চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আলমগীর ভাই, আপনাকে ভোলা যাবে না

চারপাশে কেমন থোকা থোকা বিষণ্ণতা ছড়ানো। এই ফাগুন মাসে কেন ভরা বর্ষাকালের মতো এমন বিরূপ আবহাওয়া? কেমন অদ্ভুত লাগে না! যদিও প্রকৃতির এ খামখেয়ালিপনা তো নতুন কিছু নয়। এরসঙ্গে মানিয়ে নিয়েই চলতে হয়। তারপরও গোলমেলে এই আবহাওয়ায় কেন জানি না মনের ভেতর এক ধরনের চাপ তৈরি হয়। এর কারণ হতে পারে, মানুষ তো প্রকৃতিরই সন্তান। তার জন্ম ও মৃত্যু প্রকৃতির গর্ভে নিহিত। আর জন্মের পর মৃত্যু তো অবশ্যম্ভাবী। যেকোনো সময় এরজন্য প্রস্তুত থাকতেই হয়।

জানা কথা, কেউই মৃত্যুঞ্জয়ী নয়। কিন্তু তাই বলে আমার, আমাদের শাহ আলমগীর ভাই! এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন! এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? না, না, এ কী করে হয়? এমনটি একদমই হতেই পারে না। এই তো সেদিনও দিব্যি হাসি-খুশি মুখে কথা বললেন। তাতে যথারীতি জড়িয়ে ছিল স্নেহ মায়া ও মমতার পরশ। এটাই তো তার জীবনের অন্যতম ভূষণ। সবাইকে তো এভাবেই আপন করে নিয়েছেন।

সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে কী সুন্দরভাবে আলোকিত করে রাখেন মিডিয়া জগতকে। সর্বত্রই তার সরব, সর্বাঙ্গীণ ও সর্বাঙ্গ সুন্দর উপস্থিতি। সবার সঙ্গে তার চমৎকার সদ্ভাব। সব বয়সীর সঙ্গে তার অকপট, অন্তরঙ্গ ও আন্তরিকতার বন্ধন। এমন একজন সজ্জন, সদালাপী, সদাশয় মানুষ এভাবে চলে যাবেন!

জানি, কখন কী ঘটবে, কারো পক্ষেই ভাবা সম্ভব নয়। তারপরও কোনো কোনো বিষয় খুবই অপ্রস্তুত করে দেয়। আলমগীর ভাই যে এতটা গুরুতর অসুস্থ ছিলেন, সেটা একদমই বুঝতে পারিনি। পারার কথাও নয়। তিনিও কি বুঝতে পেরেছিলেন? নাকি বুঝতে দেননি? নিজের ব্যাপারে অনেক চাপা স্বভাবের ছিলেন। বোধকরি নিজের দুঃখে অন্যকে দুঃখী করতে চাননি।

এই তো সেদিন প্রাথমিকভাবে যখন তার অসুস্থতার খবরটা জানতে পারি, ভেবেছি, ধ্যাত, আলমগীর ভাই কেন গুরুতর অসুস্থ হবেন? হয়তো ভাইরাস জাতীয় কিছু একটা হয়েছে। সহসাই সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন তার কর্মব্যস্ত জীবনে। কিন্তু সত্যিটা জানার পর আমার কাছে তা বড় ধরনের একটা ধাক্কা হয়ে আসে। এটা কীভাবে হয়?

আলমগীর ভাই তো সারাক্ষণ হাসিমাখা মুখ নিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলবেন। আপনজনের মতো সবার কুশলাদি জানতে চাইবেন। দায়িত্ব আর নিষ্ঠার সঙ্গে একটার পর একটা কাজ করে যাবেন। তার সামনে কত কত কাজ। যে কাজগুলো কখনও হয়নি, সে কাজগুলো করার জন্য তার কত পরিকল্পনা। কত প্রস্তুতি। অথচ অসুস্থতার খবরের রেশ কাটতে না কাটতেই সপ্তাহ খানেকের মধ্যে অন্তিমযাত্রা! ভিতরে ভিতরে এতটাই কি ক্ষয়ে গিয়েছিল তার জীবনীশক্তি!

কর্মসূত্রে আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আলমগীর ভাইয়ের সঙ্গে যে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে, তা কখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি। আমার যা স্বভাব, তাতে এমনটি হওয়ার কথা নয়। তিনিই তা হতে দেননি। সহকর্মী হিসেবে দৈনিক বাংলার বাণী, দৈনিক আজাদ ও চ্যানেল আইয়ে তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই আমার অভিভাবকের মতো। ব্যক্তিগত সমস্যার কথা জানতে পারলে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছেন। পথ বাতলে দিয়েছেন। কখনো কখনো জ্বালিয়ে দিয়েছেন আশার প্রদীপ।

সময়ের পরিক্রমায় তার দায়িত্বের পরিধি বেড়েছে। তিনি ধাপে ধাপে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে অনেক উপরে উঠেছেন। পেশার প্রতি তার নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও ভালোবাসা ছিল প্রবাদপ্রতীম। যখন যে কাজ করতেন, নিজেকে ঢেলে দিতে একদমই কার্পণ্য করেননি। যে কারণে পরিণত হয়েছেন বাংলাদেশের মিডিয়া জগতের অন্যতম আইকনে।

কিন্তু সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার সৌহার্দ্য, তার বন্ধুত্ব, তার অকৃত্রিমতা একটুও হেরফের হয়নি। আগের মতোই যখনই কাঁধে রেখেছেন নির্ভরতার হাত, তাতে আশ্বস্ত হতেই হতো। নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ না হলেও অনুভব করতে পারতাম, কেউ একজন আছেন, আমি সমস্যা বা সংকটে পড়লে তিনি বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়ে দেবেন। তাকে হারিয়ে আমি যেন আমার একজন অভিভাবককে হারালাম।

শুধুই কি আমি? মিডিয়ার সঙ্গে যারা জড়িয়ে আছেন, তাদের ভালো-মন্দের সঙ্গেও তিনি নিজেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলেন। মেধা ও দক্ষতা দিয়ে বরাবরই থেকেছেন নেতৃত্বের সারিতে। প্রতিষ্ঠানগত তো বটেই, জাতীয়ভাবে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। কতজনকে কতভাবেই না সাহায্য ও সহযোগিতা করেছেন। শুধু কাছের পরিমণ্ডলেরই নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাংবাদিকদেরও এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও তার অবদান তুলনাহীন।

ব্যক্তিগতভাবে তিনি যতজন মিডিয়াকর্মীর কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছেন, তেমন নজির খুব একটা দেখা যায় না। তার মৃত্যুতে অনেকেই একজন অভিভাবক হারানোর বেদনা অনুভব করছেন। শুধু মিডিয়াজগত নয়, শিশু সংগঠক ও চলচ্চিত্র কর্মী হিসেবেও তার প্রশংসনীয় ভূমিকা রয়েছে। শিশু-কিশোরদের কাছেও তিনি ছিলেন পরম আশ্রয়। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত কত স্মৃতি। কিন্তু এ মুহূর্তে সব কেমন যেন ধূসরিত হয়ে গেছে। লিখতে খুব কষ্ট হচ্ছে। বারে বারে অশ্রুসজল হয়ে যাচ্ছে চোখ। রক্তক্ষরণ হচ্ছে বুকের মধ্যে। কোনো সান্তনাই খুঁজে পাচ্ছি না। হায়! আজ আমার জন্মদিন। আর এমন দিনেই চলে গেলেন তিনি! তিনি চলে গেলেও তার সঙ্গে যেন আরও বেশি জড়িয়ে গেলাম আমি। আলমগীর ভাই, আপনাকে কখনও ভোলা যাবে না। আপনার হাসিমাখা মুখখানি হৃদয়ে চিরদিন উদ্ভাসিত হয়ে থাকবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)