নির্বাচনী ইশতেহার মানে কিছু স্বপ্নের দৃশ্যায়ন। অর্থাৎ ক্ষমতায় এলে কোন দল কী করবে, তার কিছু প্রতিশ্রুতি, কিছু কথার ফুলঝুরি। সাধারণ মানুষের মধ্যে ইশতেহার নিয়ে সাদামাটা ধারণা এরকমই। যে কারণে ইশতেহার নিয়ে আমজনতার আগ্রহও কম। তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো যেসব ইশতেহার দেয়, সেখানে অনেক প্রতিশ্রুতি যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, সেটি তারা নিজেরাও জানে। কিন্তু জনতুষ্টি বিবেচনায় তারা কিছু সুন্দর কথার ফুলে একটা প্রতিশ্রুতির মালা গাঁথার চেষ্টা করে।
এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের প্রধান দুটি দল যে ইশতেহার দিয়েছে, সেখানে সুস্পষ্ট পার্থক্য দুটি দলের দর্শনে। আওয়ামী লীগ যেহেতু টানা ১০ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে, সে কারণে স্বাভাবিকভাবেই তাদের ইশতেহারে এই সময়কালে উন্নয়নের ফিরিস্তি এবং এর ধারা অব্যাহত রাখতে বিবিধ পরিকল্পনাই প্রাধান্য পেয়েছে।
পক্ষান্তরে বিএনপি যেহেতু বিশ্বাস করে এবং দাবি করে যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি অবৈধ এবং সে কারণে এই সরকারও অবৈধ—তাই এ মুহূর্তে সরকারের পরিবর্তন তথা দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনাই তাদের মূল প্রতিশ্রুতি। দলটি মনে করে, দেশে বাক স্বাধীনতা নেই এবং এ সম্পর্কিত আইনগুলো বাতিল এমনকি নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে ইন্টারনেটে নজরদারি করা হবে না বলেও তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, দলগুলো যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়, ক্ষমতায় যাওয়ার পরে তার অনেক কিছুই বিস্মৃত হয় কিংবা চেপে যায়। বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করে। তবে ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে তারা যে ইশতেহার দিয়েছিল সেখানে সংসদের আসন ৫০০ করা, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপিদের সম্পদের হিসাব নেয়া, বিচার বিভাগ পৃথক করা,রাষ্ট্রায়ত্ত রেডিও টিভির স্বায়ত্বশাসন, স্থায়ী পে-কমিশন গঠন, পার্বত্য চুক্তির নতুন সমাধান, সবার জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার মতো প্রতিশ্রুতিগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার পরে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। আবার ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল ক্ষমতায় গেলে তারা সাংবিধানিক পরিবর্তন এনে সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি বন্ধ করবে। অথচ বিরোধী দলে গিয়ে ওই আমলে সময়ই সবচেয়ে বেশি সংসদ বর্জনের রেকর্ড করে তারা। যদিও ২০০১-০৬ আমলে বিএনপি সংসদে নারীর আসন বাড়ানো, স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন কমিশন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি রেখেছিল।
এবার বিএনপির একটি প্রতিশ্রুতি এরকম যে, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত করা হবে। আর তাদের জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রতিশ্রুতি, ক্ষমতায় গেলে দুই বছরের মধ্যেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার টাকা করা হবে। বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত করা সম্ভব হলেও ২ বছরের মধ্যে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ১২ হাজার টাকা করা আদৌ বাস্তবসম্মত এবং সম্ভব কিনা, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। কারণ এর সাথে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ জড়িত। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা যেখানে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে না, সেখানে হুট করে এই বিপুল পরিমাণ বেতন বাড়ানো হলে সেখানে সরকারকে কী পরিমাণ ভর্তুকি ও প্রণোদনা দিতে হবে, সেটি একটি বিশাল তর্ক। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, তারা সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপ না করেই এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই প্রতিশ্রুতিতে শ্রমিকদের খুশি হবার যথেষ্ট কারণ থাকলেও, এর বাস্তবায়ন আপাতত অসম্ভব বলেই মনে হয়।
আবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচার চালিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও এই জোটের প্রধান দল বিএনপির ইশতেহারে এ বিষয়টি নেই। না থাকার কারণও স্বাভাবিক যে, বিএনপি অন্তত ২২ জন জামায়াত নেতাকে ধানের শীষে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দিয়েছে। ফলে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে অবস্থান পরিস্কার করা তাদের পক্ষে কঠিন।
অতীতেও সব দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করা, বিরোধী দলে গেলেও সংসদ বর্জন না করা, নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করার মতো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তারা সেসব প্রতিশ্রুতি রাখেনি। মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি থাকলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এমন কিছু বিধানও তারা রেখে দিয়েছে যেগুলো স্পষ্টতই নাগরিকের কণ্ঠ চেপে ধরে। পক্ষান্তরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনেক কথা বললেও টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থেকেও আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের সর্বস্তরে না হোক, অন্তত সরকারি অফিসের দুর্নীতি কতটুকু কমাতে পেরেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবার তাদের ইশতেহারে প্রতিটি গ্রামে নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়ার কথা বললেও নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড কৃষিজমি যে প্রতিনিয়তই বেহাত হচ্ছে, কল-কারখানার পেটে প্রতিনিয়তই যে খাল, বিল, জলাশয় ও পুকুর চলে যাচ্ছে, সেই ভয়াবহতা রোধের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা বলেনি।
তবে এবারের ইশতেহারে যেসব আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে তার মধ্যে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, নির্বাচনকালীন সরকারের বিধান, দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে না থাকা, সামরিক বাহিনী ও পুলিশ ছাড়া সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা তুলে দেওয়া অন্যতম। এই প্রতিশ্রুতিগুলো এসেছে বিরোধী বিএনপির তরফে।
এবারও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী, নগর ও শহরে পরিকল্পিত ভূমি ব্যবহার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এর সবই জনগুরুত্বপূর্ণ এবং অতি প্রয়োজনীয়ও বটে। কিন্তু গত ১০ বছর ধরে যে দলটি ক্ষমতায় রয়েছে, তারা এই দীর্ঘ সময়ে কেন প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারল না, কেন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কোনো উদ্যোগ নিতে পারল না, নাগরিকদের মনে সেই প্রশ্নও আছে। যেমন প্রশ্ন আছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বহাল রেখে বাক স্বাধীনতা নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি নিয়ে। গত ১০ বছরে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান এই স্তম্ভটি কতটা নিজের মতো করে চলতে পেরেছে, বিভিন্ন ঘটনায় তা নিয়েও সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
তবে এ বিষয়ে দ্বিমতের সুযোগ কম যে, গত ১০ বছরে দেশের আর্থসামাজিক ও অবকাঠামোতে দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন বিরাট সাহসিকতার প্রমাণ। রাস্তা, সেতু, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলের মতো প্রকল্পগুলোও এগিয়েছে। আবার এসব মেগা প্রকল্পে অনেক সময় মেগা দুর্নীতিরও অভিযোগ উঠেছে। তবে এবার আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে জিরো টলারেন্সের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ভবিষ্যতে সত্যি সত্যি এ ব্যাপারে সরকার আন্তরিক হলে, উন্নয়ন দৃশ্যমান হওয়ার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের জনভিত্তি আরও বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই।
বৃদ্ধ ও পঙ্গু ব্যক্তিদের জন্য ভাতা, অটিস্টিকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা, এমনকি সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন এমন মায়েদের জন্য ভাতা চালুও বর্তমান সরকারের মানবিক উদ্যোগ নিঃসন্দেহে। এর পাশাপাশি মেয়েদের স্কুলে ঝরে পড়া রোধে স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করে দেয়ার মতো কাজগুলোও প্রশংসনীয়।
তিনটি স্থানের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের যে আজন্ম ভীতি, যেমন থানা, আদালত ও হাসপাতাল—এইসব জায়গায় সেবা নিতে গিয়ে মানুষকে যে বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়, তা দূর করার বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি বা কর্মপরিকল্পনা নেই। যদিও বিএনপি তাদের ইশতেহারে বলেছে ভয়ের সংস্কৃতি দূর করা হবে। কিন্তু এই বক্তব্যটিও যতটা অ্যাকাডেমি, ততটা আমজনতার পক্ষে বোধগম্য নয়।
বস্তুত ইশতেহারে কী আছে বা নেই কিংবা কী ছিল এবং ক্ষমতাসীন দল তার কতটুকু বাস্তবায়ন করেছে, তা আলোচনায় আসে ভোটের সময়। কিন্তু সাধারণ মানুষকে সারা বছরই সরকারের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও সেভাবে স্বাধীন ও কার্যকর নয় যে, একজন নাগরিক যেকোনো সমস্যায় বা প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে গেলেই বিনা হয়রানিতে সেবাটি পাবে। সেই জায়গায় পৌঁছানোর জন্য যে পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট বা রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন, সেটি এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি। নানাভাবে বিষয়গুলো বড় দুটি দলের ইশতেহারে আছে বটে, কিন্তু তাদের ইশতেহারে ঘুরেফিরে উন্নয়ন আর গণতন্ত্রের কথা এত বেশি যে, কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার করিমন বেওয়ার ছেলেকে পুলিশ বিনা অপরাধে ধরে নিয়ে গেলে পুলিশ-উকিল ও দালালকে পয়সা দেয়ার জন্য তার যে ফসলি জমি ও হালের গরুটিও বিক্রি করে দিতে হয়—সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়ার কোনো রূপরেখা কেউ দেয়নি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)