একটি কথা জামায়াতের কর্মী সমর্থকদের প্রায় সময় বলতে শোনা যায়, কেউ যদি যুদ্ধাপরাধের সাথে যুক্ত থেকে থাকে, তবে সেটা তার ব্যক্তিগত দায়। দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী এই দায়ভার বহন করতে রাজী নয়। কেননা তারা শুধুমাত্র আদর্শিক অবস্থান থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধীতা করেছে মাত্র।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাঙালি নিধনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা শুরু করলেও জামায়াত ইসলামী নিজ দেশের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে পক্ষ নেয় দখলদারদের। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে রেডিওতে ভাষণ দেয় সেই সময়ের জামায়াতের আমির গোলাম আযম।
এরপর সমমনা দলগুলো ও জামায়াতকে নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী একের পর এক বৈঠক করে বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা করে। মুক্তিবাহিনীকে শায়েস্তা করতে গঠন করে রাজাকার আলবদর বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠে জামায়াতের সে সময়ের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ। মানবতাবিরোধী অপরাধে যাদের বিচার হচ্ছে তাদের বেশির ভাগই ছিলেন এই আলবদর বাহিনীর সদস্য। এমনকি স্বাধীনতার পরেও লণ্ডনে বসে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুন:রুদ্ধার কমিটি’ গঠন করে গোলাম আজমের নেতৃত্বে জামায়াতের নেতারা বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্রিমিনাল সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে এখন বিচারের মুখোমুখি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ধর্মভিত্তিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধসহ নয় ধরনের অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে। দল হিসেবে নিষিদ্ধের পাশাপাশি জামায়াতের আদর্শ নিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধের সুপারিশ করা হয়েছে তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে।
একই সঙ্গে জামায়াত তাদের সহযোগী সংগঠক ইসলামী ছাত্র সংঘ, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহাযোগিতা দিতে গঠিত শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস, মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম নিষিদ্ধের আবেদন করা হয়েছে। সব সম্পদ বাজেয়াপ্তের আবেদন করা হয়েছে।
আত্মপ্রকাশঃ ১৯৪১ সালের এপ্রিল থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে মাওলানা মওদুদী প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামের তৎপরতা শুরু ভারতীয় উপমহাদেশে। একই বছরের ২৬ আগস্ট ৭৫ প্রতিনিধি নিয়ে লাহোরে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়। ওই দিন সম্মেলন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জামায়াতে ইসলামী সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর আগে ১৯৩৮ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে চার কর্মী নিয়ে ‘দারুল ইসলাম’ নামক সংগঠন যাত্রা শুরু করে।
পরবর্তীতে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির সময় পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী ও ভারত জামায়াতে ইসলামী নামে বিভক্ত হয় জামায়াত। পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে দূরত্ব সৃষ্টি হয় জামায়াতের। ‘কাদিয়ানী সমস্যা’ নামক একটি বিতর্কিত বই লিখে ১৯৫৩ সালের ২৮ মার্চ গ্রেফতার হন জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী। সামরিক আদালতে তার ফাঁসির আদেশ হয়। পরে সৌদি বাদশাহর হস্তক্ষেপে ১৯৫৫ সালের ২৯ এপ্রিল মুক্তি দেয়া হয় তাকে।
১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় জামায়াতও এর আওতায় পড়ে। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের সরকার আবার বহুদলীয় গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে জামায়াতকে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ করে দেয়। সেই সুযোগে গোলাম আযম ১৯৭৯ সালে দেশে ফিরে দলের আমিরের দায়িত্ব নেন। সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসন পায় এবং সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দেয়। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আসন কমে তিনটি হলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত পায় ১৭ আসন। চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রিসভায়ও জায়গা পান জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা। সর্বশেষ ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দুটি আসন পায় জামায়াতে ইসলামী।
গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের যাত্রা শুরু হয়। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মুখে গত ১৮ ফেব্রুযারি সংবিধান সংশোধন করে ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধনী আনে সরকার। এ সময় ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠন বা দলের বিচারের বিধান জুড়ে দেয়া হয়। এর আগে যে বিধান ছিল সে অনুযায়ী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করার সুযোগ ছিল না। গত ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট। ফলে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগও বাতিল করে দেয় নির্বাচন কমিশন। বিষয়টি বর্তমানে আপিল বিভাগের ওপর ন্যস্ত রয়েছে।
বাংলাদেশে জামায়াতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ কেবল ১৯৭১ সালে নয়। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে ১৮ জোটের আন্দোলনের সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে নজিরবিহীন সন্ত্রাস হয়েছে। ভোট ঠেকাতে যাত্রীবোঝাই যানবাহনে আগুন, সরকারি সম্পত্তিতে হামলা, পুলিশের ওপর আক্রমণ, ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত স্কুল এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রে হামলার ঘটনায় দেশ-বিদেশে নিন্দনীয় হয়েছে বিএনপি-জামায়াত জোট। এসব হামলার ঘটনায় জামায়াতকে দায়ী করেছেন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতা। আর এসব সহিংসতার জন্য বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এবং দাতা দেশগুলো।
আর আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসের দায় অস্বীকার করেনি জামায়াত ও তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির। বরং গত ২৭ নভেম্বর এক বিবৃতিতে দেশের ৫৯০টি জায়গায় সহিংসতার কথা জানায় ছাত্র শিবির। আন্দোলন চলাকালে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডে একের পর এক গাড়িতে আগুন দেয়ার দায় স্বীকার করেছেন জামায়াত নেতা সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। ২২ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশে তিনি বলেন সীতাকুণ্ডের ঘটনা নমুনা মাত্র। তাদের দাবি না মানলে তাদের এই আগুন সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হবে।
জামায়াতের সন্ত্রাসের কারণে ত্যক্ত-বিরক্ত বিএনপির সহ-সভাপতি শাজাহান ওমর প্রকাশ্যে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘জামায়াত নিষিদ্ধ হলে আমরা বাঁচি।’ এর আগে তিনটি বিদেশি গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে তাদের জোট চিরস্থায়ী নয়। এই জোট কবে ভাঙবে তা সময় আসলেই জানা যাবে।’
সাক্ষী ৭০ জন: জামায়াতের বিরুদ্ধে সাক্ষী হিসেবে রাখা হয়েছে সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদদের। এর মধ্যে ড. আবুল বারকাত, আনু মুহাম্মদ, ইমদাদুল হক মিলন, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, মঞ্জুরুল আহসান খান, মেজবাহুর রহমান, মাওলানা ফরিদ উদ্দিনসহ ৭০ জন।
সম্পদ ১০৯টি: জামায়াতের সম্পদ বাজেয়াপ্তের তালিকায় রয়েছে ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা, কেয়ারী ফুড, ইসলামী ব্যাংক চক্ষু হাসপাতাল, সান সিটি, দৈনিক সংগ্রাম, শতাব্দী প্রেস, আধুনিক প্রকাশনী প্রেস, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, সোনার বাংলা পত্রিকা, রাবেতা ইসলাম, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, ফুলকুড়ি, ফালাহ্ আম ট্রাস্টসহ ১০৯টি প্রতিষ্ঠান।
তদন্ত কর্মকর্তারা মতামতে বলেছেন, তদন্তকালে প্রাপ্ত ও উদঘাটিত সাক্ষ্যপ্রমাণ পর্যালোচনায় প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র বাংলাদেশে ২৫ মার্চ ১৯৭১ হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত অভিযুক্ত সংগঠন ‘জামায়াতে ইসলামী’ তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী এবং জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩ আইনে ৩(২) ধারায় অপরাধ করেছে। এ সময় তারা নয় ধরনের অপরাধ করেছে, যা প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। (এ) মানবতাবিরোধী অপরাধ, (সি) গণহত্যা, (ডি) যুদ্ধাপরাধ, (ই) জেনেভা কনভেনশন ১৯৪৯ অনুযায়ী সশস্ত্র সংগ্রামের সময় মানবতাবিষয়ক আইনের ভঙ্গন, (এফ) আন্তর্জাতিক আইনের অন্যকোন অপরাধ, (জি) এমন অন্যকোনো অপরাধের পদক্ষেপ গ্রহণ সেগুলোর সমর্থন আনা এবং ষড়যন্ত্র করা, (এইচ) এ রকম অপরাধের সহায়তা করা অথবা বোধ করতে ব্যর্থ হওয়া। এ ছাড়া ৪(১) ও ৪(২) উর্দ্ধতন দায় এবং এ সকল অপরাধের সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে। শুধুমাত্র সেকশন-৩ এর (বি) অংশ বাদ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া সব ধরনের অপরাধের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে দলটির বিরুদ্ধে নয় ধরণের অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে। নয় ধরনের অপরাধ ছাড়াও অপরাধের সময়কাল ছিল একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর। অপরাধের স্থান- বাংলাদেশের সর্বত্র। অভিযুক্ত সংগঠন- জামায়াতে ইসলামী (কেন্দ্র থেকে সকল স্তরের নেতৃত্ব)। তদন্তকাল- ২০১৩ সালের ১৮ আগস্ট থেকে ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত। তদন্তকালীন কর্মকর্তা- মতিউর রহমান। সর্বমোট ডকুমেন্ট- (ক) তদন্ত প্রতিবেদন ৩৭৩ পাতা, (খ) জব্দ দালিকা ও দালিলিক প্রমাণপত্র ৭ খ- মোট ২৩০৩ পাতা, (গ) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়, (ঘ) রিট পিটিশন, (ঙ) জামায়াতের বিরুদ্ধে পর্যবেক্ষণ, (চ) বিভিন্ন লেখকের বই-পুস্তক, গবেষণা পুস্তক, ম্যাগাজিন ইত্যাদি প্রায় দুই শতাধিক বই এবং (ছ) সর্বশেষ সাক্ষী।
নুরেমবার্গের পর এই প্রথম: তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক এমএ হান্নান খান বলেছেন, বিজয়ের মাসে তদন্ত সংস্থা এমন একটি মামলার তদন্ত রিপোর্ট দিতে যাচ্ছে যার জন্য দেশবাসী উৎসুক হয়ে আছে। নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনালের পর এই প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কোনো সংগঠনের বিরুদ্ধে তদন্ত সম্পন্ন করেছে। সব সময় সংগঠন নিষিদ্ধ হয় সরকারের নির্বাহী আদেশে। এই দল জামায়াতে ইসলামী আগেও চার বার নিষিদ্ধ হয়েছিল। এবারই প্রথম জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের পক্ষে হাইকোর্ট একটি রায় প্রদান করেছে। রায়টি এখন আপীল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। এটা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতার আগে ও পরে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে তদন্ত করা হয়েছে। আমরা প্রতিবেদনে জামায়াত নিষিদ্ধের আবেদন জানিয়েছি।
তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক জানিয়েছেন, একটি সংগঠন হিসেবে দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে আলবদর, আলশামস রাজাকার বাহিনী গড়া হয়েছিল। জামায়াতই একমাত্র সংগঠন যারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছিল। জামায়াতের প্রাইভেট সংগঠন ছিল আলবদর আর আলশামস। এটা আরও গুরুতর অপরাধ। এই মুহূর্তে জামায়াত ও তার অঙ্গ সংগঠনের বিচার চাই। পিডিবি, মুসলিমলীগসহ অন্যান্যদের বিষয়ে প্রয়োজন হলে ভবিষ্যতে দেখা যাবে।
সহযোগী সংগঠন: তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, আইন অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধে ব্যক্তির পর সংগঠনের বিচার তদন্তে এই প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে বৃহস্পতিবার। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের মূলত চারটি বিষয় নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে জামায়াতের রাজনৈতিক কৌশল, ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, শান্তির বিরুদ্ধে কৃত অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যা।
এ ছাড়া প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি সংগঠনকে সামনে রেখে জামায়াতের অপরাধ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জামায়াতের হাইকমান্ড (গোলাম আযম, মজলিসে শূরা), ছাত্র শাখা (ইসলামী ছাত্র সংঘ), জামায়াতের লিয়াঁজো কমিটি (শান্তি কমিটি), অপারেশন কমিটি (রাজাকার, আলবদর, আলশামস), প্রোপাগান্ডা (দৈনিক সংগ্রাম)।
এর আগে ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন রায়ে যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উঠে আসে। সর্বশেষ গোলাম আযমের রায়ে জামায়াতকে একটি ‘ক্রিমিনাল সংগঠন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। হান্নান খান জানান, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী ও তাদের তখনকার সহযোগী সংগঠনগুলো যে সারাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটিয়েছিল, তার প্রমাণ তারা তদন্তে পেয়েছেন। তদন্তের ভিত্তিতে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জেনেভা কনভেনশন ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র এবং এ সব অপরাধ ঠেকাতে ব্যর্থতাসহ নয় ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। এতে সাক্ষী করা হয়েছে ৭০ জনকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী, তাদের সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা দিতে গঠিত শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী এবং জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ৪ এর ১ ও ৪ এর ২ ধারা অনুযায়ী অপরাধ করেছে।
তিনবার নিষিদ্ধ জামায়াত: এর আগে জামায়াতে ইসলামীকে তিনবার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সর্বপ্রথম ১৯৫৯ সালে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এর পর ১৯৬৪ সালে দ্বিতীয়বার ও ১৯৭২ সালে তৃতীয়বার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে পলিটিক্যাল পার্টিজ রেগুলেশনের (পিপিআর) আওতায় রাজনৈতিক দল গঠনের অনুমতি দেয়া হয়। ১৯৭৯ সালের ২৫ মে একটি কনভেনশনের মাধ্যমে আবারও প্রকাশ্য রাজনীতিতে শিকড় গেড়ে বসে জামায়াত। নতুন নাম দেয়া হয় জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ।
২০১৩ সালে জামায়াতের শীর্ষ ৬ নেতাকে বিভিন্ন দণ্ড প্রদান করা হয়। এর মধ্যে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও সাবেক রোকন বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আযাদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। একই সঙ্গে সাবেক আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছরে কারাদণ্ড প্রদান ও আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
একই সঙ্গে রায়ের পর্যবেক্ষণে জামায়াতকে ‘অপরাধী সংগঠন’ (ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন) হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। জামায়াতের ৬ নেতার বিরুদ্ধে ঘোষিত রায়ের ৫টিতেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে পাকিস্তানী সেনাদের ‘সহযোগী বাহিনী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ সব রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল মুক্তিযুদ্ধকালীন নৃশংসতার জন্য পাকিস্তানী সেনাদের পাশাপাশি জামায়াতকেও দায়ী করেছেন।
প্রসিকিউশনের ভাষ্য: তদন্তকারীদের অন্যতম প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেছেন, তদন্ত শেষ হয়েছে। এ সংগঠনের বিরুদ্ধে যেসব অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে বিভিন্ন ধরনের সাজা হতে পারে। সংগঠনটি নিষিদ্ধ হতে পারে, তাদের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হতে পারে। নির্বাচন কমিশনের শর্ত পূরণ না করায় ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছে উচ্চ আদালত। তবে একাত্তরে ভূমিকার জন্য দলটিকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্যও জোরালো দাবি রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল হিসেবে কর্মকাণ্ড চালালেও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করার জন্য কখনই ক্ষমা চায়নি জামায়াত, বরং দলটির শীর্ষ নেতারা স্বাধীনতার পরও বলেছিলেন, একাত্তরে তাদের ভূমিকা সঠিক ছিল।
ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণ: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কয়েকটি রায়ের পর্যবেক্ষণে জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করে বিচারপতি বলেন, দেশের কোনো সংস্থার শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের থাকা উচিত নয়। ট্রাইব্যুনালের আগের রায়গুলোতেও জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দলটির সরাসরি সংশ্লিষ্টতার বিষয়গুলো উঠে আসে। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন থেকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ দল হিসেবে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি উঠে। জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার রায়ের পর গড়ে ওঠা এ আন্দোলনের পর আইন সংশোধন করে দলের বিচারের বিধানও যোগ করা হয়। আগের আইনে শুধু যুদ্ধাপরাধী ব্যক্তির বিচারের সুযোগ ছিল।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার সময় গোলাম আযমের ‘গুরু’ আবুল আলা মওদুদী বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় সেই ধরনের ভূমিকাই ছিল গোলাম আযমের। জামায়াত দুই সময়েই সাধারণ মানুষের মন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল মন্তব্য করে ট্রাইব্যুনাল দলটির দূরদৃষ্টির অভাবের পেছনে উগ্র মৌলবাদী চেতনাকেই চিহ্নিত করেছে। ‘স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও স্বাধীনতাবিরোধী কিছু মানুষ জামায়াতের হাল ধরে আছেন। যার ফলে জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতাবিরোধী চেতনা ও সাম্প্রদায়িক অনুভূতির মানসিকতায় বেড়ে উঠছে, যা দেশের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয়।’
ভুল স্বীকার করেনি: তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা যায়, ১৯৫১ সালের আহম্মদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে দাঙ্গা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী জামায়াতের রাজনৈতিক, সামাজিক কর্মকাণ্ডের দালিলিক তথ্যউপাত্ত রয়েছে তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদনে। গুরুত্ব দেয়া হয়েছে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদীর দর্শন ও আদর্শকে। তদন্ত সংস্থা অন্যান্য তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে যে সমস্ত বই রেখেছেন তার মধ্যে রয়েছে ‘জামায়াতের ইতিহাস’, ‘একটি জীবন একটি ইতিহাস’, ‘জামায়াত ফেৎনা স্বরূপ’ মাওলানা মওদুদী, মাওলানা নিজামীর বই ‘আলবদর থেকে মন্ত্রী’। এ ছাড়া পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর বইও রয়েছে। পত্রপত্রিকার মধ্যে রাখা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সমস্ত পত্রিকায় নিউজ ছাপা হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক পয়গাম, দৈনিক পাকিস্তান, দৈনিক অবজারভারসহ অন্যান্য ডকুমেন্টস।
তদন্ত সংস্থার ওই চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। কেবল বিরোধিতা করেই তারা ঠিক থাকেনি, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহায়তায় জামায়াতের নেতা ও কর্মীদের রাজাকার, আলবদর, আলশামস নিয়োগ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ সমস্ত সহযোগী বাহিনী দেশব্যাপী হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে। তাদের অত্যাচারে এক কোটি শরণার্থী পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়। ইতোমধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে নয়টি মামলায় দশ যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে। আরও শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিচার চলছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় অপরাধের ভুল স্বীকার করেনি জামায়াত। বরং স্বাধীনতার পর ১৯৮০ সালের ৭ ডিসেম্বর এবং ১৯৮১ সালের ২৯ মার্চ দ্বিতীয় সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত আমির আব্বাস আলী খান বলেছিলেন, একাত্তরে তাদের ভূমিকা সঠিক ছিল। শুধু তাই নয়, সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, একাত্তরে বাংলাদেশের কনসেপ্ট ছিল না। ওই সময় পকিস্তানের নাগরিক গোলাম আযমও বলেছিলেন ‘বাংলাদেশ মাটির নাম, আদর্শের নাম নয়।
ধর্মের বিকৃতিকারী জামায়াত: জামায়াত শিবির ধর্ম বিকৃতিকারী। জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের মগজে এই বুলি সর্বদা ঢুকানো হয় যে, জামায়াত শিবিরের কাজে জীবন দিলে শহীদ হয়ে বেহেস্তে যেতে পারবে, আর বাঁচলে হবে গাজী। তাইতো তাদের শ্লোগান, ‘মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী, আমরা সবাই মরতে রাজী’ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আলহাজ মিছবাহুর রহমান চৌধুরী বলেছেন,‘জামায়াত কোনো ইসলামী দল নয়, তারা কপট ও ভণ্ড’ ‘জামায়াতে ইসলামী ধর্মের নামে দেশের মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছে’।
চট্টগ্রাম নগরের জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আল্লামা মোহাম্মদ জালালুদ্দিন আলকাদেরী বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী বিভিন্ন সময়ে তাফসিরে ইসলামের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা সঠিক নয়।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের(ইফা) মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল বলেছেন, জামায়াত আর আলেম কখনো এক হতে পারে না। সত্যিকারের আলেম তারাই যারা জামায়াত ইসলামের সমর্থক নয়। তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলাম সবসময় আলেম সমাজকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। এই জামায়াত শিবির ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে সুদ কে পর্যন্ত জায়েজ করেছে।
যে দলটির স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শপথ নিয়েছিল এই বলে যে, I shall bear true allegiance to the constitution of Pakistan as framed by law and shall defend Pakistan, if necessary, with my life.” অর্থাৎ, “আমি আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের সংবিধানের প্রতি সত্যিকার আনুগত্য প্রদর্শন করব এবং জীবন দিয়ে হলেও পাকিস্তানকে রক্ষা করব। ১৯৭১ সালে এত খুন, এত অন্যায় ধর্ষণের পরেও তারা কিভাবে নিজেদের ইসলামী দল ভাবে!!!
ইতিহাসের দায় শোধ: রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল ছাড়া দেশে কখনোই বড় কোনো অবস্থানে ছিলো না জামায়াতে ইসলামী। তবে, মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে, দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব বিচারের মুখোমুখি হয়ে এখন ইতিহাসের দায় শোধ করছে। আর এই বিচার শুরু করে আওয়ামী লীগ যে শক্তি সঞ্চয় করেছে, তা দুর্বল করছে বিএনপিকে।
দেশের ইতিহাসবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ এমনই।
মানবতা বিরোধী অপরাধ আর বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতের শীর্ষ নেতারা সত্যের মুখোমুখি। সর্বশেষ রায়ে ফাঁসির দণ্ড বহাল রইলো দলটির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে। বর্তমান আমীর মতিউর রহমান নিজামীর আপীল আবেদনেও মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার আদেশ দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত। সময় যত গড়াচ্ছে প্রশ্ন উঠছে, যে দল আর তার কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অপরাধের এমন দায়, তাদের রাজনীতি আর আদর্শিক ভিত্তি নিয়ে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক আফসান চৌধুরীর মতে ধর্মভিত্তিক এই দলটি বর্তমানে ইতিহাসের দেনা শোধ করছে।
আর যুদ্ধাপরাধের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে যদি জার্মানীতে নাৎসি পার্টি নিষিদ্ধ হতে পারে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গত চার দশক ধরে জামায়াতের এই ফুলেফেঁপে ওঠাকে অত্যন্ত দূর্ভাগ্যজনক হিসেবে আখ্যায়িত করলে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)