পাবার আনন্দে উদ্বেল মন
হারানোর বেদনায় বিষণ্ণ
২৭ আগস্ট সকাল দশটা থেকে শুরু হলো মাইকিং এবং বাবার ছবি, তথ্যসহ লিফলেট বিতরণ। পাশাপাশি চলছে খোঁজাখুঁজি। দুপুর আনুমানিক দুইটার দিকে একটা ফোন পেলাম। লোকটি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফুটপাতের দোকানদার। তিনি জানালেন, বাবাকে নাকি গতরাত আটটার দিকে দেখা গেছে তার দোকানের সামনে। একটা পাউরুটি খেতে দিয়েছেন। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ার কারণে তিনি পাকা বাজারের একটা দোকানের নিচে রেখে এসেছেন। আমরা অনেকটা নিশ্চিত যে বাবা আশপাশেই আছেন। প্রয়োজন শুধু তন্নতন্ন করে খোঁজা। সবাই মিলে খোঁজা হচ্ছে। বিকাশ খুঁজছে। সঞ্জয় খুঁজছে। নাদিম, ইদ্রিস আর অভিও খুঁজছে।
দিনের আলো গিলে খেয়ে সন্ধ্যা নামছে। শেরেবাংলানগর থানায় নিখোঁজ বাবাকে খোঁজার দায়িত্বরত কর্মকর্তার কাছে ফোন করলাম। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, আমি আজ সময়ের অভাবে আপনার বাবাকে খুুঁজতে যেতে পারিনি। রাগে-ক্ষোভে-দুঃখে ভেতরটা জ্বলে যেতে লাগল। বাবা বেঁচে আছেন এটা এখন আমার কাছে অলৌকিক ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই কষ্ট গিলে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, আপনারা আমার বাবাকে জীবিত ফিরিয়ে না দিতে পারলেও অনন্ত লাশটা দিন। প্লিজ। ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে গেল।
বাবা কি বেঁচে আছেন? খুব কান্না পাচ্ছে। হতাশা বাড়ছে। বুকের ভেতর ভাঙচুর শুরু হয়েছে। স্মৃতিশক্তি হারানো বাবা এখন কোথায় আছেন? কি খাচ্ছেন? কোথায় ঘুমোচ্ছেন? বেঁচে আছেন না মরে গেছেন? মরে গেলে কি লাশটা পাব? শেষ দেখা কি হবে না বাবার সঙ্গে?
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যম্পাস দিয়ে এলোমেলো হাঁটছি। এক পথচারীকে বাবার ছবি দেখাতেই তিনি বললেন, এই লোকটা তো মহাখালী ফ্লাইওভারের ওপর বসে আছে। ওদেরকে খুঁজতে বলে আমি ছুটলাম মহাখালী। ফ্লাইওভারের এপাশ থেকে ওপাশে গেলাম। আসার সময় ফ্লাইওভারের নিচটাও ভালো করে দেখলাম। না, কোথাও বাবাকে চোখে পড়ল না। মহাখালী থেকে ফেরার পথে নাদিমকে ফোন করে জানতে পারলাম গত রাত সাড়ে এগারোটায় বাবা আগারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছিলেন। আজ বিকাল চারটার দিকে বাবাকে শেষবারের মতো দেখা গেছে তালতলা বাসস্ট্যান্ডে। ওরা প্রাণপণ খুঁজে চলছে।
একদল মিরপুর দশ থেকে আগারগাঁওয়ের দিকে আসছে। আরেক দল আগারগাঁও থেকে মিরপুর দশের দিকে যাচ্ছে। আমি নাদিমদের সঙ্গে যোগ দিলাম তালতলাতে। সবাই মিলে অলিগলি খুঁজছি। রাত সাড়ে ন’টার দিকে আমাদের সঙ্গে যোগ হলেন অফিস কলিগ রনি ভাই। নাদিম, ইদ্রিস আর অভি চলে গেল এগারোটার দিকে সাইকেল নিয়ে খুঁজবে বলে। রনি ভাই, বিকাশ, সঞ্জয় আর আমি তখনো খুঁজে চলছি। শরীর আর কোনোভাবেই চলছে না। হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। যতই সময় গড়াচ্ছে ততই বুকের ভেতর হতাশার পাল্লা ভারী হচ্ছে। পেয়েও যেন বাবাকে পাচ্ছি না। রাত এগারোটার দিকে সাইকেল নিয়ে ফিরে এল নাদিম, ইদ্রিস আর অভি। খুঁজতে খুঁজতে মিরপুর দশে গিয়ে রাত বারোটার দিকে বিদায় জানালাম রনি ভাইকে। এরপর ঘণ্টা চুক্তিতে রিকশা ভাড়া করে, সাইকেল নিয়ে খোঁজা হলো রাত তিনটা পর্যন্ত। সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ। মিরপুর দশ পেরিয়ে গেলে বাবাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। সারা দিনের ধকল কারোরই শরীর নিতে পারছে না। সবাই মিলে এক জায়গায় বসে সিদ্ধান্ত নিলাম আগামীকাল সকালে মিরপুর দুই থেকে ষাট ফিটের রাস্তা হয়ে রেডিও পর্যন্ত লিফলেট বিলি করবে একদল। অন্যদল মিরপুর দশ থেকে আসবে আগারগাঁও পর্যন্ত। মাইকিং চলবে। ঘণ্টাচুক্তি রিকশা ভাড়া করেও বাবাকে খোঁজা হবে সকাল থেকে। তবে যত সকাল সকাল বের হওয়া যায় ততই ভালো।
২৭ আগস্ট। সকাল সাতটায় আমি সঞ্জয়কে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। গত রাতের পরিকল্পনা অনুযায়ী মিরপুর দুই থেকে দশ পর্যন্ত লিফলেট দিতে দিতে আগারগাঁওয়ে এলাম। ওদিকে গিন্নি আর বিকাশ মিরপুর দুই থেকে ষাট ফিটের রাস্তা হয়ে এল রেডিও পর্যন্ত। বেলা সাড়ে দশটার দিকে মাইক নিয়ে রিকশা এলো। আমি রিকশায় সঞ্জয়কে তুলে দিয়ে ঘণ্টাচুক্তিতে রিকশা ভাড়া করে ঘুরতে থাকলাম অলিগলি। হঠাৎ করেই অচেনা নাম্বার থেকে একটা ফোন এল আপনার বাবাকে পাওয়া গেছে। শরীর খুবই দুর্বল। ওনাকে আমরা বসিয়ে রেখেছি। ইকবাল রোডে পানির পাম্পের কাছে আপনি চলে আসুন।
শরীরের ভেতর বিদ্যুৎ খেলে গেল খুশির খবরে। পরক্ষণেই ফুটো করে দেয়া বেলুনের মতো চুপসে গেল মনটা। আমি কি আবার কোনো প্রতারণার শিকার হতে যাচ্ছি? বুকে আশা বেঁধে রিকশাঅলাকে রিকশা ঘুরিয়ে সোজা মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে যেতে বললাম। গিন্নি আর বিকাশকে ঠিকানা দিয়ে দ্রুত চলে যেতে বললাম। সঞ্জয়কে ফোন করে জানিয়ে দিলাম খবরটা। মোহাম্মদপুর আমার এক অফিস কলিগ থাকে। ওর মোটর সাইকেল আছে। ওকে ঠিকানা দিয়ে দ্রুত বাবার কাছে পৌঁছাতে বললাম।
সবার আগে আমি পৌঁছালাম ইকবাল রোডে। একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছেন বাবা। লুঙ্গি পরা, খালি গা। পায়ে কোনো স্যান্ডেল নেই। কেউ একটা জামা দিয়েছেন সেটা চেয়ারের পেছনের রাখা। আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। অনেকক্ষণ কাঁদলাম। তার গায়ে কোনো দুর্গন্ধ নেই। শরীরে কোনো ময়লা নেই। তাহলে বাবা কোথায় ছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর সারা জীবন আমার কাছে অজানা থেকে যাবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, বাবা, আমাকে চিনতে পেরেছেন? বাবা বললেন, তুই তো আমার ছেলে। আমি লোকজনের সাহায্য নিয়ে বাবাকে রিকশায় তুললাম। তারপর সোজা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। গিন্নি, সঞ্জয়, বিকাশ আমার ফোন পেয়ে ইকবাল রোডে না গিয়ে অপেক্ষা করছিল হাসপাতালের গেটে। হুইল চেয়ার নিয়ে বাবাকে জরুরি বিভাগে দেখিয়ে সোজ নিয়ে গেলাম ১ নং ওয়ার্ডে। অধ্যাপক ডাঃ সালাউদ্দিনের তত্ত্বাবধানে বাবার বেড হলো এক্স-৩৪। ডাক্তারদের ডেকে আনা হলো। তারা দেখেশুনে একদিন স্যুপ খেতে বললেন। আস্তে আস্তে শক্ত খাবার দিতে বললেন। অনেকগুলো টেস্ট দিলেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, রুগীর দুর্বলতা থাকলেও ভালো আছেন। টেস্টগুলো করালেই আমরা সবকিছু বুঝতে পারব।
আমি পরিচ্ছন্নতা কর্মী ধরে রক্তের টেস্টগুলো করিয়ে নিলাম। পরদিন এক্সরে, আল্ট্রাসনো করানো হলো। সব রিপোর্ট ভালো হলেও কিডনীর রিপোর্টটা খারাপ এল।
শেরেবাংলানগর থানায় গিয়ে আমি বাবার খোঁজ পাওয়ার খবর জানালাম। পুলিশ বাবাকে খুঁজে বের করতে পারেনি। আমি পেরেছি। আমার ভেতর জেদ কাজ করেছে বাবাকে খুঁজে বের করার। পুলিশের চেষ্টা থাকলে তারাও পারতেন।
সামনে ঈদ। ডাক্তাদের সংখ্যা কম থাকবে। তাই হাসপাতাল থেকে অধিকাংশ রুগীদের ছাড়পত্র দেয়া হচ্ছে। আমার বাবাকেও ছাড়পত্র দেয়া হলো ৩০ তারিখে। কি কি ওষুধ চলবে তারও একটা ব্যবস্থাপত্র দিয়ে দিলেন ডাক্তারা। ঈদের পর কিডনীর একটা টেস্ট করিয়ে আবার যোগাযোগ করতে বললেন।
বাবাকে বাসায় নিয়ে এলাম। তিনি সুস্থ, স্বাভাবিক। খাওয়া-দাওয়া, চলা-ফেরা সবই। তবে কোনো কোনো সময় মানুষ চিনতে ভুল করছেন। ঈদের পরদিন বাবাকে নিউরোসাইন্স হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার সবকিছু দেখেশুনে আবার একটা সিটিস্ক্যান করাতে বললেন। আমরা সঙ্গে সঙ্গে টেস্টটি করিয়ে আনলাম। তিনজন ডাক্তার অনেকক্ষণ সিটিস্ক্যানের প্লেট দেখলেন। তারা বললেন, আগের চেয়ে বাবা নাকি অনেকটা ভালো। খুব তাড়াতাড়ি তিনি ভালো হয়ে যাবেন। ওষুধ লিখে দিলেন। গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে বললেন যাতে চেনাশুনা জায়গায় গেলে দ্রুত তার স্মৃতিশক্তি ফিরে আসে।
নির্ধারিত দিনে বাবাকে আবার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে কিডনী পরীক্ষা করানো হলো। এবার পরীক্ষার ফলাফল ভালো। ডাক্তার আগের ওষুধই চালিয়ে যেতে বললেন। এরপর বাবার হার্টের সমস্যার জন্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের কার্ডিওলজি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ গোবিন্দ্র চন্দ্র রায়কে দেখানো হলো। সবকিছু দেখেশুনে তিনি ওই একই ব্যবস্থাপত্র মত ওষুধ খেতে বললেন।
১০ সেপ্টেম্বর বাবা-মা গ্রামের বাড়িতে চলে গেলেন। এরপর প্রত্যেকদিন কয়েকবার করে খোঁজ-খবর নেই বাবা কেমন আছেন। ভালোই চলছিল। এল ২১ সেপ্টেম্বর। নিয়মমতো সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাড়িতে ফোন করি। বাবা তখন সকালের প্রার্থনা করছিলেন। বাবার সঙ্গে কথা হলো না। মার সঙ্গে কথা বলেই জানতে পারলাম বাবা ভালোই আছেন। আমি প্রতিদিনের মতো অফিসে এলাম। কিছুক্ষণ পরে বাড়ি থেকে মায়ের ফোন এল তোর বাবা এখন ক্লিনিকে। সকালে খাওয়া-দাওয়া করার পর বুকে ব্যথা অনুভব করে। জিহ্বার নিচে বড়ি দেয়ার পরও বুকের ব্যথা না কমায় ক্লিনিকে নিয়ে এসেছি। এখনো বুকে খুব ব্যথা। আমি বললাম, ডাক্তার কী বলছেন? মা বললেন, দুটো ইনজেকশান দিতে হবে। আমি বললাম, কোনো অসুবিধা হলে খুলনা আড়াইশ বেডের হাসপাতালে নিয়ে যাও। মা আমার সঙ্গে কথা বলছেন। তখনই ডাক্তার ভারগন আর প্যাথেড্রিন পুশ করলেন বাবার শরীরে। মা বললেন, এইমাত্র ডাক্তার ইনজেকশান দিয়ে গেলেন। তোর বাবা যেন কেমন করছে। তুই ফোন রাখ, পরে আমি কথা বলছি।
আমার ভেতর অস্থিরতা। দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে। আমি আবার ফোন করলাম মাকে। ফোন ধরল আমার ছোট বোন। কাঁদতে কাঁদতে বলল, বাবার পালস পাওয়া যাচ্ছে না। কেটে গেল লাইনটা। পাঁচ মিনিট পরে আবার ফোন করলাম। এবার ফোন ধরল আমাদের এক গ্রামবাসী। তিনি জানালেন, তোর বাবা আর নেই। ২১ আগস্ট রাতে বাবা মস্তিস্কের রক্তক্ষরণে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ঠিক তার একমাস পর ২১ সেপ্টেম্বর বাবা হারিয়ে গেলেন। এবার সত্যি সত্যি চিরদিনের মতো বাবা নিখোঁজ হলেন।
কোনো সন্তানের বুক থেকে কি বাবা হারিয়ে যান? না, কোনো বাবাই হারিয়ে যান না। বুকের গভীরে সযত্নে বসবাস করেন আমৃত্যু। আমার বাবাও বেঁচে আছেন, আমার বুকের গভীরে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)