ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯০ সালে। এরপর বুড়িগঙ্গায় অনেক জল গড়িয়েছে, যেটুকু জল আছে সেটুকুও আরও অনেক বেশি দূষিত হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের কত না পালাবদল হয়েছে। কিন্তু ডাকসু আর হয়নি। দীর্ঘ ২৮ বছর পর আবার আকস্মিক ডাকসু নির্বাচনের দামামা বেজে উঠেছে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে ডাকসু নির্বাচন।
১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ, অর্থাৎ যে অধ্যাদেশের মাধ্যমে পরিচালিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তাতে বলা আছে প্রতিবছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মোট সাতবার অনুষ্ঠিত হয়েছে ডাকসু নির্বাচন। স্বৈরশাসক এরশাদকে হঠানোর পর গণতান্ত্রিক দাবিদার সরকারগুলো ক্ষমতাসীন হয়েছে এবং ক্ষমতায় আছে। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনের ব্যাপারে কারও কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। অবশেষে আদালতের একটি রায়ের সূত্র ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডাকসু নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে।
কিন্তু ভাবুক মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ‘এই ডাকসু লইয়া আমরা কি করিব’? এতদিন তো আমরা ডাকসু ছাড়াই চলেছি, তাতে কী এমন ক্ষতি হয়েছে? আর যখন ডাকসু ছিল, তখনই বা আমাদের কী এমন উপকার হয়েছে?
গত তিন দশক ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কাছ থেকে দেখছি। যেখানে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের মধ্যে হানাহানি, মারামারি, হিংসা, গোলাগুলি, রক্তপাত, হলদখল, চাঁদাবাজি, ফাউ খাওয়া, ক্ষমতাধর ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের দ্বারা নিরীহ শিক্ষার্থীদের মিছিল-মিটিংসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগদানে বাধ্য করা, আধিপত্য কায়েম ছাড়া অন্য কিছু তেমন দেখিনি। আগে তবু বিভিন্ন হলে নানা মতাদর্শে বিশ্বাসী ছাত্র সংগঠনগুলোর এক ধরনের প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সও ছিল। তখন সমর্থন হারানোর ভয়ে ক্ষমতাধর ছাত্র সংগঠনগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর খুব বেশি-জুলুম নির্যাতন চালানোর সাহস পেত না।
গত দেড় দশকে যে পরিবর্তনটা হয়েছে, তা হলো ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক ছাত্র সংগঠনের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য দলগুলোর তেমন কোনো তৎপরতা নেই। সেই সুযোগ দেওয়া হয় না। মেরে-কেটে-পিটিয়ে-তাড়িয়ে সবাইকে হল-দল এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া করা হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন একটা ডাকসু নির্বাচন মানে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের বিজয়-উৎসব মঞ্চায়ন। এর বাইরে ভিন্ন কিছু হওয়ার সুযোগ নেই। তেমন কিছু হতে দেওয়া হবে বলেও মনে হয় না। ক্ষমতাসীনরা কীভাবে নির্বাচনে জিততে হয়, সে কৌশল শিখে গেছে। এখন তাদের হারায় কার বাবার সাধ্য?
ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন নির্বাচনে জিতবে বলে আমি ডাকসু নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করছি না। যথাযথ নির্বাচনের মাধ্যমে যে খুশি সে বিজয়ী হোক, তাতে আমার কেন, কারোই কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু তেমন সম্ভাবনা নেই বলেই যত খেদ। আর প্রশ্ন শুধু ডাকসু নিয়েই নয়, প্রশ্নটা ছাত্র রাজনীতি নিয়েই। ছাত্র রাজনীতির কি আদৌ কোনও প্রয়োজন রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে?
জানি এ প্রশ্নে অনেকেই আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন। বলবেন, গোটা বিশ্ব সাক্ষী, পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দেওয়া নানা আলোড়ন ছাত্রদের হাত ধরেই শুরু হয়েছে নানা সময়ে। আমাদের দেশেও অনেকে বায়ান্ন, ঊনসত্তর, নব্বইয়ের কথা পাড়বেন। অতএব, ছাত্রদের রাজনীতি করার প্রবণতায় অপকর্ষ খোঁজা উচিত নয়-এই সিদ্ধান্ত টানবেন। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির সাম্প্রতিক ছবিটা এ দেশে ক্রমশ যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা ভয়ানক কুৎসিত, কদাকার। ছাত্র রাজনীতির নামে যা হচ্ছে এটা পুরোটাই অপকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির নামে যা চলছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা আসলে তাণ্ডব, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতার নামান্তর। ছাত্র রাজনীতির এতখানি গুণগত অধঃপতন এ দেশে আগে কখনও দেখা যায়নি। অভূতপূর্ব নিম্নগামিতার সাধনা শুরু হয়েছে যেন। এ পরিস্থিতিতে অতীতের ‘দোহাই টেনে’ ডাকসু নির্বাচনের তেমন কোনো সুফল অন্তত আমার চোখে পড়ছে না।
ছোটবেলায় দেখেছি, রাস্তাঘাটে মারামারি, টিজিংসহ সকল ধরনের অন্যায় কাজের সঙ্গে যারা যুক্ত থাকত তারা লেখাপড়ায় খারাপ ছিল। পরিবারের বড়রা, এলাকার মুরুব্বিরা এদের দেখলেই বলে দিত “পড়াশুনো তো নাই, শুধু আকাম কুকাম করে, আর টই টই করে ঘুরে বেড়ায়।” এরাই থানা, ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত রাজনীতি করত। মিছিলের আগে, ক্লাসে লাস্ট বেঞ্চে থাকত। পক্ষান্তরে ভালো ছাত্র মানেই, সব দিক দিয়েই ভালো। কোনো মারামারি ঝগড়াঝাঁটি কিছু নেই। সবার চোখেই তারা ভালো!
সেই ভালোদের বিশ্ববিদ্যালয় এখন আর ভালো নেই। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। অথচ এখানে কেবল যারা ভালো ছাত্র বা ছাত্রী তারাই প্রতিযোগিতা করে, ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে পাস করে, হাজার হাজার জনকে পেছনে ফেলে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করে। অর্থাৎ, ভালোর মধ্যে যারা ভালো, খুব ভালো, তারাই সুযোগ পায়। তার পরেও এখানকার শিক্ষার্থীরা অপরাধমূলক তৎপরতার সঙ্গে জড়ায় কিভাবে?
এই অপরাধের পেছনে পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক একটা ব্যাপার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বিরাট অবদান রাখা একটি প্রতিষ্ঠান। অথচ গত দুই দশকের পরিসংখ্যান ঘাটলে দেখা যাবে, এই প্রতিষ্ঠানের নেতারা চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা, ধর্ষণ, মাদকসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে না। সিনেমা দেখতে যাবে, টিকেট চাওয়া যাবে না! শপিং করবে, টাকা দেবে না। রেস্টুরেন্টে খাবে, বিল দেবে না। বাসে চড়বে, ভাড়া দেবে না। কারণ ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র’, ‘অমুক’ ছাত্র সংগঠনের নেতা! বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মারামারি, চাঁদাবাজিসহ সব ধরনের ক্রাইমের অনুঘটক হিসাবে কাজ করছে এই ছাত্র রাজনীতি।
রাস্তায় জ্যাম, আমরা ভিভিআইপি, আমরা ইচ্ছেমত ভার্সিটির বাস রঙ সাইড দিয়ে চালিয়ে রোড ব্লক করে দেব। বাকিরা না হয় আরও কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করুক, অ্যাম্বুলেন্সে রোগী মারা যাক। আমাদের বাস আগে যেতেই হবে। পুলিশ ব্যাটার কত সাহস, ‘রাজা’দের বাস রঙ সাইড দিয়ে যেতে দিবে না! কত বড় সাহস, মগের মুল্লুক নাকি? কইরে পাইক, পেয়াদা। এই ব্যাটারে শায়েস্তা কর। সাবধান ক্যামেরা এড়িয়ে চলিস। যা দিনকাল। প্রাইভেসি বলে কিছুই রাখল না!
হ্যাঁ, স্বাধীনতার আগে, এমনকি পঁচাত্তরের আগ পর্যন্ত যারা রাজনীতি করত তা ছিলো দেশের জন্য, দেশপ্রেম থেকে অবহেলিত মানুষের জন্য, নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য। ছাত্র রাজনীতি করে টাকা কামাইয়ের ধান্দা কেউ করত না।
বলতে পারেন, বর্তমানে যারা আছে তারা কি দেশ প্রেমিক না? হ্যাঁ, তারাও দেশপ্রেমিক, কিন্তু এরা হলো পুতুলের মতো। তাদের ‘গুরু’রা যদি বলে, যাও অমুককে ঠ্যাঙাও, গাড়ি ভাঙচুর কর, তারা তাই করবে, দেশপ্রেমিক হিসেবেই। কেন? তার কারণ ওদের মগজ নেই। ওরা নগদ নারায়ণে বিশ্বাস করে। ক্ষমতার দাপট আর প্রাপ্তির মোহে ওরা স্রেফ ভাড়াটে গুণ্ডায় পরিণত হয়! ওদের স্বাধীন সত্তা হারিয়ে যায়!
সব বাবা মা-ই চায় তারা ছেলে ভালো পড়াশোনা করে ভালো কিছু করবে, শেষবেলায় অন্তত তাদের পাশে থাকবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ধনীর বা শহরের ছেলেমেয়েদের থেকে মফস্বল, অজো পাড়াগাঁয়ের দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাই বেশি চান্স পায়। তাদের প্রায় কারোরই স্বপ্ন বা ইচ্ছা থাকে না তারা নেতা হবে, রাজনীতি করবে। অনেকের পরিবার এই রাজনীতিকে ভয় পায়, ছেলে খারাপ হয়ে যাবে, পড়াশোনা হবে না মনে করে। সেই ছেলে যখন পড়তে এসে খুন হয় রাজনীতির কারণে-এর দায় কে নিবে?
ছাত্রদের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ, দক্ষতা বৃদ্ধি, সামাজিক সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী ভূমিকা পালন, এসব বিষয়ে কোনো ছাত্র সংগঠনের দৃষ্টান্তমূলক কোনো উদ্যোগ আছে কি? লেখাপড়ার মান বাড়ানো, ভবিষ্যতের সঙ্গে খাপখাওয়ানোর জন্য গবেষণা, সৃজনশীল কর্মকাণ্ড-এসব বাদ দিয়ে কেবল নেতানেত্রীদের নামে স্লোগান, ‘মানি না মানব না’, ‘অমুকের চামড়া তুলে নেব আমরা’-এই রাজনীতি দিয়ে দেশের কোনো কল্যাণ হবে না। আর এমন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের মাথায় ডাকসুর মুকুট তুলে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়েরও কোনো উপকার হবে না।
এমন রাজনীতি বহাল থাকলে ‘‘দশ টাকায় এক কাপ চা, একটি সিঙ্গারা, একটি চপ ও একটা সামুচা পাওয়া যায়; এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব ও ঐতিহ্য” এমন উক্তির পাশাপাশি ‘‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির নামে ফাউ খাওয়া যায় এবং বাড়ি-গাড়ি-টাকা-কড়ি উপার্জন করা যায়’’ এমন কথাও হয়তো অমর হয়ে থাকবে!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)