শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বের জন্যই দুর্নীতি এক বিরাট সমস্যা। বিশ্বজুড়ে নানারকম দুর্নীতি হরহামেশা ঘটলেও কিছু ঘটনা রয়েছে যা ইতিহাসের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। তেমনই কিছু ঘটনার মধ্যে আলোচিত কয়েকটি নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের এই আয়োজন।
অপারেশন কারওয়াশ
২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি অভিজ্ঞ পুলিশ কর্মকর্তা নিউটন ইশি ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোর গ্যালিও বিমানবন্দরে এক ধনী আসামীকে পাকড়াও করার জন্য যখন মাঝরাতে অপেক্ষা করছিলেন, তিনি আক্ষরিক অর্থেই ভাবতেও পারেননি কত বড় একটা ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি।
ব্রাজিলের জাতীয় তেল কোম্পানি পেট্রোব্রাস-এর এক সাবেক নির্বাহী নেস্টর সারভেরো লন্ডন থেকে ফিরছিলেন দেশে। ব্রাজিলের মাটিতে পা রাখার সাথে সাথেই দুর্নীতির দায়ে তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ ছিল ইশির ওপর। গ্রেফতারের পর সারভেরোও বিশ্বাস করতে পারেননি বিষয়টি। বারবারই ভাবছিলেন কোথাও ভুল হচ্ছে। অভিযুক্তের ভাই আর আইনজীবীকে ফোন করা হয়। ইশি-সারভেরো দু’জনেই নিশ্চিত ছিলেন – রাত পেরোনোর আগেই জামিনে ছাড়া পাবেন তিনি।
কিন্তু সব ধারণা ভুল প্রমাণ করে এটি হয়ে গেল প্রথমে ব্রাজিল, এবং পরে বিশ্বের ইতিহাসে এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় দুর্নীতির ঘটনা।
‘লাভা জাতো’ (কারওয়াশ) কোডনেম দেয়া এই মামলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ৫শ’ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থের অবৈধ লেনদেনের তথ্য, যার সঙ্গে পেট্রোব্রাসের উচ্চপদস্থ তৎকালীন ও সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে। ওই মামলায় বেশ কয়েকজন শতকোটিপতির জেল পর্যন্ত হয়। শুধু তাই নয়, এ ঘটনায় তৎকালীন প্রেসিডেন্টকে আদালতে হাজিরাও দিতে হয়; অপূরণীয় ক্ষতি হয় বিশ্বের নামকরা কিছু প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক অবস্থা ও সুনামের।
২০১৪ সালের মার্চে শুরু হওয়া তদন্তে প্রাথমিক ফোকাস ছিল কালোবাজারে অর্থ লেনদেনকারী ‘দোলেইরো’ নামে পরিচিত দালালরা। তারা কালোটাকা কাজে লাগানোর জন্য পেট্রোল পাম্প এবং কারওয়াশের মতো ছোট ছোট ব্যবসাগুলোকে কাজে লাগাত। সেখান থেকেই অনুসন্ধানটির নাম হয় ‘অপারেশন কারওয়াশ’।
কিন্তু কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে তদন্তকারীরা টের পান, এই দোলেইরোদের পেছনে রয়েছেন পেট্রোব্রাসের পরিশোধন ও সরবরাহ বিভাগের তৎকালীন পরিচালক পাওলো রবার্টো কস্টা। কড়া পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের পর কস্টাই সারভেরোসহ আরও বেশ কয়েকজন নির্বাহী কর্মকর্তার নাম জানান, যারা ছোটছোট মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণ কাজের নাম করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ দিয়ে দিচ্ছিলেন এবং বেআইনি চুক্তিও করে দিচ্ছিলেন অর্থের বিনিময়ে।
পানামা পেপার্স
সাম্প্রতিক বহুল আলোচিত একটি ইস্যুর নাম ‘পানামা পেপার্স’। নামী তারকা, বিশ্ব-রাজনীতির রথী-মহারথীদের কর ফাঁকির তথ্য ফাঁস করে তাদের ঘুম হারাম ও বিশ্বজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী এই নাম এত জলদি ভোলার কথা নয়।
‘পানামা পেপার্স’ হলো ই-মেইল, আর্থিক বিবরণী, পাসপোর্ট এবং কর্পোরেট নথি আকারে থাকা ১ কোটি ১৫ লাখ দলিল এবং ২.৬ টেরাবাইট তথ্য। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকাকে সংযোগকারী ভূখণ্ড পানামার একটি আইন বিষয়ক সংস্থা ‘মোসাক ফনসেকা’র কাছে এসব ‘অফশোর’ প্রতিষ্ঠানগুলোর (সরকারকে না জানিয়ে নিজের দেশের বাইরে বেনামে পরিচালিত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান) তথ্য ছিল। এজন্য এইসব দলিলপত্রকে ‘পানামা পেপার্স’ বলা হয়।
গত বছরের এপ্রিলে ফাঁস হওয়া সেসব নথিপত্রে ছিল ফুটবল তারকা মেসি, বলিউড তারকা অমিতাভ বচ্চন ও তার পরিবার, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিন ক্যামেরন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনসহ বহু নামিদামি মানুষের নাম। এমনকি মোসাক ফনসেকার অফশোর ক্লায়েন্ট তালিকায় ৩২ বাংলাদেশির নামও ছিল।
প্রাথমিকভাবে ফাঁস হওয়া দলিলাদিতে মানুষের জল্পনা-কল্পনা আর প্রচুর গুজব সৃষ্টি হওয়ায় মে মাসেই জনসাধারণের জন্য ‘পানামা পেপার্স’ তথ্যভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।
প্রকাশিত তথ্যভাণ্ডারে অনেক কাগুজে প্রতিষ্ঠানের ক্রেতাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়। এসব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ১৯৭৭ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত প্রায় ৪০ বছর ধরে নিজেদের আয়ের সঠিক তথ্য গোপন করে এসেছে।
২০১২ সালে মোসাক ফনসেকাকে ‘অফশোর অর্থায়ন’এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলো প্রভাবশালী পত্রিকা ‘দ্য ইকোনোমিস্ট’। নিজেদের সম্পর্কে কোনো তথ্যই এতোদিন তারা প্রকাশ করতো না। শেল কোম্পানিগুলোকে (নিজস্ব কোনো ব্যবসা নেই তবে অন্য প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসার জন্য অর্থ দেয়) সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান পানামা ভিত্তিক এই আইনবিষয়ক সংস্থাটি। ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের মতো ‘ট্যাক্স হেভেন’ বা কর অভয়াশ্রম বলে পরিচিত প্রায় সব জায়গাতেই তাদের কর্মকাণ্ড চালু আছে।
ওডেব্রেখট ঘুষ-কেলেঙ্কারি
বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ দুর্নীতি – সেটাও ব্রাজিলভিত্তিক। সেই কেলেঙ্কারিতে ১২টি দেশ সম্পৃক্ত থাকলেও এর কেন্দ্রে ছিল ব্রাজিলভিত্তিক ল্যাটিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় কনস্ট্রাকশন ফার্ম ‘ওডেব্রেখট’। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ২০০১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্তপ্রায় ৮০ কোটি মার্কিন ডলার ঘুষ দেয়ার অভিযোগ আনা হয়। ঘুষের কয়েকটি লেনদেন যুক্তরাষ্ট্র হয়েও অন্য দেশে গিয়েছিল।
এ ঘটনায় হওয়া মামলায় ওডেব্রেখট দোষী সাব্যস্ত হয় এবং শাস্তি হিসেবে কর্তৃপক্ষকে সাড়ে ৩শ’ কোটি ডলার জরিমানা করা হয়। মার্কিন বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে জারি করা এটিই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ অঙ্কের জরিমানা।
আমেরিকান রাজনৈতিক দুর্নীতির ঐতিহাসিক নিদর্শন
দুর্নীতির বেশ পুরোনো ঘটনা এটি। মার্কিন রাজনৈতিক ইতিহাসে লোভ ও ঘুষের অবিসংবাদিত পোস্টার চাইল্ড বা আইকন হিসেবে পরিচিত বস উইলিয়াম টুইড। বলা হয়ে থাকে তিনি দুর্নীতিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
নিউইয়র্কের ট্যামানি হলের সদস্য হওয়ার সুযোগ নিয়ে টুইড ও তার খাস সাগরেদরা উনিশ শতকে গৃহযুদ্ধ চলাকালে পুরো নিউ ইয়র্ককে তাদের ব্যক্তিগত টাকার ফ্যাক্টরি বানিয়ে ফেলেছিলেন। ওই সাগরেদদের মধ্যে মেয়র ফারন্যান্ডো উডও একজন।
গৃহযুদ্ধের সুযোগে ব্যাপক পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে লালে লাল হয়ে যাচ্ছিলেন টুইডের দল। সেই দুর্নীতি যে কী পরিমাণ, দুয়েকটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যাবে। একবার টুইড নিউইয়র্কের বিভিন্ন স্থানে বসানোর জন্য তিনশ’টি কাঠের বেঞ্চ কিনলেন, প্রতিটা ৫ ডলার করে। অথচ যখন নগর কর্তৃপক্ষের কাছে সেগুলো বিক্রি করলেন, একেকটির দাম হয়ে গেল ৬শ’ ডলার!
সিটি হল ছিল টুইডের দুর্নীতির বিরাট আখড়া। তার হাত হয়ে সেখানে প্রতিটি থার্মোমিটারের জন্য সাড়ে ৭ হাজার, প্রতিটি ঝাড়ুর জন্য ৪১ হাজার ১৯০ এবং আসবাব ও কার্পেটের জন্য প্রায় ৫৭ লাখ মার্কিন ডলার বিল করা হয়েছিল। এমনকি একবার এক কাঠমিস্ত্রির একমাসের কাজের জন্য তাকে ৩ লাখ ৬১ হাজার ডলার দেয়ার কথা লেখা হয়েছিল।
আধুনিক নিউইয়র্ক গড়তে টুইডের যথেষ্ট ভূমিকা থাকলেও আপাদমস্তক দুর্নীতিতে জর্জরিত ছিলেন তিনি। তার অবৈধ আয় ২০ কোটি ডলার পর্যন্তও উঠে যেত। তবে ১৮৬০ এর দশকে অবশেষে আইনের হাতে ধরা পড়ে যান বস উইলিয়াম টুইড। বিচারকাজ শেষে কারাদণ্ড দেয়া হয় তাকে। ১৮৭৮ সালে জেলেই তিনি মারা যান।