তিনি একজন বাবা। তিনি কাঁদছেন তাঁর বাচ্চাদের নিরাপত্তা নিয়ে। তিনি কাঁদছেন। তাঁর কোলে কন্যা শিশুটি, অন্য হাতের আগলে ধরেছেন বাকি ছেলেমেয়েদের। বাবাকে জড়িয়ে ধরে আছে বাচ্চারা। কান্নারত, গ্লানিকর, মর্মভেদী এই ছবিটি সিরিয়ার এক দুঃখী বাবার। নাম লাইত মজিদ। আরো অনেকের মতো এই মাত্র গ্রীসে নেমেছেন তিনিও। কান্নারত বাবার এই ছবিটি ইন্টারনেটে অনেকের হৃদয় ভেঙ্গে দিয়েছে।
মজিদ শুধু একা নন। লিবিয়া, মিশর, গ্রিস, ইতালির সাগরতীরে এবং সার্বিয়া, হাঙ্গেরি মেসিডোনিয়ার পথে পথে এই রকম হাজার হাজার মজিদ মানসিক আঘাতে কাঁদছেন। নিজের দেশ, ঘর ছেড়ে অন্যের নিগ্রহের কারণ হয়েছেন।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে আসা শরণার্থীরা বেশিরভাগই যুদ্ধকবলিত সিরিয়ার। শরণার্থী ইস্যুতে ইউরোপ দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একভাগ বলছে বিপদগ্রস্ত এসব মানুষের প্রতি আমরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবো না কেনো? অন্য ভাগটি বলছে তারা শরণার্থী চায় না।
শরণার্থী এবং অভিবাসী ইস্যু ইউরোপে একটা র্স্পশকাতর বিষয়। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এটি ইউরোপের জাতিগত পরিচয়, সংস্কৃতি, ধর্ম ইত্যাদির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এমন বিশ্বাস অনেক ইউরোপিয়ানদের। যার কারণে ইউরোপের অনেক দেশে অভিবাসী বিরোধী অনেক রাজনৈতিক দলের উত্থান হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। নেদারল্যান্ড, সুইডেন, জার্মানি, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, নরওয়ে ইত্যাদি দেশে অভিবাসী বিরোধী এইসব নতুন দলগুলো বড় আকারের ভোট পেয়ে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে।
ভিয়েনার রেলস্টেশনে শরণার্থীদের জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষমান তরুণ মানবাধিকার কর্মীরা।
দু’দিক থেকে শরণার্থীরা ঢুকছে ই্উরোপে। বলকান এলাকা হয়ে সার্বিয়া, মেসিডোনিয়া হয়ে হাঙ্গেরিতে ঢুকলেই ইউরোপের সেনজেনভুক্ত দেশগুলো যেমন জার্মানি, সুইডেন, নরওয়ে ইত্যাদি দেশে যাওয়া যায়। অন্য পথটি হলো ভূমধ্যসাগর হয়ে গ্রিস, ইটালিতে ঢুকলে সেনজেন সীমানায় ঢুকে পড়া যায়। সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং আফ্রিকার যুদ্ধকবলিত ও দারিদ্র্যক্লিষ্ট দেশ থেকে এসব অভিবাসীরা ইউরোপে ঢুকছে।
ভূমধ্যসাগরে নৌকা ঢুকে এসব অভিবাসীদের মৃত্যুর ঘটনা অহরহ ঘটছে যা নিয়ে ইউরোপে এবং আন্তর্জাতিকভাবে অনেক প্রতিবাদ, সমালোচনা হচ্ছে। জার্মানিতে অন্যান্য দেশের চেয়ে শরণার্থী আসছে বেশি। গত ডিসেম্বরে জার্মানির ড্রেসডেন শহরে অধিবাসী বিরোধী বিশাল র্যালি হয়। যেখানে একজন জার্মান বলেন, এমনভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০ বছরে জার্মানি হয়ে যাবে বহিরাগতদের দেশ। যা আমরা চাইনা।
ইউরোপে এবং আর্ন্তজাতিকভাবে জার্মানির ওই র্যালি নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা হয়। পরে অবশ্য জার্মান কর্তৃপক্ষ এ ধরনের র্যালি করার অনুমতি বন্ধ করে দেয়। বার্লিনের অধিবাসী মার্টিন কুপের বলেন, কিছু মানুষ নিজের দেশে বাড়ি হারিয়েছে এবং যুদ্ধের কারণে তাদের জীবন সঙ্কটের মুখে, এমন মানুষকে আমরা আশ্রয় দিচ্ছি, আর জার্মানদের প্রতিবাদ র্যালি বের করার আইডিয়াটা ছিলো একটা ‘ন্যাক্কারজনক’ আইডিয়া।
ইইউ সীমান্ত সংস্থা ফ্রনটেক্স’র তথ্যমতে, এ বছর শুধু জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৩ লাখ ৪০ হাজার শরণার্থী এবং অভিবাসী অবৈধভাবে ইউরোপে ঢুকেছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের দেয়া তথ্য অনুসারে, ৩ লাখ শরণার্থী এবং অভিবাসী ২০১৫ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছে। যা ২০১৪ সালে পুরো বছরে ছিলো ২ লাখ ১৯ হাজার। প্রায় আড়াই হাজার লোক এ বছর এ পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরে মারা গেছে; যা ২০১৪ পুরো বছরে ছিলো সাড়ে ৩ হাজার।
২০১৩ এবং ২০১৪ সালে বিভিন্ন দেশ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় আবেদনকারী লোকসংখ্যার তালিকা
জাতিসংঘের দেয়া তথ্যমতে, সাগর পাড়ি দিয়ে যারা ঢুকছে তাদের মধ্যে ৪৩% সিরিয়ান, ১০% এরিত্রিয়ান, ৫% নাইজেরিয়ান, ৩% সোমালিয়ান এবং অন্যান্য দেশের ১০%। তবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যারা ইটালি আসছে তাদের ১০ জনে ৯ জন আফ্রিকান।
সিরিয়ান যুদ্ধ পরিস্থিতিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় মানবিক সঙ্কট আখ্যা দিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে বেসামরিক জনগণ, বিশেষ করে শিশু, নারীদের সুরক্ষা দিতে দেশগুলোর প্রতি আহবান জানায় ইইউ।
ইউরোপিয়ান কমিশন জানিয়েছে, সিরিয়ায় ১ কোটি ২২ লাখ বেসামরিক লোকের মানবিক সাহায্য দরকার। ৪০ লাখের বেশি সিরিয়ান শরণার্থী তুরস্ক, মিশর, লেবানন, জর্ডান ও ইরাকে শরণার্থী ক্যাম্পে আছে। যাদের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছে গত ৪ বছর ধরে।
গত আগস্টে অবশ্য জার্মানি ওই ইস্যুতে ইইউ আইন ভেঙ্গে সিরিয়ান শরণার্থী নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ইইউ শরণার্থী আইন যা ডাবলিন রেজুলেশন নামে পরিচিত, সেখানে বলা হয়েছে, অভিবাসীরা প্রথম যে দেশে অবতরণ করে সেই দেশে আশ্রয়ের আবেদন করতে পারে। ওই দেশে যদি আবেদন নাকচ হয়ে যায়, আবার অন্য দেশে গিয়ে আবেদন করলে তাকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
কিন্তু জার্মানি ওই আইন মানছে না। বার্লিনে অভিবাসী ইস্যুতে ফ্রান্সের ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদের সাথে জরুরী বৈঠকের পর এই সিদ্ধান্ত নেন জার্মানীর এঞ্জেলা মারকেল। জার্মানির ওই ঘোষণার পর পরই কিন্তু সিরিয়ান শরণার্থীদের সার্বিয়া-মেসিডোনিয়া-হাঙ্গেরি হয়ে জার্মানিতে ঢোকার হিড়িক পড়ে যায়।
ভিয়েনায় শরণার্থীদের স্বাগত জানিয়ে র্যালি
গত সপ্তাহে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সীমানায় একটি পরিত্যক্ত লরিতে ৭১ শরণার্থীর মরদেহ পাওয়া যাওয়ার পর অস্ট্রিয়ার লোকজন মর্মব্যথী হয়ে পড়েন। অনেকে বলেন এসব অসহায় মানুষগুলো আমাদের কাছে আশ্রয়ের জন্য এসেছিলো। এ রকম অমানবিকভাবে কোনো মানুষকে মরতে দেয়া যায় না। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে তাই র্যালি বের করা হয়। যেখানে ৩০ হাজারেরও বেশি লোকজন অংশ নেয়। র্যালিতে ‘শরণার্থী স্বাগতম’ বলে শ্লোগান দেয়া হয়। শরণার্থী এবং অভিবাসীদের মানবিক সাহায্য দেয়ার জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতি দাবি জানানো হয়।
ভৌগলিক অবস্থানের কারণে ইউরোপ মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, এশিয়া সবদিক থেকে অভিবাসী চাপের মুখে পড়েছে। সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে প্রচুর পরিমাণ লোক দেশ ছাড়ছে। ইউরোপের অভিবাসী সমস্যার সবচেয়ে বড় কারণ ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়ার যুদ্ধ।
অনেকে বলতে শুরু করছে, সাদ্দামের ইরাক কিংবা গাদ্দাফির লিবিয়া অনেক ভালো ছিলো। অন্তত দেশগুলোর লোকজনের একটা আশ্রয় ছিলো। আবার অনেকে বলছে এসব যুদ্ধের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত যুক্তরাষ্ট্র শরণার্থী সমস্যা থেকে অনেক দূরেই আছে। সব সমস্যা যেন ইউরোপের। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নিজেই বুঝতে পারছে না কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করবে।