চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

উবার কি একচেটিয়া কারবার করবে না?

লন্ডনে Tesco নামে একটা বিশাল-ব্যাপক সুপার চেইন স্টোর আছে যেমন ব্যাংককে আছে Seven-Eleven; আমেরিকায় আছে Wallmart। অন্যান্য বড় বড় শহরেও একই রকম চেইন স্টোর রয়েছে। লন্ডন এবং ব্যাংককের পাড়ায় পাড়ায় হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ানোর সময়ে দেখেছি সেখানে টেস্কো বা সেভেন-ইলেভেন বা অন্য কোনো সুপার চেইন স্টোর ছাড়া কোনো মুদি দোকান নেই।

সাধারণ মুদি দোকান নেই বলে সেখানকার বাসিন্দাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হয়নি। স্থানীয় লোকেরা এতে অভ্যস্ত। তারা আসলে ভাবেনও না যে টেস্কো বা সেভেন-ইলেভেন থাকায় তারা কোনো রকম বঞ্চিত হচ্ছেন কি-না; কিংবা সাধারণ মুদি দোকান থাকলে পণ্যের দাম ও মান ভালো পেতেন কি-না।

টেস্কো, সেভেন-ইলেভেন, ওয়ালমার্ট নিশ্চয়ই সভ্যতার শুরু থেকে ওসব শহরে ছিল না। পুঁজির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় পুঁজিপতিরা সুপার চেইন স্টোরের ব্যবসা শুরু করায় আবহমান কাল থেকে চলে আসা মুদি দোকানীরা অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়। বড় পুঁজির শক্তির সঙ্গে হেরে যেতে যেতে দিনে দিনে তারা নিজেদের স্বাধীন ব্যবসা হারিয়ে ফেলে; কর্মহীন হয়ে এই লোকেরাই সুপার চেইন স্টোরের শ্রমিক হিসেবে যোগ দিয়ে নিজেদের রুটি-রুজির বন্দোবস্ত করে। স্বাধীন ব্যবসায়ীরা এভাবেই বড় পুঁজির দাস হয়ে বর্তমান পৃথিবীতে কোনো মতে বেঁচে-বর্তে আছে। ছোট পুঁজিকে বড় পুঁজির গ্রাস করার খেলা চালু হয়েছে এখানেও। রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় KFC, BFC’রা এখানে নতুন রকমের বাজার তৈরি করছে। দেশীয় হাজার রকমের পিঠা, পায়েস, মিষ্টান্ন ছেড়ে স্বচ্ছল পরিবারের লোকেরা মাত্র গুটিকয় পদের আন্তর্জাতিক খাবারের পেছনে হাজার হাজার টাকার বিল দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ বাঙালি খাবারের ঐতিহ্য। কর্মহীন হচ্ছে, আয় কমছে স্থানীয় শ্রমিকদের, রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের।walmart

এই সুপার চেইন স্টোরগুলো এখন আর নিজেদের দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বিশ্বায়নের সুযোগে তারা সারা দুনিয়ায় শত শত শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। ছোট অর্থনীতির দেশও তাদের পুঁজি লোলুপ দৃষ্টির বাইরে নয়। বাংলাদেশ অর্থনীতিতে ভালো করছে, তাদের শ্যেন দৃষ্টি এখন আমাদের স্ক্যান করছে। যেকোনো সময়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় তাদের ঢোল বাজানোর লোকেদের অভাব নেই। সীমাহীন বিশ্বায়নের দোসর সুশীল সমাজ এদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য লাল কার্পেট নিয়ে সর্বদাই এক পা এগিয়ে থাকে। সুশীলদের ঢোলের আওয়াজে বিভ্রান্ত হয় শিক্ষিত-সচেতন মানুষেরাও। বিদেশী বিনিয়োগ, প্রযুক্তি আমাদের দরকার নেই- এমন কথা নিশ্চয়ই বলছি না। বলতে চাই- বিদেশী বিনিয়োগ, প্রযুক্তি ইত্যাদি নেবার সময় বুঝে নিতে হবে যে তা আমাদের আদৌ দরকার আছে কি-না; দরকার থাকলে তা আমাদের জীবনযাত্রার মান কতটুকু বাড়াবে? ধন বৈষম্য বাড়াবে না-তো?

নতুন করে ঢাকা শহরের পরিবহণ ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে ‘উবার’ নামক আন্তর্জাতিক ট্যাক্সি ব্যবসায়ী চক্র। তাদের বিজনেস মডেলটি বেশ সহজ, সাধারণ এবং সামান্য বিনিয়োগে প্রভূত মুনাফা অর্জনের পক্ষে কার্যকর। তারা নিজেরা ট্যাক্সি কিনে বিনিয়োগ করবেন না বরং স্থানীয় ট্যাক্সি চালকদের ট্যাক্সিগুলোকে নিয়ে ব্যবসা করবেন। স্থানীয় ট্যাক্সি মালিকেরা নিজেদের গাড়িগুলো নিয়ে উবারে যোগ দেবেন। এর ফলে যাত্রীরা কি বাড়তি সুবিধা পাবে? যাত্রীরা যে বাড়তি সুবিধা পাবে তা হলফ করে বলতে পারি।

মোবাইল সফটওয়ারের মাধ্যমে স্বল্প সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট ভাড়ায় ট্যাক্সি পাবেন সমাজের বিত্তবানেরা। ভাড়া নিয়ে তাদের অহেতুক দেনদরবার করে সময় এবং মেজাজ নষ্ট করতে হবে না। কিন্তু ভাড়াটা যে অধিক হবে না- এই নিশ্চয়তা কে দিচ্ছে? উবারের ট্যাক্সি ভাড়া কে নির্ধারণ করবে? উবার না-কি সরকার? আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে সরকার বিআরটিএ’র মাধ্যমে ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করবে। বাস্তবে কি তাই হয়? তেলের দাম যে অনুপাতে বাড়ে বা কমে, বাসের ভাড়া সে অনুপাতে বাড়ে বা কমে না। এ অভিজ্ঞতা আমাদের সকলেরই আছে। উবারের ভাড়া নিখুঁতভাবে হিসেব-নিকেশ করে নির্ধারণ হবে এমন আশা করি না। আর তা না হলে যাত্রীগণ উবারের কারণে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে বাধিত থাকিবেন।kfc-bfc

এক বন্ধুর কাছে শুনলাম, নিউইয়র্কে উবার চালু হওয়ার পর অনেক অনেক ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ি উবারে নাম লিখিয়ে ট্যাক্সি হয়ে গিয়েছে। পত্রিকার খবরে জানা গেল, ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য রেজিস্ট্রেশন করা গাড়িকে উবারে যোগ না দেয়ার আহবান জানিয়েছে বিআরটিএ। বিআরটিএ’র আহবানে কি ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য রেজিস্ট্রেশন পাওয়া গাড়ি উবারে যোগ দেয়া থেকে বিরত থাকবে? মনে হয় না। বর্তমানে যত রেন্ট-এ-কার চলে তার বেশিরভাগের বাণিজ্যিক রেজিস্ট্রেশন নেই; নেই কোনো শাস্তির ব্যবস্থা। উবার দেশের আইন মেনে চলবে এমন সম্ভাবনা শুরুতেই নাকচ করে দিয়েছে বিআরটিএ’র অনুমতি না নিয়ে ব্যবসা শুরু করে।

উবারকে ব্যবসা সফল হতে হলে বর্তমানে ঢাকায় যত ট্যাক্সি আছে শুধু তাদেরকে দিয়ে চলবে না। আরও অনেক বেশি ট্যাক্সি দরকার হবে। মানে, এই অসম্ভব ট্রাফিক জ্যামের শহরে বিভিন্ন উপায়ে আরও কয়েক হাজার গাড়ি যোগ হবে; বেড়ে যাবে জ্যামের তীব্রতা। উবার উন্নত নেটওয়ার্কিং দিয়ে যেটুকু সুবিধা দিতে পারবে তা উবে যা বাড়তি ট্রাফিক জ্যামে। এই শহরে অধিক ট্যাক্সি নয় দরকার বড় বড় বাস, ট্রেন।

নগরের বাসগুলোকে কয়েকটা বড় কোম্পানির মধ্যে নিয়ে আসার একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঢাকার মেয়রগণ। তাদের এই উদ্যোগ পরিবহণ সমস্যা সমাধানে এবং একই সঙ্গে ট্রাফিক জ্যাম ও দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। ব্যক্তিগত জরুরি প্রয়োজনে এবং অসুস্থ মানুষদের চলাচলের জন্য কিছু ট্যাক্সি এবং স্কুটার দরকার। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক এবং ট্রাফিক জ্যাম বিবেচনা করে ট্যাক্সির চেয়ে সুশৃঙ্খল স্কুটার চলাচলের দিকে বেশি মনোযোগী হওয়া উচিৎ।uber2

উবারের ট্যাক্সি ব্যবসায় কি বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভালো কিছু হবে? বিআরটিএ থেকে লাইসেন্স না নিয়ে উবার ব্যবসা শুরু করে দিয়ে এই মেসেজ দিয়েছে যে তারা বাংলাদেশের আইনকানুনকে থোড়াই কেয়ার করে। তারা জানে ক্ষমতাসীনদের পকেটে কিছু গুঁজে দিলেই হবে। স্থানীয় ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং ছোট ছোট ট্যাক্সি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো উবার নির্ধারিত নিয়মকানুনে, ভাড়ায় ট্যাক্সি চালিয়ে দিনে দিনে উবারের দাসে পরিণত হবেন। দীর্ঘ মেয়াদে দেখা যাবে ট্যাক্সি চালকদের প্রকৃত আয় কমে গেছে। পক্ষান্তরে, উবার বাংলাদেশে ট্যাক্সি ব্যবসায় একচেটিয়া কারবার সৃষ্টি করে ট্যাক্সি ভাড়ার উপর, ট্যাক্সি আমদানি করের উপর, সর্বোপরি ট্যাক্সি পরিচালনার নিয়মনীতি। আইনকানুনের উপর প্রভূত আধিপত্য বিস্তার করবে; যাত্রীরা তাদের মর্জির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। দুর্নীতিগ্রস্থ এই দেশে বিআরটিএ নয় গণপরিবহনের একটা বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করবে উবার।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)