‘জন্মিলে মরিতে হবে রে জানে তো সবাই/তবু মরণে মরণে অনেক ফারাক আছে ভাই রে/ সব মরণ নয় সমান।’ বিশ্বনন্দিত এনজিও ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের মহাপ্রয়াণের পর এই গানটির কথা খুব মনে পড়ছে। স্যার আবেদের জীবনবোধের মূল কথাই ছিল পরাজয় স্বীকার না করা। তবে এবার পরাজিত হতেই হল। গত ২০ ডিসেম্বর বিজয়ের মাসে মৃত্যুর সঙ্গে প্রায় মাসাধিক কালের লড়াইয়ে তিনি হার মানেন।
ব্র্যাক পরিবারে তিনি ‘আবেদ ভাই’ হিসেবে পরিচিত। ফজলে হাসান আবেদ এখন শুধু একজন ব্যক্তি নন, দেশ-বিদেশে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপরিচিত। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে দারিদ্র্য বিমোচন তথা দরিদ্রের ক্ষমতায়নে ভূমিকার জন্য আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। স্যার ফজলে হাসান আবেদ ছিলেন একজন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। তিনি তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য ব্র্যাকের মতো একটি প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। তিনি শুধু ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেননি, এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থায় পরিণত করতে নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। এই প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তিনি তার স্বপ্নকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে যেমন কাজ করেছেন, তেমনি গড়ে তুলেছেন ব্র্যাক ব্যাংক, বিকাশ ও আড়ংয়ের মতো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান।
তিনি সারাজীবন গরীব ও পিছিয়ে পড়া মানুষের কল্যাণে নিজের মতো করে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। তিনি ধাপে ধাপে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন নতুন নেতৃত্বের হাতে। বাংলাদেশে এ এক অনন্য নজির।
স্যার ফজলে হাসান আবেদের স্বপ্ন ছিল দেশে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা করা। এ ব্যাপারে তার স্বপ্নভঙ্গের বেদনাও ছিল। বিভিন্ন বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকারে তিনি সে কথা অনেকবার বলেছেন। জেন্ডার সাম্য বিষয়ে তিনি আক্ষেপ নিয়ে বলেছেন, ‘আমি আমার জীবনকালে হয়তো এটা দেখে যেতে পারব না। সম্ভবত এটি আমার জীবনের অসমাপ্ত এজেন্ডা হিসেবে থেকে যাবে। আমি অত্যন্ত দুঃখ বোধ করি, যখন দেখি আজও নারীর ওপর পীড়ন ও নির্যাতনের অবসান হয়নি। এখন পর্যন্ত নারীরা পুরুষের তুলনায় কম মজুরির বিনিময়ে বেশি কাজ করেন এবং এখনো কিছু নির্দিষ্ট পেশা ও কার্যক্রম থেকে পদ্ধতিগতভাবে তাদের দূরে সরিয়ে রাখা হয়। এখনো দেশে বহু মেয়ের বাল্যবিবাহ হয় এবং তাদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়। অথচ সমাজের উন্নয়ন ও পারিবারিক সুখ–শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নারী-পুরুষের সমতা অত্যন্ত প্রয়োজন। তবে আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দেশ অবশ্যই নারী-পুরুষ সমতার দিকে দ্রুত অগ্রসর হবে এবং সমাজ প্রগতির পথে আমাদের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে।’
তিনি মনে করতেন, জেন্ডারের মূল কথা হচ্ছে সুসম্পর্ক। নারী-পুরুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধা। একে অন্যের প্রতি সহানুভূতি, সমানুভূতি। পরিবারের সবাই সবাই যদি একে অন্যকে শ্রদ্ধা করে, একে অন্যের কাজ ও ভূমিকাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে, একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করে তবে পরিবারে জেন্ডার সমতা অর্জন সম্ভব হবে।
তার মতে, জেন্ডারের মূল ভিত্তি হচ্ছে, ন্যায় এবং সাম্য। নারী বা পুরুষ হিসেবে কেউ বেশি সুযোগ বা কম সুযোগ পাবে না। সবাই নিজ নিজ সামর্থ্য বিকাশের সুযোগ পাবে। একে অপরের সহযোগী হবে। সংবেদনশীল হবে। কেউ পিছে থাকবে না। কেউ এগিয়ে যাবে না। সাম্য ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে সবাই মিলে এক সঙ্গে এগিয়ে চলবে।
স্যার আবেদ বলতেন, জেন্ডারের আলোচনা কেবল ব্র্যাকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটা সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সব দেশের, সব মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জেন্ডার সংবেদনশীল না হলে পরিবারে সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
মাত্র কিছুদিন আগেও লেখকের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি জেন্ডার সাম্য নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। তার মতে, জেন্ডার সাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গোটা বিশ্বই অনেক দূর এগিয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পৃথিবীর বহু দেশে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা ও আইন-কানুনের সংস্কার করা হয়েছে। আমাদেরও এখন আইনি কাঠামো পরিবর্তনের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে অনেক ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের মনমানসিকতা বদলাতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আইন, যেমন পারিবারিক আইন, উত্তরাধিকার আইন ইত্যাদির সংস্কার আনতে হবে। এ জন্য সংসদ সদস্যদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতে হবে। তাদের দিয়ে সংসদে বিল আনতে হবে।
বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা দরকার। এ ক্ষেত্রে সন্তানের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে। তার ভরণপোষণ ও প্রতিপালনের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে আইন প্রণয়নের আগে আইন তৈরির পক্ষে সামাজিক চাহিদা বা জনমত সৃষ্টির কাজটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এসডিজি ৫-এ জেন্ডার সমতার কথা বলা আছে। এসডিজি অর্জন করতে হলে আমাদের নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে। নারীদের কাজের সুযোগ যেমন বাড়াতে হবে, পাশাপাশি নারীর ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য দূর না করতে পারলে আমাদের পক্ষে এসডিজি অর্জন কঠিন পড়বে। এ জন্য নারীর দক্ষতা যেমন বাড়াতে হবে, একই সঙ্গে উপযুক্ত কর্মপরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য গার্মেন্টস মালিক-শ্রমিদের নিয়ে আমাদের কাজ করা দরকার।
বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। এই অবস্থাকে আরও উন্নত করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের জন্য প্রধান বাধা হচ্ছে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা। সংহিংসতার বিরুদ্ধে আমাদের আরও ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে।
সবার আগে আইনি ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার। নারী নির্যাতন করে কেউ যেন রেহাই না পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা এবং শাস্তি কার্যকর করার উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। অপরাধীরা যেন কোনোভাবেই দায়মুক্তি না পায়-তা নিশ্চিত করতে হবে।
গণপরিবহনে নারীদের হয়রানির ঘটনা রুখতে হবে। এ জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো দরকার। কোন ধরনের আচরণগুলো নারী নির্যাতন, তা সবাইকে বোঝাতে হবে। নারী নির্যাতন যে অত্যন্ত খারাপ, এটা একটা অপরাধ-এই প্রচারণাটা ব্যাপকভাবে চালাতে হবে।
যৌন হয়রানির কারণে অনেক মেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক। এ ব্যাপারে আমাদের কাজ করতে হবে। মেয়েদের কাউন্সিলিং করতে হবে। ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের বোঝাতে হবে। তাদের সাহস যোগাতে হবে। আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে।
প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে কীভাবে নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোর প্রতিকার করা যায়, সেটাও বিবেচনা করে দেখতে হবে। ৯৯৯-এর মতো হটলাইনকে আরও কার্যকর করতে হবে। যৌন হয়রানি বা নারী নির্যাতনের ঘটনা প্রতিকারে একটা ভ্রাম্যমান টিম গঠন করা যায় কিনা সেটাও ভেবে দেখা যেতে পারে। কোনো ফোন নম্বর বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নারী নির্যাতনের ঘটনা জানালে সেই ভ্রাম্যমাণ টিম সরাসরি ঘটনাস্থলে গিয়ে অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
মেয়েদের দক্ষতা বাড়িয়ে বৈদেশিক শ্রমবাজারে পাঠানোর ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। তবে মধ্যপ্রাচ্যে নারীকর্মীদের পাঠানোর ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। প্রয়োজন হলে মধ্যপ্রাচ্যে নারীকর্মী পাঠানো বন্ধ করতে হবে।
জেন্ডার সমতা অর্জনের জন্য ব্যাপক জনমত গঠন করা দরকার। সরকারকে এ ব্যাপারে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপআলোচনা করতে হবে। আমরা যদি একে অপরের প্রতি সমব্যথী হই, মানবিক হই, কোনো ধরনের বৈষম্য না করি, সংবেদনশীল হই, আমাদের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলাই তাহলেই আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত সমাজ নির্মাণ করতে পারব।
শুধু জেন্ডার সাম্য প্রতিষ্ঠাই নয়, সব মানুষের জন্য একটি মানবিক সমাজ নির্মাণের স্বপ্নও তিনি প্রতিনিয়ত বুনেছেন। বিনয়ী, মিতভাষী, অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন, শিল্প ও সাহিত্য অনুরাগী এবং কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সাহেব থেকে দরিদ্রের সেবক হয়ে ওঠা স্যার ফজলে হাসান আবেদের জীবন সত্যিকার অর্থেই ছিল আলোকময়। তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। নিজে যে স্বপ্ন দেখেছেন, অন্যদেরকেও সেই স্বপ্ন দেখতে উজ্জীবিত করেছেন।
মৃত্যু তার নশ্বর দেহকে থামিয়ে দিলেও স্বপ্ন ও কাজকে থামিয়ে দিতে পারেনি। তাঁর স্বপ্ন-যাত্রায় শরিক হতে আজ লাখ লাখ কর্মী শপথ উচ্চারণ করছেন।
পরিশেষে মহীরুহে পরিণত হওয়া জাতির এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। রবিঠাকুরের ভাষায়: ‘ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়, তোমারি হউক জয়!’
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)