চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

আসুন, গা ঘেঁষে দাঁড়াই!

‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ স্লোগান সম্বলিত একটি টি-শার্ট বের করেছে একটি অনলাইন শপিং প্লাটফর্ম “BJNS’ – বিজেন্স”। আর যায় কোথায়, একদল মানুষ তেতে উঠেছে, তারা এই স্লোগানের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে! অনেকের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছে, তাদের বাড়া-ভাতে ছাই পড়েছে! কুকুরের লেজে আগুন লাগলে যেমন প্রাণীটি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে লেজকে কেন্দ্র করে চড়কির মতো ঘুরতে থাকে, ঠিক তেমনি একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষ স্লোগানটির বিরুদ্ধে উগ্র হয়ে উঠেছে।

উদ্যোক্তাদেরও দোষ আছে। দুনিয়ায় কত শত বিষয় থাকতে ‘গা ঘেঁষে’ দাঁড়ানো নিয় স্কেলোগান কেন? আর আমরা গা ঘেঁষে দাঁড়াব না-ই বা কেন? এই জন্যই কি ত্রিশ লক্ষ শহিদ প্রাণ দিয়েছিল? স্বাধীন দেশে আমি যেভাবে খুশি সেভাবে দাঁড়াব, শুধু গা ঘেঁষে কেন, প্রয়োজনে গায়ের উপর দাঁড়াব, কোলে উঠব, ঘাড়ে চড়ব— তাতে কার বাবার কী? আমরা ব্যাটা, পুরুষসিংহ! আমরা নারীকে নিয়ে যা খুশি তাই করব। ‘শরীর আমার সিদ্ধান্ত আমার!’ আমি দাঁড়াব, গাঁ ঘেঁষে দাঁড়াব, গা ফেরে দাঁড়াব, যেভাবে খুশি সেভাবে দাঁড়াব!

উদ্যোক্তারা বলেছেন, এই টি-শার্ট পরলেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে না।

তাই যদি হয়, তাহলে কেন এই স্লোগান? ঘা দেয়ার জন্য? সতর্কতা-সচেতনতার জন্য ? আলোড়ন তোলার জন্য?

কোনো লাভ নেই, কুকুরের লেজ আর লম্পটের মন কিছুতেই পরিবর্তন হবার নয়! মানুষের খাসলত সহজে পরিবর্তন হয় না । কিছু মানুষ চোখ দিয়ে, মগজ দিয়ে, হাত-পা-মাথা দিয়ে নারীদের ধর্ষণ করবেই। যৌন নির্যাতন করবেই! চান্স পেলে তাদের খুবলে খাবেই। এই শ্রেণির মানুষেরা মেয়েদের গায়ে পড়বে, কাছে যাবে, পড়ে যাবার ভান করবে, শরীর ছোঁয়ার চেষ্টা করবে, পারলে কচলে-ছিবড়ে ফেলবে! তাদের গা ঘেঁষে  না দাঁড়ানোর প্রস্তাব দিলে তারা মানবে কেন?

মানবে না বলেই ‘গা ঘেঁষে দাড়াবেন না’ শীর্ষক স্লোগান লেখা টি-শার্টের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করার পর থেকে হইচই শুরু হয়েছে! আপলোড করা ছবিগুলো থেকে কয়েকটিকে এডিট করে ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ এর স্থলে অশ্লীল কিছু বাক্য যুক্ত করে বিভিন্ন ফেসবুক আইডি থেকে পোস্ট করা হয়েছে এবং মূল ছবিগুলোর চেয়ে ভুয়া ছবিগুলো সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে বেশি! অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে সেই অশ্লীল বাক্যযুক্ত ছবিগুলোকে ‘সত্য’ বলে ধরে নিয়েছেন, এবং এমন কার্যকলাপের সমালোচনা করছেন।

অবশ্য কেউ কেউ সামাজিক মাধ্যমেই জানাচ্ছেন, মূল স্লোগান ও ছবিগুলোতেই তাদের আপত্তি রয়েছে! অর্থাৎ, বাস বা রাস্তাঘাটে নারীর ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’- এমন বাক্যেই তাদের আপত্তি!

অবশ্য খুবই সাধারণ একটি স্লোগানকে বিকৃত করে নোংরা বাক্য জুড়ে দিয়ে প্রচার চালানো থেকেই বোঝা যায় যে, অযাচিতভাবে নারীর গা ঘেঁষে দাঁড়ানোর ব্যাপারে মানা করায় অনেকের আপত্তি রয়েছে। আপত্তি না থাকলে এমন সাধারণ একটি বাক্য নিয়ে নোংরা প্রচারণার প্রয়োজনই ছিল না।

কথা হলো আমাদের দেশে এক শ্রেণির মানুষ যে ইচ্ছে করে মেয়েদের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়, যৌন নির্যাতন করে, এটা অস্বীকার করা যাবে কি? এই ঘটনার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যম হিসেবে টি-শার্টে ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ স্লোগান লিখে কেউ প্রচার চালাতেই পারে। কারও এই প্রচারণার ধরন পছন্দ না হতেই পারে। কিন্তু এই লেখাটা এডিটিং করে নোংরামি করছে একশ্রেণির মানুষ নোংরা ভাষার ব্যবহারের মাধ্যমে। ভাষাগুলো এতোটাই নোংরা যে বলার মত না। এটা আমাদের দেশের সামাজিক মানুষের নারীর প্রতি বিদ্বেষেরই বহির্প্রকাশ।

প্রশ্ন হলো সামান্য এক টি-শার্ট নিয়ে এক শ্রেণির মানুষের এত আর্তনাদ কেন? কেন কেউ কেউ বলছেন, যারা টি-শার্ট পরবে তাদের গায়ে ধাক্কা মারা বা ঘেঁষে দাঁড়ানোটা জায়েজ! বাসে চড়তে হলে নাকি ঘেঁষে ঘেঁষেই থাকতে হয়। এটা সহ্য না হলে যেন প্রাইভেট গাড়িতে চলাচল করে।

কী সাংঘাতিক কথা! আপনার উপর আমি দস্যুপনা করব, সম্মানহানি ঘটাব, অযাচিত স্পর্শ করব অথচ আপনি কিছু বলতে পারবেন না!

আমাদের দেশে এক শ্রেণির মানুষ ভীষণরকম নারীবিরোধী। তারা তনুর দোষ খুঁজে পেতে উদগ্রীব ছিল, এমনকি নুসরাতেরও! তারা কেবল নারীর খুঁত ধরে! তাদের পোশাক আর আচরণ নিয়ে নানা কটূ মন্তব্য করছে। সে সব মন্তব্যে নারীর প্রতি ক্ষোভ, অশ্রদ্ধা আর বিদ্বেষই কেবল প্রকাশ পায়। নারীর প্রতি এই মানসিকতা আসলে একটা সামাজিক অসুখ। সমাজ নির্মিত, পুরুষ নির্মিত সামাজিক বিধি-বিধান নারীরা না মানলেই এই পুরুষরা তেতে উঠে। নারীর পোশাক ও অভ্যাস চিরাচরিত  সামাজিক ব্যবস্থার থেকে বিচ্ছিন্ন  হয়ে পড়লে তার প্রতি চোটে যায়! ক্ষিপ্ত হয়। মেয়েদের যে পোশাক সমাজ মানসিকতার বিরুদ্ধাচরণ করে তা পুরুষদের ক্রোধ উৎপাদন করে।

মেয়েদের কোন পোশাকে দেখতে ঠিক কেমন লাগবে তার জনমত  নির্ধারিত একটা গ্রাফ আছে। রাজনৈতিক ভাবেও গুরুত্ব অর্জন করতে হলে প্রথমেই মেয়েদের লক্ষ্মণরেখায় বন্দি হতে হয়। তার ক্ষমতা নয়, সামাজিক কাপুরুষতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার মধ্যেই তার সনাতন ‘ভালো মেয়ে’র স্বীকৃতি লুকিয়ে থাকে। সমাজের পক্ষে  একমাত্র সেই  নারীরই কল্যাণকর  যিনি পোশাকে নম্র, আচরণে বিনয়ী এবং নিশ্চিত ভাবে ঘরোয়া। এবং যার কোনো পুরুষের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই !

অনেক পুরুষ উচ্চকিত হয়ে বলে, নারীদের কেউ কেউ নাকি পুরুষদের মোহিত করার জন্যই সাজে, পোশাক পরে। যারা মোহিত হবেন বা হন তারা কিন্তু ‘নিষ্পাপ’! মোহিত হওয়ার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। কারণ, সেটা তাদের ‘জন্মগত অধিকার’। জনতার একাংশের এই দৃষ্টিভঙ্গী ভয়াবহ। শালীনতার দায় শুধু মেয়েদের ঘাড়ে তুলে দিয়ে তাদের বাকি ক্ষমতা বা কৃতিত্বকে একরকম জলাঞ্জলি দেওয়ার খুঁটিতে জোর ধাক্কা দেওয়ার কেউ নেই।

পোশাক কখনও মেয়েদের ভালো-মন্দের দলিল নয়। অহঙ্কার, ঔদ্ধত্য বা নম্রতার সঙ্গেও যুক্ত নয়। পোশাকের সঙ্গে মেয়েদের স্বকীয়তা, আত্মমর্যাদা বা প্রদর্শনেরও কোনও সম্পর্ক নেই। আছে পছন্দ, প্রাচুর্য ও স্বাচ্ছন্দ্যের সহজ সাযুজ্য। অথচ শুধু নারীর পোশাকের বৈচিত্র্যের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে হাজারও শব্দ, বাক্য। অপমানসূচক উক্তি।

আসলে মাথার চুল থেকে মেক-আপ, কপালের টিপ থেকে নোজ-পিনের আয়তন, জুতোর হিল থেকে পোশাকের হাত বা পিঠের দৈর্ঘ্য, লিপস্টিকের রং থেকে দেহের মাপ অনুযায়ী পোশাক কিংবা ওড়নার নির্বাচন সবটাতেই মিশে আছে এক সামাজিক অসুখ।

এই রোগের কোনও নিরাময় নেই। তার মূল কারণ সামাজিক ভণ্ডামি, সাংস্কৃতিক দ্বিচারিতা। যে সমাজ একাধারে শেখায় মেয়ে, তোমার চেহারা মূল্যবান। সেই চেহারা নিয়ে মেয়েরা যত্নশীল হয়ে পড়ে। স্বাধীনভাবে আকর্ষণীয় করে তুলতে চায় নিজেকে। তখনই একটা মস্ত দাঁড়ি টেনে দেওয়া হয়। বলে দেওয়া হয়, ‘‘এত দূর যাওয়ার অনুমতি নেই। গেলে আর তুমি আদর্শ নারী হতে পারবে না।’’

একটি মেয়ে তার পেশাগত ক্ষেত্রে সাফল্যের শিখরে পৌঁছলেও সমাজ মনে করে, যোগ্যতায় নয়, আসলে মেয়েটি তার শরীর ব্যবহার করেছে বলেই সফল! ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার হলেও বলে, দোষ তো তোমারই, এক হাতে তালি বাজে না!

এমন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার দেশে নারীর সম্মান মর্যাদাবিরোধী স্লোগানই তো কাম্য ! এখানে স্লোগান হবে: হে নারী তুমি সংযত হও, তুমি পর্দা কর। এখানে স্লোগান হবে: শুধু গা ঘেঁষে নয়, ঠেসে দাঁড়ান!

চরিত্রহীন লম্পটদের জন্য এমন স্লোগান না হলেই কিন্তু বিপদ!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)