কোথাও ভূমিকম্প হয়েছে শুনলে সাধারণত আমরা আতঙ্ক নিয়ে ভাবি, আমাদের দেশেও ভূমিকম্প হবে কিনা। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার অধিবাসীদের হওয়া না হওয়া নিয়ে ভাবতে হয় না। তাদের চিন্তার বিষয়: ভূমিকম্পটা কখন হবে!
ভূমিকম্প এতটাই অবশ্যম্ভাবী দুর্যোগ দেশটির জন্য।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রায় ১৫ হাজার জাতিসংঘ স্বীকৃত (নথিবিহীন আরও কয়েক হাজার) দ্বীপ নিয়ে গঠিত রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া গত শুক্রবার ভয়াবহ এক ভূমিকম্পের আঘাতে কেঁপে উঠেছিল।
জাকার্তা পোস্ট জানায়, শুক্রবার স্থানীয় সময় বিকেল থেকে ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপের কেন্দ্রে অবস্থিত ডংগালা এলাকায় পর পর বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। এর মধ্যে সন্ধ্যা ৬টা ২ মিনিটে আঘাত করা ভূমিকম্পটি ছিল রিখটার স্কেলে ৭.৫ মাত্রার।
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই দেশটিতে আঘাত হানে প্রলয়ঙ্করী এক সুনামি। ভূমিকম্পের পরপরই ওই এলাকায় সুনামি সতর্কতা জারি করে ইন্দোনেশিয়ার ভূ-তাত্ত্বিক সংস্থা। কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যেই সেই সতর্কতা তুলে নেয়া হয়। আর ওই সময় আঘাত করে তীব্র জলোচ্ছ্বাস।
জলোচ্ছ্বাসের বিশাল ঢেউয়ের তোড়ে খড়কুটোর মতো ভেসে যায় পালু শহর ও এর আশপাশের উপকূলীয় পুরো এলাকার ভবন, স্থাপনা। ০.৫ মিটার থেকে ৩ মিটার (১০ ফুট) পর্যন্ত উঁচু পানির দেয়াল খেলনা গাড়ির মতো ছুড়ে ফেলে দেয় ভারী ভারী যানবাহনকে।
এত জলদি সতর্কতা তুলে নেয়ার সিদ্ধান্তের জন্য ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে সংস্থাটি। তবে তাদের দাবি, তাদের সতর্কতা জারি থাকা অবস্থায়ই সুনামি আঘাত করেছিল।
শুক্রবার সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পটির মাত্র ১২ মিনিট পরই ৫.৮ মাত্রার বিরাট এক আফটারশক অনুভূত হয়েছিল। এখনো একের পর এক আফটারশকে কাঁপছে পুরো অঞ্চল।
স্থানীয় সময় রোববার ভোর পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৩২-এ। আহত ৬শ’র বেশি। হতাহতের সংখ্যা আরও অনেক বাড়তে পারে বলে ইতোমধ্যেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ইন্দোনেশিয়ার ন্যাশনাল ডিজাস্টার অ্যান্ড মিটিগেশন এজেন্সির (বিএনপিবি) মুখপাত্র সুতপো পারউয়ো নুগ্রহো।
একের পর এক ভূমিকম্পের শিকার ইন্দোনেশিয়া
এর মাসখানেক আগেই লম্বকসহ দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর এলাকা ও ইন্দোনেশিয়ার বেশ কয়েকটি এলাকায় আঘাত করেছিল পরপর তিনটি ভূমিকম্প। তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালীটি ছিল রিখটার স্কেলে ৬.৯ মাত্রার।
ওই ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার লম্বক। দ্বীপটি তার কিছুদিন আগে, ৫ আগস্ট হওয়া শক্তিশালী ভূমিকম্পের ধাক্কাই তখনো সামলে উঠতে পারেনি। ওই ভূমিকম্পে অন্তত ৪৩০ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
৫ জুলাইয়ের তুলনামূলক ছোট মাত্রার ভূমিকম্পেও মারা গিয়েছিল ১৫ জন।
কেন ইন্দোনেশিয়া এত ভূমিকম্পের শিকার
ইন্দোনেশিয়া অত্যন্ত ভূমিকম্পপ্রবণ একটি ভৌগলিক অঞ্চলে অবস্থিত। একে বলা হয় ‘রিং অব ফায়ার’। এটি প্রশান্ত মহাসাগরের অববাহিকায় একটি বৃত্তাংশ, যেটি পানির নিচে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ও ভূ-পৃষ্ঠের ফাটল বা ফল্ট লাইন দিয়ে গঠিত।
এই রিং অব ফায়ারের আকার অনেকটা ২০ হাজার কিলোমিটার আয়তনের এক পাটি জুতোর মতো। এই এলাকায়ই পুরো পৃথিবীর অধিকাংশ ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
বিশ্বের সবচেয়ে ভূকম্পনশীল অংশগুলোর মধ্যে অন্যতম এই এলাকাটি প্রশান্ত মহাসাগরের একদিকে জাপান ও ইন্দোনেশিয়া থেকে অন্যদিকে ক্যালিফোর্নিয়া ও সাউথ আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত।
ভূ-পৃষ্ঠের ফাটলগুলোর সৃষ্টি ‘টেকটনিক প্লেটে’র কারণে। ‘লিথোস্ফিয়ার’ নামক পৃথিবীর সবচেয়ে বাইরের কঠিন স্তরটি অনেকগুলো বড়, ছোট ও মাঝারি খণ্ড নিয়ে গঠিত। খণ্ডগুলো ঠিক নিচে থাকা তুলনামূলক নরম এবং আংশিক গলিত স্তর ‘অ্যাসথেনোস্ফিয়ারে’র ওপর দিয়ে নড়তে এবং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরে যেতে পারে।
লিথোস্ফিয়ারের দুই খণ্ডের মাঝের ফাটলগুলোকেই বলে ফল্ট লাইন। খণ্ডগুলো সবসময়ই ভূগর্ভস্থ কম্পনের কারণে কোনো এক দিকে একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। এর ফলে ফল্ট লাইনগুলোতে কম্পন অনেক বেশি অনুভূত হয় এবং সেখানে থাকা আগ্নেয়গিরিগুলো থেকে যখন তখন অগ্নুৎপাত হতে থাকে।
এই ভূগর্ভস্থ আলোড়নগুলোই ব্যাপক মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে এর ওপরে অবস্থিত দেশগুলোকে তছনছ করে দেয়।
একই সঙ্গে টেকটনিক প্লেট এবং রিং অব ফায়ার এলাকায় থাকাই ইন্দোনেশিয়াতে একের পর এক ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির উদগীরণের মূল কারণ বলে জানিয়েছেন সিএনএনের ভূ-তত্ত্ববিদ অ্যালিসন চিন্টার। ‘কারণ, দেশটির নিচে থাকা পৃথিবীর অংশটি প্রতিনিয়ত নড়ছে, সরে যাচ্ছে এবং পরিবর্তিত হচ্ছে।’
একেকটি ভূমিকম্পের পর সেখান থেকে সামলে ওঠার সুযোগও খুব একটা পাচ্ছে না ইন্দোনেশিয়া ও এর আশপাশের এলাকার মানুষ। কেননা প্রত্যেকটা বড় ভূমিকম্প একা আসছে না। আসছে অনেকগুলো ছোটবড় ভূমিকম্পের সিরিজ হিসেবে। আর সবচেয়ে মারাত্মক ভূমিকম্পটির পরও অসংখ্য আফটারশকে কম্পিত হচ্ছে পুরো অঞ্চল।