সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নির্বাচন এবং এই নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে স্বাভাবিক নিয়মে এ সংক্রান্ত ছোট বড় যেকোন খবরে চোখ আটকে যায়। এটা স্বীকার করতে হবে যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য স্বাভাবিকভাবে একটি রাজনৈতিক পদ হয়ে থাকে, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদটি জাতীয় পর্যায়ে যতটা গুরুত্ব বহন করে এবং আলোচনার দাবি রাখে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ঠিক অতটা নয়।
যদিও উপাচার্য পদটি রাষ্ট্রপতি অনুমোদন করেন তার আগে সিনেট থেকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে একটি তালিকা প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয়। কিন্তু ব্যতিক্রম কেবল এবারের নির্বাচনেই ঘটল। এবার অভিযোগ উঠেছে নানা অনিয়মের। শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের নির্দেশে আপাতত স্থগিত রয়েছে পুরো প্রক্রিয়াটি। এবারের উপাচার্য প্যানেলে যে তিনজনের নাম এসেছে তার মধ্যে গত ৮ বছরের অধিক সময় ধরে একই পদে থাকা আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নামও আছে। বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাসে এত দীর্ঘ সময় একই পদে থাকা আর কোন উপাচার্যের ইতিহাস পাওয়া যায় না।
আরেফিন স্যারের একটি সাক্ষাতকার পড়ছিলাম একটি অনলাইনে। সেখানে অনেক প্রশ্নের মাঝে একটি প্রশ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং নিয়ে। প্রশ্নটি ছিল এমন যে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোন র্যাঙ্কিংয়ে কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম একদম তলানীতে? স্যারের উত্তরটি পড়ে মনে কষ্ট পেয়েছিলাম। স্যারের কথা অনুযায়ী র্যাঙ্কিংয়ের বিষয়টি বাণিজ্যিক কার্যক্রম!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অনেক সময় এই র্যাঙ্কিংয়ের সার্বিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকা সম্ভব হয় না। এজন্য আন্তর্জাতিক পরিসরে যে ধরনের বিজ্ঞাপন দেয়া প্রয়োজন, যে ধরনের অংশগ্রহণ দরকার সেগুলো করা সম্ভব হয় না। একইসঙ্গে তিনি আবার বলছেন, সম্প্রতি তাদের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কেননা অনেক কর্তৃপক্ষ ঢাবির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে না বা প্রয়োজনীয় ডেটা না নিয়ে তারা ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এবং ইন্টারনেটে ঢাবির সব তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না বলে ইন্টারনেট ভিত্তিক জরিপ হয় বলে ঢাবি পিছিয়ে থাকে।
অথচ স্যার বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার একজন অন্যতম অংশীদার। ইন্টারনেটের সর্বোচ্চ ব্যবহার ছাড়া কেমন করে ডিজিটাল ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করা যায় তা আমার জানা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যে ডেডিকেটেড ব্যান্ডউইথ দেয়া আছে, হলে হলে যে ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিতের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সেগুলো তাহলে কোন কাজে?
এছাড়া স্যারের আরেকটি যুক্তি দেখে হতাশ না হয়ে পারলাম না। স্যারের কথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রচুর গবেষণা করছেন কিন্তু তারা আত্মপ্রচারবিমুখ বলে সেগুলো ওয়েবসাইটে দিতে চান না। স্যারের উত্তর থেকেই বুঝা যায় প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের মানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে নেয়ার জন্য কতটা আন্তরিক। অথবা এ বিষয়ে তার প্রশাসনের কোন মাথা ব্যথাই নাই। যেসব শিক্ষকরা গবেষণা করছেন তারা সেসব পুরোটাই করছেন নিজেদের ব্যক্তিগত এবং পেশাগত উন্নয়নের জন্য। তারা যে নিজের পকেটের খরচে সব গবেষণা করছেন তা নয়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ সুবিধা নিয়েই করছেন।
প্রসঙ্গক্রমে স্যার উল্লেখ করেছেন যদি একটা রিভার্স র্যাঙ্কিং করা হয় যে কত কম অর্থায়নে কত দক্ষ স্নাতক তৈরি করা হচ্ছে, সেই র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শীর্ষে থাকবে। তিনি হয়তো ভুলে গেছেন যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কম খরচে পড়াশুনা করানো হচ্ছে সেটা কারও দয়া নয়, এটা ছাত্রদের অধিকার। কারণ ঢাবিসহ রাষ্ট্রায়ত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কমার্শিয়াল লক্ষ্য নিয়ে বা শিক্ষার বিনিময়ে মুনাফার জন্য প্রতিষ্ঠা হয়নি। তাই কম করচে গ্র্যাজুয়েট তৈরী কখনোই তার প্রশাসন বা কারো জন্যই প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্যের বিষয় হতে পারে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্ক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা নিয়ে স্যারের সফলতা থাকলেও তার পিছনে কতটা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনুপস্থিতি আর কতটা প্রশাসনিক সফলতা আছে সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতির সাথে মিশে আছে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য। দেশের বড় বড় নেতৃত্ব তৈরীতে যার ভূমিকা একটি উজ্বল ইতিহাস রয়েছে সেখানে আজকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়টা নেতা তৈরী হচ্ছে, কয়জন গবেষক বেরুচ্ছে সেগুলিও ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। ব্যক্তিগত, বিচ্ছিন্ন গবেষণার ফলাফলইবা কী?
গবেষণা বাজেট কম হলেও যতটা আছে সেগুলোই বা ব্যবহৃত হচ্ছে কোন খাতে? কিছুদিন আগেই সঠিক উপায়ে চুমু খাওয়া নিয়ে ঢাবির একটি গবেষণার খবর দেখলাম পত্রিকায়। তাহলে একটা বেসিক প্রশ্ন জাগে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা বা গবেষণার মান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে সে খবর কী স্যার জানেন? জাতির কোন কাজে লাগবে এই গবেষণার ফলাফল?
একটা সময় ছিল যখন রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা এমনকি বঙ্গবন্ধুর বেলাতেও শুনা যায় যে কোন পরামর্শের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা শিক্ষকদের ডাকা হত। কিন্তু শিক্ষকরা কেউ নিজে থেকে গিয়ে বঙ্গভবন বা সরকারি কার্যালয়ে লাইন দিত না। দেশের মুক্তি সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রয়েছে ঐতিহাসিক অবদান। বর্তমান সময়ে এমন কয়জন শিক্ষক আছেন যাদেরকে রাষ্ট্রের কোন বিষয়ে পরামর্শের জন্য প্রথমেই ডাকা হয় বা ব্যক্তিগতভাবে তাদের কাছে মতামত চাওয়া হয় বা নিদেনপক্ষ ব্যক্তিগতভাবে একতি শ্রদ্ধার ও ভালোলাগার সম্পর্ক আছে?
বরং প্রধানমন্ত্রী একবার শিক্ষকদের তদবিরের বিষয়টি তার কথাতেই রেফারেন্স হিসেবে বলেছেন। শিক্ষা সম্পর্কিত, ছাত্রদের বিভিন্ন সমস্যা বা জাতীয় ইস্যুগুলোর চেয়ে শিক্ষকরা ব্যস্ত আছেন নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি আর কামড়কামড়ি নিয়ে। শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যেই একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধার বিষয়টি পাওয়া যায় না। একে অপরের বিরুদ্ধে অল্পতেই ঠুকে দিচ্ছেন মামলা। যেখানে শিক্ষকদের এই অধঃপতন সেখানে ছাত্রদের শিক্ষা দেয়া, তাদের নৈতিকতা গড়ে তুলতে সেসব শিক্ষকদের ভূমিকা রাখা কেমন করে সম্ভব হবে? তার মধ্যে শুনা যাচ্ছে অদক্ষ এবং অযোগ্য ব্যক্তিদের কেবল দলীয় বিবেচনায় সমস্তরকম নিয়ম ভেঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মত গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।
স্যার ব্যক্তিগতভাবে একজন সজ্জন এবং উদার মনের মানুষ হতে পারেন, যার সাথে চাইলেই কেউ মধ্যরাতেও দেখা করতে পারেন বিনা নোটিশে এবং তিনি নিজের হাতে কাবাব ভেজে খাওয়ানোর গল্পও শুনেছি কারও কারও লেখায়। কিন্তু একজন দক্ষ প্রশাসনের যে পরিমাণ দক্ষতা এবং বিতর্কের উর্ধ্বে থেকে কাজ করে যাওয়ার ক্ষমতা থাকতে হয় সে বিষয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠছে।
জাতীয় এক দৈনিকের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষকের সংখ্যা ১৯৯২, যার মধ্যে আরেফিন স্যারের শাসনামলে নিয়োগ করা হয়েছে মোট ৯০৭ জনকে। এর মধ্যে শেষ তিন বছরে নিয়োগ পেয়েছে ৩৫০ জন। শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে এবং যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৭৮ জন এবং কোন যোগ্যতায় আসে না দুই বিভাগে এমন নিয়োগ দেয়া হয়েছে ১০ জনকে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত পদের চেয়ে বেশি নিয়োগ দেয়া হয়েছে অন্তত ৪১ জনকে। স্নাতকোত্তর ছাড়াই নিয়োগ পেয়েছে অন্তত দু’জন।
সম্প্রতি সুপ্রীমকোর্ট এক শিক্ষককে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার অযোগ্য বলে ঘোষণা করে তার নিয়োগ বাতিল করেছে যেখানে মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত জায়গায় এমন অযোগ্যদের নিয়োগ ভবিষ্যতের জন্য শুভ লক্ষণ নয়। একই দৈনিকের রিপোর্টে নিয়োগ দুর্নীতির যে বর্ণনা এবং তথ্য দেয়া হয়েছে এবং যেখানে দলীয় বিবেচনা ছাড়া এবং ভোটার সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্য ছাড়া আর কোন বিবেচনাই কাজ করেনি সেসব যদি ভুল না হয় তাহলে আরেফিন স্যারের এই দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতায় থাকার ফলাফল ভোগ করতে হবে গোটা দেশ এবং সমাজকে।
সর্বোপরি ঢাবির ভিসি পদটি অত্যন্ত সম্মানীয় একটি পদ। এই পদটিকে কলুষিত করে যাবার দায় কি তিনি এড়াতে পারবেন? স্যারের বিভাগের ছাত্র না হলেও ব্যক্তিগতভাবে ওনার প্রতি আমার শ্রদ্ধার কমতি নেই। তাই আমিও চাই আরেফিন স্যার তার ছাত্রদের কাছে সম্মানের জায়গাটিতেই থাকুন। কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে নয় ফুলের মালা গলায় দিয়ে স্যার এবং আমাদের সকলের প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনে এগিয়ে নিতে অবদান রাখুন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)