চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মন খারাপের গাড়ির মালিক, আপনার প্রতি শ্রদ্ধা

প্রথমে খবরটি পাই ফেসবুকে সাংবাদিক অঞ্জন রায়ের পোস্ট, মাহবুবুল হক শাকিল, তার পরে অনেকগুলো ডট। প্রথমে ভাবছিলাম পোস্টের নীচে মজা করে কিছু লিখব কারণ মাহবুবুল হক শকিল আর অঞ্জন রায় দুজনের সাথে-ই আমার সম্পর্কটা একটু ভিন্ন ধরনের।

কিন্তু একটু পরেই তার আরেক ছায়াসঙ্গী বন্ধু আনিসুর রহমান লিটু আর বেগ শাহীনের ফোনে নিশ্চিত হই চারদিক আঁধার করে আসা সেই অবিশ্বাস্য খবরটি। শাকিল ভাই নেই।

শাকিল ভাই, মাহবুবুল হক শাকিল। আমাদের হলের বড় ভাই, বয়সের সীমা ছাড়িয়ে যিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের বন্ধু, স্বজন। তার জীবনবোধ, ব্যবহার, লাইফ স্টাইল ছিল একটু ব্যতিক্রম।

শাকিল ভাই-এর জীবনের অনেকগুলো অধ্যায় ছিল, তিনি ছাত্ররাজনীতি করতেন। ছাত্রনেতা ছিলেন। একটা আদর্শ ধারণ করতেন মনে প্রাণে। যেখানে কোন খাদ ছিল না। রাজনীতি করতেন বুঝে শুনে। তিনি যখন ছাত্ররাজনীতির কর্মী ও পরে নেতা হয়েছেন তখন তার রাজনীতি প্রচ- রাষ্ট্রীয় আক্রমণের শিকার ছিল। রাষ্ট্র তার সব শক্তি দিয়ে শাকিল ভাইয়ের রাজনীতিকে চেপে ধরেছিল, বিনাশের সব পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। কিন্তু দেখেছি তিনি নিঃশঙ্ক চিত্তে তার রাজনীতি আঁকড়ে রেখেছেন, এগিয়ে গেছেন, মাথা নত করেন নি। নেতা হয়েছেন আবার হতে পারেন নি। এতে তার ভেতরে তৃপ্তি বা দুঃখবোধ কোনটাই দেখি নি। সম্ভবত সেটা ছিল বুঝে শুনে রাজনীতি করার অনিবার্য ফল। নিজ রাজনীতি ও আদর্শের প্রতি আস্থার প্রতিক্রিয়া।

আগেই বলেছি, তিনি আমার হলের বড় ভাই ছিলেন। ক্যাম্পাসে তাঁকে পেয়েছি ছাত্রনেতা হিসেবে। দেখেছি প্রখর ব্যক্তিত্ববোধ, দৃঢ়তা, আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা আবার সেই কঠোর মানুষটিকে হলের গন্ডিতে পেয়েছি এক অকৃত্রিম বন্ধু, যেখানে আদর্শের ভিন্নতা, বয়সের দূরত্ব আমাদের সেই সম্পর্কের মাঝে কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেনি। আমরা ছিলাম এক পরিবারের সদস্যের মতো।

আগেই বলে নেই আমি যে শাকিল ভাইকে নিয়ে এই ছোট স্মৃতিচারণ করবো সেখানে ক্যাম্পাস ও আমার হল জীবনের পাঁচ/ছয় বছরের স্মৃতি জড়ানো মাহবুবুল হক শাকিল কে নিয়ে আসবো। আমরা জানি তিনি খুব কম বয়সে আমাদের ছেড়ে গেলেও তার একটা বর্ণাঢ্য কর্মজীবন ছিল, বিপুল সংখ্যক মানুষের সাথে তার আত্মিক সম্পর্ক ছিল। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ছিলেন। এতো বড় একটা দায়িত্ব পালনের কারণে তার পরিচিত জনের সীমা ছিল বিশাল। তবে তার জীবনের শেষ অংশ নিয়ে আমার তেমন কোন স্মৃতি নেই। কারণ, সে সময়ে তার সাথে আমার খুব একটা যোগাযোগ ছিল না, মাঝে মাঝে ফেসবুকে কথা হতো।

বলে রাখা ভালো আমি শাকিল ভাইয়ের দল করতাম না, তিনি ছাত্রলীগ করতেন আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। আমি প্রথমে স্যার এ এফ রহমান হলের একশ আট পরে চারশ চার নাম্বার কক্ষের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। তবে রাতের আড্ডা হতো হলের দোতলায় তিনি যে রুমগুলোতে থাকতেন যেখানে ।

মানুষকে আপন কওে নেবার ক্ষমতা সবার থাকেনা। আবার সবাইকে আপন করেও নেয়া যায় না। কেউকে কেউকে আপন করে নেবার ক্ষেত্রে নানা পরিচয় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। তবে এটা তার মধ্যে ছিল না। তিনি আপাদমস্তক রাজনীতির মানুষ হলেও আমাদের বর্তমান রাজনীতির অনেক কদর্য দিক তাকে স্পর্শ করেনি। তার সাথে যতদিনের পরিচয় ছিল সে সময়ে তিনি বিরোধীদলের ছাত্র সংগঠনের নেতা যেমন ছিলেন তেমনি সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনেরও নেতা হিসেবে তাঁকে দেখেছি। সময়ের ব্যবধানে ক্ষমতার উভয় মেরুতে তিনি থেকেছেন কিন্তু তার আর্থিক সংগতি, আচরণ, ব্যবহারের ভেতরে তেমন পরিবর্তন লক্ষ্য করিনি।

তার জীবনের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি অভাবী মানুষ ছিলেন । কিসের অভাব? রুচি? বোধ? ব্যক্তিত্ব? না। আর্থিক অভাব। তিনি নিজেও গর্ব করে মজা করে বলতেন সেটা, মনে পড়ে অনেক সময় আমাদের পকেটে খাওয়ার টাকা থাকতো না আমরা সেটা নিয়ে হা পিত্যেশ করতাম। তিনি আমাদের আর্থিক দৈন্যতা নিয়ে মাঝে মাঝে লেকচার দিতেন। একদিন বলছিলেন, শোন-পহেলা বৈশাখ আমাদের ছেড়ে যায়, ভ্যালেন্টাইন চলে যায়, শীত-বসন্ত আসে যায় কিন্তু আমাদের একটা বন্ধু আমাদের ছেড়ে যায় না, সেটা হল অভাব। অভাব আমাদের ছেড়ে যায় না। অভাবকে ভালবাসতে শেখো। বলে হাহা করে হাসতেন। একবার ক্যাম্পাসে তার বন্ধু বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোস্তফা কামাল ভাই তাদের ডিপার্টমেন্টের একটা প্রেগ্রাম করবেন সেটা নিয়ে হলে আলোচনা করছেন। সব প্রস্তুতি ভালোভাবে এগিয়ে চললেও অনুষ্ঠানের উপস্থিতি নিয়ে মোস্তফা ভাই চিন্তিত।

শাকিল ভাই তার বন্ধু মোস্তফা ভাইকে ডাকলেন, অই চানপুরি (মোস্তফা ভাইয়ের বাড়ি ছিল চাঁদপুর সে কারণে বন্ধুকে এই নামে ডাকতেন ) কাল তোর নাকি ক্যাম্পাসে প্রোগ্রাম আছে ? হা আছে তো। শাকিল ভাই বললেন, তো লোকজন কিছু আইবো? মোস্তফা ভাই জমায়েত নিয়ে তার সংশয়ের কথা জানালেন। শাকিল ভাই বলছেন, একটা কাজ কর। একটা কাগজে নোটিশ লেখ, মাহবুবুল হক শাকিলের কাছে যারা টাকা পাবেন তারা কাল দশটা বাজে মধুর ক্যান্টিনে চলে আসবেন, টাকা দেয়া হবে। তারপরে হলের নোটিশ বোর্ডে টানিয়ে দিয়ে আয়, দেখবি এতো লোক আইবো, তর প্রোগ্রাম এদের দিয়ে সাকসেস। তারপরে তাঁর সেই ভুবন ভোলানো হাসি।

হলের ছোট ভাই নুরুর ভাগ্নে হয়েছে। নুরু বাড়ি থেকে ফিরে রাতে শাকিল ভাইকে সে খবর দিয়ে একটা নাম চাইলো। ভাগ্নের নাম রাখবে। শাকিল ভাই নুরুকে বলছে, দেবো নাম , আগে সিগারেট নিয়ে আয়। নুরু সিগারেট নিয়ে এলো। বলছে এখন দেয়া যাবে না, আমি একটু ভেবে নাম ঠিক করবো। কাল আসবি। পরদিন রাতে নুরু এলো, ভাই নাম দেন। শাকিল ভাই আগের মতো বলছেন, যা সিগারেট নিয়ে আয়। ভাবতে হবে। নুরু সিগারেট এনে দিয়ে চলে গেল। শাকিল ভাই নুরুর থেকে সিগারেট নেয় কিন্তু নাম দেয় না। একদিন নুরু বলছে ভাই বাড়ি থেকে নাম চাইছে কী করবো ? শাকিল ভাই বলছেন, যাহ তোর ভাগ্নের নাম রাখ শাকিল। সবাই তো তাজ্জব! শাকিল ভাই বলছে, আরে এতো বড় সেক্রিফাইস করলাম, নিজের নামটাই দিয়ে দিলাম, দেখ ! তার পরে সেই অকৃত্রিম হাসি।

বহু বছরের অনেক স্মৃতি। মধুর ক্যান্টিনের বাইরে ক্যাম্পাসে তিনি সাধারণত কলা ভবনের প্রোক্টর অফিসের সামনে আড্ডা দিতেন ।আমিও মধুর ক্যান্টিন কেন্দ্রিক সাংগঠনিক কাজ শেসে হলে ফেরার পথে ওখানে দেখা হতো। জানতে চাইতেন, খাইছস? না খাই নাই, টাকা নাই। আপনি খাইছেন ? না আমিও খাই নাই। বলতেন, আমার কাছেও টাকা নাই। বলতাম, আপনি একটা ভুয়া লোক। সরকারী দল করেন কিন্তু পকেটে টাকা থাকেনা। ধমক দিতেন, বেয়াদবি করোস ! তার পরে সেই হাসি। সে সময়ের প্রোক্টর নবী স্যারের থেকে আমাদের টাকা নেবার একটা বিশেষ কৌশল ছিল।আমরা মাঝে মাঝে খাওয়ার জন্য তার থেকে টাকা নিতাম।

নিজ সংগঠনের বাইরে অপরাপর সংগঠনে তার বিপুল সংখ্যক বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী ছিল। বহু মানুষের আপনজন ছিলেন। মারা যাওয়ার পরের দিন সকালে নীলক্ষেতের তাজ মাইকের রহমান এর কান্না আমি ভুলবো না। রহমান তার কোন আত্মীয় নন।
শাকিল ভাইকে যারা চিনতেন তারা জানেন এক অসম্ভব রসবোধ ছিল তার। মানুষকে দ্রুত আপন করে ফেলার এক অসাধারন ক্ষমতা শাকিল ভাইয়ের মধ্যে ছিল। তিনি সবার সাথে মিশতেন, আপন করে নিতেন কিন্তু কখনো নিজের মতামত অন্যের উপর চাপানোর চেষ্টা করতেন না বা ব্যক্তিগত আড্ডায় রাজনীতিকে টেনে আনতেন না। তার পরেও কখনো কখনো আড্ডায় রাজনীতি চলে আসতো তিনি নিজের মত বলতেন আবার অন্যের ভাবনাকে সম্মান করতেন। এ সময়কালে আমরা দেখি আপনি আমার মতের অনুসারী না হলে আপনাকে পৃথিবীর একজন খারাপ লোক ধরে নেই। শাকিল ভাই এই ভ্রান্ত ভাবনার বাইরে ছিলেন। তার সেই গুণের প্রতিদান তিনি পেয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার জানায়ায় বহু মতের এবং বিপুল মানুষের উপস্থিতি সেটা প্রমাণ করে।

আমি মাহবুবুল হক শাকিলের অসময়ে চলে যাওয়ায় বড় আগামীর রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে । তার এই আকস্মিক মৃত্যু তার পরিবার- সরকার বা তার দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে । তবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও তার অসময়ে চলে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি রাজনীতিকে অনেক কিছু দিতে পারতেন। সেই যোগ্যতা ও সৃজনশীল ভাবনা তার ছিল।

আমাদের জাতীয় রাজনীতির সমকালীন সঙ্কটের নানা দিকের একটা হল, অরাজনীতির মানুষের হাতে রাজনীতি চলে যাচ্ছে। “উই হেইট পলিটিক্স” নামের একটা প্রজন্ম গড়ে উঠছে। রাজনীতিতে বড় বড় পুঁজিপতিদের আবির্ভাব ঘটছে। কোনদিন একবার মিছিলে যান নি, মামলা – হামলা – সংকট মোকাবেলার অভিজ্ঞতা নেই একটা শ্লোগানে গলা মেলান নি, এক পাতা লিফলেট ড্রাফ্ট করার অগিজ্ঞতা নেই এখন তিনি রাজনীতির বিশ্লেষক, রাজনীতির নেতা। শুন্য থেকে- প্রান্ত থেকে রাজনীতি শুরু করা মানুষের সংখ্যা কমে আসছে । খেয়াল করবেন ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির হাতে খড়ি নিয়ে নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে জাতীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত হতেন তাদের সংখ্যা কমে আসছে । অথচ এদের সংখ্যা যখন আরও বেশি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা সবাই উপলব্ধি করছে তখন প্রান্ত থেকে বেড়ে ওঠা সে ধরনের একজন রাজনীতির ছাত্র মাহবুবুল হক শাকিলের চলে যাওয়া আমাদের রাজনীতির বড় ক্ষতি ।

এলেন – পদ নিলেন –নেতা হলেন- কেন্দ্র থেকে প্রান্তে গেলেন এই ধারা যখন দেখছেন তখন সেখানে মাহবুবুল হক শাকিল ছিলেন উল্টো। তিনি রাজনীতকে বুঝেছেন-ধারন করেছেন- প্রান্ত থেকে কেন্দ্রে এসেছেন। তবে প্রান্ত বিচ্ছিন্ন হননি।

আমি কেউকে ছোট করছি না তবে খেয়াল করলে দেখবেন আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে এখনো যারা আলো ছড়ান তাদের সবাই ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা রাজনীতির কর্মী। শাকিল ভাই বেঁচে থাকলে সেটা তিনিও পারতেন।

মাহবুবুল হক শাকিলের মৃত্যুর পরে আমরা তার স্মৃতি বিজড়িত স্যার এ এফ রহমান হল এলামনাই এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে স্মরণ সভা করেছি। আমাদের আয়োজনটি ছিল সর্বদলীয় । হলে যারা বিভিন্ন সময়ে রাজনীতি করেছেন তাদের সবাইকে নিয়ে আমরা শাকিল ভাইকে স্মরণ করেছি। আমরা সর্বদলীয় আয়োজনে একটা নির্দলীয় কর্মসূচি পালন করেছি। কাজটা করতে আমাদের কষ্ট করতে হয়েছে কিন্তু আমরা মনে করেছি সেই কষ্টকর কাজটি করার মধ্য দিয়ে আমরা মাহবুবুল হক শাকিলের প্রতি যথাযথ সম্মান জানাতে পেরেছি । তিনি রাজনীতি করতেন কিন্তু অন্য মতের অনুসারীদের প্রতি তার স্নেহ ছিল শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছিল। আমার ধারনা এই সর্বদলীয় আয়োজনে আমরা তাকে কেবল যথাযথ সম্মান জানাইনি, নিজেরাও গৌরব বোধ করেছি। অনেক বিভাজনের মাঝে ও আমরা দেখাতে পেরেছি আদর্শের ভিন্নতা সব সময় সমাজকে বিভক্ত করে বলে আমাদের প্রচলিত ধারনা ঠিক নয়।

শাকিল ভাইয়ের প্রতি আমার অনুযোগ আছে।
এতো দ্রুত মন খারাপের গাড়িটি থামিয়ে না দিলে হতো না ?
তবুও শ্রদ্ধা, বিনম্র শ্রদ্ধা।