সেই পাকিস্তান আমলের কথা, ১৯৬৮-৬৯ সাল হবে। আমাদের গাঁয়ের দাউদ ফকির ফুটফুটে চাঁদমুখী এক ষোড়শীকে বিয়ে করে ঘরে তুললো। নববধূর নাম রূপবান। যথার্থই নাম তার। ছিপছিপে গড়ন, মেদহীন শরীর, সুউন্নত বক্ষ, ডাগর ডাগর দুটি চোখ, দুধে-আলতা গায়ের রং, লম্বা কেশরাজি পিঠ-মাজা ছাড়িয়ে যেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, পাতলা ঠোঁট দুখানিতে লিপস্টিক লাগানোর প্রয়োজন পড়ে না। বউ কোমল স্বভাবের এবং অতিশয় লাজুক প্রকৃতির। নববধূর রূপ-গুণ সারা তল্লাটে চাউর হতে সময় লাগলো না। ছেলে-বুড়ো সবার মুখেই রূপবান কীর্তন!
আমাদের দাউদ ফকিরও কম যায় না। ছ’ফুট লম্বা দোহারা গড়ন। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, পেটা শরীর। শুধু গায়ের রংটাই যা একটু ময়লা। তবে পুরুষ মানুষের গায়ের রংয়ে কি যায় আসে? সোনার আংটির আবার বাঁকা আর সোজা কি? তার উপর দাউদ মিলিটারিতে চাকুরী করে, করাচীতে পোষ্টিং। পাকিস্তানি মিলিটারি বলে কথা! খুবই গম্ভীর ও ভারিক্কি মেজাজ তার, যাকে বলে মিলিটারি মেজাজ। ছুটি ছাটায় বাড়িতে এলে লোকে তাকে সমীহ করে, খাতির করে চেয়ার টেনে বসতেও দেয়।
তো বিয়ের পাঁচ/সাতদিনের মাথায় একদিন দুপুরের পরে দাউদ রূপবানকে নিয়ে গ্রাম দেখাতে বেরুলো। আমাদের গ্রামখানি গোপালগঞ্জের একেবারে প্রত্যন্ত বিলের মধ্যে। সেই সময়ে বছরের আট মাসই জলে ডোবা থাকতো, নৌকাই ছিলো একমাত্র বাহন। গ্রামটি শিক্ষার আলো বঞ্চিত এবং আধুনিক সভ্যতা থেকেও বহু যোজন দূরে। তবে সবুজের সমারোহ চারিদিকে। সব বাড়িতেই পুকুর ভরা মাছ, ক্ষেতে সোনালী ধান, বাড়িগুলোর আঙ্গিনার মাচায় মাচায় লাউ-সিম-চিচিঙ্গা- যেন এক স্বর্গীয় আবেশ চারিদিকে। গ্রামখানি লম্বাটে, মাঝখান দিয়ে একটি মাত্র কাঁচা রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে। রাস্তার দুপাশে বাড়িগুলো একের পর এক সাজানো। বিল অঞ্চল হওয়ায় কোনো বাড়িই ভূমির সমতলে নয়, উঁচু ঢিবির উপরে। বর্ষা মৌসুমে প্রতিটি বাড়িই মনে হয় যেন ছোট ছোট দ্বীপ।
রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে দাউদ নববধূকে গ্রাম চেনাচ্ছে। এটা চেয়ারম্যান বাড়ি, ওই যে দেখ জুলেখা ফুফুর আস্তানা, তার ঝাড়ফুঁকে ধন্বন্তরি ফল দেয়। আর ঐ যে ওটা আকবর বেপারীর আড়ৎ। এইটা চেয়ারম্যান বাড়ির মাঠ, এখানেই গাঁয়ের সব খেলাধুলা হয়। রাস্তার ওই বাঁকটি ঘুরলেই স্কুলঘর চোখে পড়বে। এভাবেই নব দম্পতি ধীরে ধীরে গ্রাম প্রদক্ষিণ করছিলো। গাঁয়ের ১৫/২০জন বালক বালিকা রাশভারী দাউদের থেকে একটা নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে রাস্তা ধরে ওদের অনুসরণ করছে আর ঘোমটা ঢাকা বধুর রূপ আন্দাজ করার চেষ্টা করছে।
লজ্জাবতী রূপবানের বোধকরি স্বামীর সাথে প্রকাশ্যে এই গ্রাম দর্শন অস্বাভাবিক ঠেকছিলো। সে দাউদের থেকে অন্তত পাঁচ কদম পেছনে হাঁটছে। দাউদ বারেবারেই তার হাঁটার গতি মন্থর করে বৌয়ের পাশাপাশি হবার চেষ্টা করছে। বউও একই কায়দায় প্রতিবারেই ততটা পিছিয়ে থাকছে। রাস্তার দুপাশের বাড়িগুলো থেকে মা-বোনেরা এই নবদম্পতিকে উকিঝুঁকি দিয়ে দেখছে। কেউবা রাস্তা অব্দি দৌড়ে এসে রূপবানের অবগুন্ঠিত রূপ দেখার চেষ্টা করছে। কোনো এক বাড়ি থেকে বয়স্ক কেউ একজন ডেকে বললো, ওই দাউদ্যা বউ লইয়া বেড়াইয়া যা। দাউদের সলজ্জ জবাব, আইজ না বুজি আরেকদিন আমুনে।
এমনি করে সময় গড়াতে গড়াতে একদিন দাউদের ছুটি ফুরোলো। এবার কর্মস্থলে যাওয়ার পালা। আরো দু-এক সপ্তাহ ছুটি বাড়ানোর জন্য সে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলো। কিন্তু মিলিটারি আইন বড়ই কড়া, ছুটি না মঞ্জুর। তাকে যেতেই হবে। চোখের জলে দুগাল ভাসিয়ে প্রাণাধিক প্রিয় স্বামীকে বিদায় জানালো রূপবান। এখন থেকে এক বছর পরে দাউদের এক মাসের ছুটি মিলবে, তখন আবার মিলন হবে দুজনের। এ মুহুর্তে এই ‘এক বছরটি’ ওদের কাছে বহু বহু যুগের সমান মনে হচ্ছে। এ প্রতীক্ষা বড়ই বেদনার, এ যেন অনন্তকাল অপেক্ষা! কিন্তু সেইতো বিধির বিধান, মিলিটারি স্বামী হলে যা হয়! ওদের সংসারে লোক দুজন, রূপবান আর তার বিধবা শ্বাশুড়ি শুকুরুন্নেচ্ছা। পুত্র স্নেহে মা কাতর, আর স্বামীর বিরহে স্ত্রী। অতিক্রান্ত সময়ের সাথে সাথে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই দাউদের অনুপস্থিতির যন্ত্রনাটা ধীরে ধীরে প্রশমিত হতে থাকলো। রূপবান ও তার শ্বাশুড়ি আবারো স্বাভাবিক সংসার জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলো।
এমনি সময়ে একদিন দুপুর নাগাদ ডাক পিয়ন এসে হাঁক ছাড়লো, মোসাম্মাৎ রূপবান খাতুন বাড়িতে আছো? দরজা একটুকু ফাঁক করে ঘোমটার আড়াল থেকে বধু বললো, জ্যে আমিই রূপবান। তোমার ফত্র আছেগো মা, দাউদে ফাডাইছে। চিঠি হাতে পেয়ে সেকি আনন্দ রূপবানের! ঘরের কপাট আটকে দিয়ে একেলা ঘরে চিঠিখানা হাতে নিয়ে ঘরময় ছুটছে সে! চিঠিতে চুমু খাচ্ছে, খামখানা ব্লাউজের ফাঁক গলিয়ে বুকের মধ্যে ঢুকাচ্ছে, আবার বের করছে! হয়তো দুফোঁটা আনন্দাশ্রুও ততক্ষণে সিক্ত করেছে ইনভেলপখানা!
চৌকির উপরে বসে অতি যতনে রূপবান খাতুন খাম খুলে চিঠিখানা বের করলো। একপাতার চিঠি, এপিঠ ওপিঠ ভরে লেখা। সে তার হৃদয়ের উদ্বেলিত ভালবাসা দিয়ে চিঠির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চোখ বুলোতে থাকলো। কিন্তু রূপবানের পক্ষে পাঠোদ্ধার সম্ভব নয়। কারণ সে পড়তে-লিখতে জানে না। তবে পাঠে অক্ষম হলেও রূপবান চিঠির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বারেবারে চোখ বুলাচ্ছে আর মাঝেমধ্যেই চিঠিখানি বুকে জড়িয়ে ধরছে। চিঠির প্রতিটি ছত্রে ছত্রে তার দাউদ তাকে যে আদর-মমতা-ভালবাসা বলেছে, সেটা যেন রূপবান তার অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে পরিস্কার পড়ে নিচ্ছে। এভাবে বহুক্ষণ সে চিঠিখানি বুকে জড়িয়ে বসে থাকলো। সম্বিত ফিরলো শ্বাশুড়ির হাঁকডাকে। ও বউ দাউদ্যার ছিডি নাকি? হাসিনারে খবর দাও তোমারে ফইড়া শুনাইবো।
প্রতিবেশী হাসিনা সম্পর্কে রূপবান খানমের ননদিনী। কাছাকাছি বয়স দুজনের, হাসিনা দুএক বছরের বড় হতেও পারে। ওরা আবার দুজন সই, খুবই ভাব পরস্পরের, একেবারে হরিহর আত্মা। একজনকে ছাড়া অন্যজন অচল। ঘরের কাজে কর্মে ফুরসত পেলেই হাসিনা এক দৌঁড়ে চলে আসে রূপবানের ঘরে। কত কথা দুজনের, চুলে বেনী বাঁধা থেকে শুরু করে পায়ে আলতা মাখানো, -সবই এক সাথে করা চাই। হাসিনা লেখাপড়া জানে, গ্রামের স্কুল থেকে ফাইভ ক্লাশ পাস দিছে। খবর পেয়ে সে ছুট দিয়ে চলে এলো। ঘরের কপাট আটকে দিয়ে দুজনে চৌকির উপর মুখোমুখি বসলো। একজন পড়ছে আরেকজন শুনছে! চিঠির পরতে পরতে ভালবাসার কথা লেখা, প্রেমে-আদরে-সোহাগে রাঙানো প্রতিটি ছত্র! হাসিনা পড়ছে, আর লাজে-অনুরাগে ক্ষণেক্ষণেই রাঙা হয়ে উঠছে রূপবান। চিঠির ভাষা শুনে ননদের সামনে বারেবারেই আঁচলে মুখ ঢেকে লজ্জা নিবারণ করছে সে। পত্র পাঠ শেষে হাসিনা বললো, ভাইজান যে এতডা ফ্রেমের কতা কইতে জানে হেইডা তারে দেইখ্যা ঠাওর করণ যায় না। চুপ যা পোড়ারমুখি- ননদকে রূপবানের তিরস্কার!
যাই হোক চিঠি পড়া শেষ, এবার জবাব লেখার কাজ শুরু হলো। স্বামীকে না বলা কথাগুলো রূপবান তার ভাষায় বলছে, আর হাসিনা সাধ্যমত সেই কথাগুলো লেখার ভাষায় কাগজে লিখে ফেলছে। সেখানে উঠে আসছে স্বামীর প্রতি রূপবানের গভীর অনুরাগ, প্রেম, ভালবাসা, আবেগ, অনুভূতি, কুশল কামনা, সংসারের খুঁটিনাটি, অপেক্ষার প্রহর গোনার কষ্ট, ভবিষ্যৎ জীবনের সুখের ইঙ্গিত- আরো কত কি! লিখতে লিখতে হাসিনা কয়েক পাতা ভরে ফেলেছে। স্বামীর সংক্ষিপ্ত চিঠির সবিস্তার জবাব! এক সময় রূপবানের কথা ফুরোলো। সে জানতে চাইলো, ওই হাসিনা তর ভাইজান আমার ছিডি কবে ফাইবো? কাইলক্যার ডাকে ফাডাইলে দুইতিন হপ্তা লাইগবো মনে হয়, করাচীতো আর কাছে না- হাসিনার জবাব।
কিন্তু পত্র লেখারতো একটা ব্যাকরণ আছে, এরতো সমাপনী বক্তব্য বা শেষ কথা থাকতে হবে। হাসিনা বললো ভাবি শ্যাষ কতা কি কইতে চাও? কইলামতো এতক্ষণ, আইজ আর কিছু কওনের নাই ছিডি ভাজ কর। না, তা হয় না, শ্যাষে কিছু একডা কইতে হয়, ছিডি লেখনের নিয়ম এইডা। এই শ্যাষ কতাডাই ভাইজানের মনে দাগ কাইট্যা থাকবো। কও কি কইবা। নারে বুইজতে পারতাছি না, শ্যাষ কতাডা কি কমু। তুই একডা কিছু লিখ্যা দে। ও আল্লাহ কি কও! আঁতকে উঠলো হাসিনা। তাই অয় নাকি, ভাইজানেরে তুমি কি কইবা তা আমি ক্যামনে লিখুম? তোমারই কওন লাগবো, যা কইতে চাও কইয়া ফালাও। রূপবান ভাবছে, শ্যাষ কতাডা কি কওন যায়। কিন্তু কোনো কূল-কিনারা করতে পারছে না। হাসিনা বললো শোন ভাবি, ভালা কইরা চিন্তা কর। এই শ্যাষ কতাডার মইধ্যে তোমার ভালবাসা ও সোহাগের একডা ছোঁয়া থাকতে ওইবো। আবার তোমার স্বামী মিলিটারি, দ্যাশের লাইগ্যা দরকার লাগলে সে যুদ্ধ কইরবো। তোমার ছিডির শ্যাষ কতার মইধ্যে দ্যাশ ফ্রেম থাইকলে আরো ভালো হয়।
রূপবান বুঝতে পেরেছে যে এই শেষ কথাটাই আসল, এটাই স্বামীর মনে দাগ কেটে থাকবে। গভীর চিন্তায় মগ্ন হলো সে, -কি বলা যায়? কি এমন কথা লেখা যায় যাতে ভালোবাসা এবং দেশপ্রেম দুটোই প্রকাশ পায়! সেই মুহুর্তে অক্ষরজ্ঞানহীন এই বালিকাবধু তার মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে চলেছে একটি যুৎসই শব্দগুচ্ছ বের করতে, যাতে মিলিটারি স্বামীর মন জয় করা যায়। রূপবান দুহাতে মাথা চুলকাচ্ছে আর দ্রুত খুঁজছে কাংখিত সেই কথাটি। শুনশান নিরবতা, চিন্তামগ্ন রূপবান। হাসিনা ঠোঁটে কলম লাগিয়ে মাথা নিচু করে অপেক্ষায় আছে! এমন সময় হঠাৎ আনন্দোজ্জোল রূপবান হাসিনাকে ধাক্কা দিয়ে বললো, ফাইছি রে হাসিনা ফাইছি! লিখ্যা দে, “ইতি তোমার রূপবান, ফাকিস্তান জিন্দাবাদ”।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)