডা”। “দাবী শুধু একটাই তনু হত্যার বিচার চাই”- এটি বড়দের এজেন্ডা। লক্ষ্য করে দেখুন শিশুদের হাতের ফেস্টুনে লেখা আছে- “একটা গণজাগরণ চাই, একটা গণমাধ্যম চাই, একটা গণশ্লোগান চাই, দাবী শুধু একটাই তনু হত্যার বিচার চাই।”
আমাদের সময়ের সঙ্গে এই সময়কার শিশুদের দাবী দাওয়ার পার্থক্য এখানেই দেখতে পাই। আমাদের সময় হলে কী হতো? আমরা লিখতাম “একটা গণজাগরণ চাই, একটা গণমাধ্যম চাই”। তারপর লিখতাম- “সকল ধরনের শিশু নির্যাতন বন্ধ কর, করতে হবে”; “শিশু নির্যাতনকারীদের বিচার চাই, করতে হবে”; “শিশু নির্যাতনকারীরা সমাজের ও দেশের শত্রু”; “আমাদেরকে বাঁচান, কারণ আমরাই দেশের ভবিষ্যত্”; ইত্যাদি।
আমরা ইস্যু নিয়ে কথা বলতাম, সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে নিয়ে নয়। বলতে দ্বিধা নেই আমাদের সময়ে সকল প্রতিকূলতার মধ্যেও আমাদের গুরুজনেরা আমাদেরকে যে শিক্ষা দিতে পেরেছিলেন, আমরা এই সময়ে আমাদের সমাজের শিশুদের সেই শিক্ষায় আলোকিত করতে পারছি না। হয় আমাদের সময়ের চেয়ে এখন প্রতিকূলতা বেড়েছে অথবা আমাদের সময়ে বড়দের মধ্যে খারাপ লোকের সংখ্যা কম ছিল, এখন তারা সংখ্যায় বেড়েছে। তবে আমার কেন যেন মনে হয় সমাজ ও দেশে খারাপ লোকের সংখ্যা বাড়েনি, যা হয়েছে তা হলো খারাপ লোকেরা ক্ষমতা ও অর্থ বিত্তে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূল স্তম্ভেই তাদের কর্তৃত্ব ও উপস্থিতি বেড়েছে। ফলে, নিরীহ ও ভালো মানুষেরা সংখ্যায় বেশি হলেও অল্প মানুষের শক্তি ও দাপটে তারা মিইয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। খারাপ মানুষেরা সমাজকে সফলভাবে বিভক্ত করতে পেরেছে। আমাদের সময়ে সমাজ এভাবে বিভক্ত ছিলো না। ফলে এখনকার খারাপ মানুষেরা নিজেদের স্বার্থ ও ইচ্ছা পূরণে যা খুশি তাই করতে পারছে। রাষ্ট্রশক্তি অনেকসময় তাদেরকে সাহস পর্যন্ত জোগাচ্ছে।
চার.
এরকম একটি প্রতিকূল সময়ে যখন দেখতে পাই শিশু কিশোররা বলছে- একটি গণজাগরণ চাই, একটা গণমাধ্যম চাই; তখন খুব বেশি একাত্মতা বোধ করি।
আমাদের সময়ে শিশু নির্যাতন, শিশু হত্যা কিংবা ঈভ টিজিংয়ের মতো বিষয়গুলো এতোটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেনি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শুধু নিপীড়ন নির্যাতনই নয়, সামান্য কারণে শিশু হত্যা একটি নিত্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে, পুকুর থেকে মাছ ধরার অভিযোগে কিংবা ক্যাশবাক্স থেকে দশ টাকা চুরির অভিযোগে পিটিয়ে শিশুকে মারার ঘটনা হরহামেশা ঘটছে। তাছাড়া বড়দের ঝগড়াবিবাদের জের ধরেও অনেক শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে। কোন কোন ঘটনা সিনেমাকেও হার মানায়। যেমন, চার শিশুকে মেরে বালু চাপা দিয়ে রাখা।
এক পরিসংখ্যান মতে, গত বছরে দেশে ১,২০০ এর বেশি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে আরো বহুগুণে বেশি। এসকল ঘটনার বেশিরভাগের কোন বিচার হয়নি। ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে অপরাধের মাত্রা ও সংখ্যা বেড়েই চলছে, যার দায়ভার মূলত রাষ্ট্রের উপরই বর্তায়। আমাদের গণমাধ্যমের শিশু নির্যাতনের ঘটনায় যে ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত ছিল সেটি তারা করতে পারেননি।
আমার বলতে দ্বিধা নেই যে, আমাদের শৈশব ও কৈশোরে এতো টেলিভিশন চ্যানেল ও পত্রপত্রিকা ছিলো না। তবে তখনকার দিনে গণমাধ্যম যতোটুকু ছিলো সেগুলো অনেকবেশি শিশু বান্ধব ও জনগণবান্ধব ছিল। সেই সব গণমাধ্যমের কর্মীরা শিশুদের কণ্ঠস্বর শুনতে পেতো এবং তাদের হয়ে কথাও বলতো। এখনকারমতো সেগুলো “দলদাস আর কর্পোরেটদাস” ছিলো না।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী শিশু আইন ২০১৩ এর এক সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনায় মন্তব্য করেছেন- “মা-বাবা, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতার কারণে শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে। শিশু বিচার ব্যবস্থা ও এই ব্যবস্থার অধীন পক্ষগুলো যদি আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেটা হবে শিশুদের অধিকার রক্ষায় এবং তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের ব্যর্থতা।”
অন্যতম বিশ্বনেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, “একটি সমাজের ভেতরটা চেনার সবচেয়ে বড় উপায় হলো শিশুদের সঙ্গে সমাজের আচরণ কেমন সেটা জানা।”
ষোল কোটি মানুষের বাংলাদেশে এখন প্রায় ৭ কোটি শিশু, যা ১৯৭১ সালের দেশ স্বাধীন হওয়ার সময়কার জনসংখ্যার সমান। আমি আলোচ্য ছবির শিশুদের সাত কোটি শিশুর প্রতিনিধি হিসেবে দেখছি। আমি এই লেখার শেষ প্রান্তে এসে তাদের সেই দাবী- একটি গণজাগরণ চাই, একটি গণমাধ্যম চাই”-এর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি। একই সঙ্গে তনু হত্যার বিচারের “একমাত্র দাবী”-র সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি। বরং সকল ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চাচ্ছি। সেসঙ্গে শিশুদের সত্যিকারের নাগরিক হয়ে উঠার ক্ষেত্রে যতো বাধা বিপত্তি তৈরি করে রাখা হয়েছে সেই সকল বাধা বিপত্তির অপসারণে একটি গণজাগরণ দেখতে চাই। সেখানে গণমাধ্যমের সক্রিয় অংশগ্রহণ চাই।
যেমন, কোন এক আমলার “খায়েশের ফল” পিএসসি পরীক্ষা বন্ধে গণমাধ্যমের অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন চাই, প্রতিটি বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ চাই, প্রাইমারি স্কুলে ভালো শিক্ষক নিয়োগ চাই, টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ হোক চাই, দেশের প্রতিটি শিশু প্রতিদিন এক গ্লাস দুধ ও একটি ডিম খাবে সেটা চাই, যেকোন ধরনের শিশু নির্যাতন বন্ধ হোক চাই, শিশু নির্যাতনকারীদের বিচার চাই, বখাটেদের উৎপাতের কারণে শিশুদের বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের লেখাপড়া বন্ধ করা ও বাল্য বিবাহ দেওয়ার অবসান চাই।
শিশুদের অধিকার সংক্রান্ত এই তালিকা খুব বড় নয়। ছোট এই তালিকার সমস্যাগুলো সমাধান জরুরি। এজন্য শিশু বান্ধব গণমাধ্যম চাই। আমাদের মনে রাখতে হবে- আজকের শিশুই আগামীর বাংলাদেশ।
সবশেষে যার স্টাটাস পড়ে এই লেখার অবতারণা সেই গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গে ফেসবুকের মেসেজের আলাপচারিতায় একটি অংশ উল্লেখ করছি; তিনি বলেছেন- “এতো স্পষ্ট ভাবে আমি কাউকে বলতে শুনিনি যে আমাদের গণমাধ্যম দরকার। আমি জানি, এটা শিশুরা নিজ থেকে বলেনি। কিন্তু, আসলেই গণমাধ্যম কই! সবই তো প্রচার মাধ্যম।”
এই লেখার মাধ্যমে আমার একটাই প্রার্থনা “দলদাস আর কর্পোরেটদাস”-এর বাইরে মানবিকবোধসম্পন্ন ও ৩০ লাখ শহীদের রক্তের ঋণ শোধে আগ্রহী বিত্তবান ব্যক্তিরা গণমাধ্যম- রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র প্রকাশে এগিয়ে আসুন। আপনাদের পাশে নিশ্চয়ই এই দেশের ১৬ কোটি পাঠক ও দর্শক দাড়াবে। আর এভাবেই আমাদের সন্তানদের একটি সুস্থ ও সুন্দর বাংলাদেশ উপহার দেওয়া সম্ভব হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)