একুশে বইমেলা বাঙালির অন্যতম উৎসবের নাম। লাখো পাঠক মুখিয়ে থাকেন প্রিয় লেখকের নতুন বই, অটোগ্রাফ আর তার সরাসরি সাক্ষাৎ লাভের আশায়। ফেব্রুয়ারির এই মেলায় স্টলে ঘুরে ঘুরে নতুন বইয়ের গন্ধ নেয়া, সবশেষে বই কিনে বাড়ি যাওয়ার আনন্দটাই আলাদা। এতো গেলো পাঠকের অনুভূতির কথা; যারা এই আয়োজনকে ঘিরে পাঠকদের জন্য বসিয়ে যান অক্ষরের পর অক্ষর, পাঠককে নিজের শিল্পসত্তার সেরাটা দিতে যারা পরিশ্রম করে যান দিনের পর দিন এবং রাতের পর রাত, তাদের অনভূতিটা কেমন?
তাদের অনভূতি জানতে চলুন আমরা ঘুরে আসি ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কিছু ফেসবুক স্ট্যাটাসে। ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারির একটি স্ট্যাটাস ছিল এমন: ‘আজ বইমেলার শেষ দিন। ভাঙনের সুর বাজবে দিনমান। আবার অপেক্ষা, আগামী ফেব্রুয়ারির। সেই ফেব্রুয়ারিতে সবাই থাকবো তো? আমার কি দেখা হবে প্রাণের সাথে প্রাণের সম্মিলনে?’ ফেসবুকে এই স্ট্যাটাসটি কে লিখেছিল জানেন? তিনি আর কেউ নন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী পদে থেকেও যিনি বইমেলা আর শিল্পসাহিত্যকে প্রাণে ধারণ করতে পেরেছিলেন সেই মাহবুবুল হক শাকিল।
শিল্পসাহিত্য আর কবিসত্তাকে হৃদয়ে ধারণ করা মাহবুবুল শাকিলের এমন স্ট্যাটাসে সবাই স্বাভাবিকভাবে ধরে নিয়েছিলেন তিনি স্বভাবজাত ‘মন খারাপের গাড়ি’তে উঠেছেন। কিন্তু এই ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে মাহবুবুল হক শাকিল ভাইয়ের সেই ‘অমূলক’ আশঙ্কা সত্যি হয়েছিল। কারণ এই স্ট্যাটাস লেখার পরের বছরের ফেব্রুয়ারি আর তার প্রাণের বইমেলায় শারীরিকভাবে তিনি ছিলেন না। ২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর গুলশানের একটি রেস্তরাঁয় তিনি আকস্মিকভাবে মারা যান।
সেই ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখে তিনি আরেকটি স্ট্যাটাস লিখেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছেন: ‘খুব বেশি ঘুম দরকার, অনেক ঘুম| যে ঘুমে পাড়ি দেয়া যায় জগত-সংসার, কাজ, ভাড়া করা জীবন, বিরহ, ভুল ভালবাসা, যৌবন, কৈশোর এমনকি লালজামা শৈশব| এমন দীর্ঘ ঘুম যা নিয়ে যাবে মায়ের গর্ভের ওমমাখা আদরে| ঘুম খুজছি, তৃপ্তিময় সেই ঘুম, পরম আরাধ্য।’ কবি সাহিত্যিকদের এমন ঘুমের প্রয়োজন কেন হবে? তারা যদি এমন অসময়ে এভাবে ঘুমান, তাহলে মানুষের জন্য সৃষ্টি করবে কে? আর এই ঘুম এত দ্রুত চলে আসবে তা কি কেউ কখনও ঘুণাক্ষরে ভেবেছিল?
তবে তিনি কি বুঝেছিলেন এই প্রাণের সম্মিলনে আর থাকতে পারবেন না? এজন্যই কি বইমেলার শেষদিনে সবার সঙ্গে আবারও প্রাণের সম্মিলনে সবার সঙ্গে দেখা করার তীব্র আকাঙ্খা ছিল এই কবির মনে? তবে শারীরিকভাবে হয়তো কবি মাহবুবুল হক হয়তো আর কোন দিন এই প্রাণের সম্মিলনে থাকতে পারবেন না, তবে তার রেখে যাওয়া কবিতার বই ‘খেরোখাতার পাতা থেকে’, ‘মন খারাপের গাড়ি’, ‘জলে প্রুজি ধাতব মুদ্রা’, কবিতা আবৃত্তির সিডি ‘রাতের এপিটাফ’কিংবা একমাত্র ছোটগল্পের সংকলন ‘ফেরা না ফেরার গল্প’তো সবসময়ই থাকবে বইমেলায়।
এসব কাজের মধ্য দিয়েই তিনি বেঁচে থাকবেন শত সহস্র বছর। এর মাধ্যমেই প্রিয়জন আর ভক্তরা মাহবুবুল হক শাকিলের সঙ্গে দেখা করবে সেই প্রাণের সম্মিলনে। কেউবা হয়তো প্রতিবছরই নতুন করে কিনে নেবে মাহবুবুল হক শাকিলের বই, প্রতিটি পাতায় প্রিয় কবির স্পর্শের ঘ্রাণ পাওয়ার আশায়।