অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, কারো রান্না ঘরের গ্যাসের চুলা থেকে আগুন লাগলেও যদি বলে দেয়া যায় যে, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগেছে—তাও যেন মানুষ বিশ্বাস করে। অর্থাৎ সমস্ত আগুনের সূত্রপাত এই শর্ট সার্কিট!
সর্বশেষ রাজধানীর বনানীতে এফ আর টাওয়ার নামে যে বহুতল ভবনে আগুন লাগলো, সেখানেও শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এর দুদিন পরে বনানীর অদূরেই গুলশান এক নম্বরে ডিএনসিসি মার্কেটেও আগুনে দুই শতাধিক দোকান পুড়ে যায়।
এখানেও বৈদ্যুতিক শট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে ধারণা করা হয়। ফলে এখানে মোটা দাগে প্রশ্ন দুটি: ১. সব আগুনের পেছনে শর্ট সার্কিটকে দায়ী করে অন্যান্য গুরুতর ও গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোকে আড়াল করা হচ্ছে কি না এবং ২. আলিশান ও আধুনিক ভবনে বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট হবে কেন? এই প্রশ্ন দুটি মাথায় নিয়ে এগোনো যাক।
বনানীর আগুনের ঘটনা নিয়ে ফেসবুকে নানা শ্রেণিপেশার মানুষের যেসব প্রতিক্রিয়া ও মতামত এসেছে, সেখানে একটা বিষয় খুব স্পষ্ট যে, কেউই এ ধরনের ঘটনা দেখতে চায় না।
তবে এ কথাও ঠিক যে, বহুতল ভবনের ফায়ার সিস্টেম বা অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা নিয়ে অনেকেই ধারণা থেকে মন্তব্য করেছেন। কেউ কেউ এমনও লিখেছেন যে, ফায়ার সার্ভিস কেন ক্রেন ফিলট দিয়ে অনেক দেরিতে লোক নামানো শুরু করলো; কেউ কেউ লিখেছেন ফায়ার সার্ভিস কেন নেট বা কুশন বিছিয়ে দিল না যাতে মানুষ উপর থেকে লাফ দিলেও সেই নেট বা ফোমের বিছানায় পড়ে বেঁচে যায় ইত্যাদি।
বাস্তবতা হলো, ফায়ার সার্ভিস এই নেট বা কুশন দেয় যখন কেউ ছয় তলা থেকে নিচে থেকে লাফ দেয়। কিন্তু এফ আর টাওয়ারে যারা আটকা পড়েছিলেন, তারা সবাই ৬ তলার উপরে ছিলেন। কেউ কেউ ১৮-১৯ তলায়ও। সুতরাং সেখানে নেট বা কুশন কার্যকর হত না বলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত ক্রেন লিফটও কোনো সমাধান নয়। কারণ একটি ক্রেন লিফট কত উঁচুতে উঠবে? কোনো ভবন যদি হয় ২৪ তলা বা তারও চেয়ে বেশি, তখন ক্রেন লিফট কী করে অত উঁচুতে উঠবে? উন্নত বিশ্বেও কি এরকম বহুতল ভবনের উঁচু থেকে আটকেপড়া মানুষদের ক্রেন লিফটে বা কুশন নিয়ে উদ্ধার করা হয়? নিশ্চয়ই না।
বরং বহুতল ভবন মানেই সেখানে নিজস্ব ফায়ার সিস্টেম বা আগুন নির্বাপণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আমাদের দেশের কয়টা ভবনে নিজস্ব অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা আছে? আছে, যেসব ভবনে বিদেশি বড় বড় প্রতিষ্ঠান যেমন এইচএসবিসি ব্যাংক, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড যেমন এইচ এন্ড এমন, মাইক্রোসফট—তারা রাজধানীর যেসব ভবনে অফিস চালায়, সেসব ভবনে সব নিয়ম-কানুন মানা হয় বলে শোনা যায়। কেননা সব শর্ত পূরণ না করলে সেই ভবন এসব বিদেশি বড় প্রতিষ্ঠান ভাড়া নেবে না।
একজন বিশেষজ্ঞকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, একটি বহুতল ভবন নির্মাণে যদি একশো কোটি টাকা খরচ হয়, তাহলে সেই ভবনে নিজস্ব অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা চালু করতে কি অনেক টাকার প্রয়োজন ?
তিনি বলেছেন, না; অনেক টাকার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু ভবন মালিকরা এই বাড়তি টাকাটি খরচ করেন না, কারণ তারা জানেন যদি তারা এই নিয়ম অমান্য করেন, যদি তারা নিজস্ব অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা এবং ভবনটি সব নিয়ম-কানুন মেনে নাও তৈরি করেন, তারপরও তাকে জবাবদিহি করতে হবে না। শাস্তি পেতে হবে না।
বরং তার যেহেতু অনেক টাকা আছে, রাজনৈতিক ক্ষমতা আছে, ফলে তিনি রাজউক থেকে শুরু করে প্রতিটি সংস্থার কাছ থেকে অনায়াসে অনুমোদন বা সার্টিফিকেট পেয়ে যান। আবার এসব প্রতিষ্ঠানও যেহেতু দুর্নীতির আখড়া বলে পরিচিত, ফলে ভবন মালিকরা যতই নিয়ম মানুন না কেন, অনুমোদন পেতে যেহেতু ঘুষ দিতেই হবে, ফলে মালিকরা নিজস্ব এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থার জন্য বাড়তি টাকা খরচ করতে চান না।
কিন্তু যদি বিষয়টা এমন হত যে, নিয়ম মেনে ভবন তৈরি না করলে বা নিজস্ব অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকলে ওই ভবনের গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হবে বা মালিককে জেলে যেতে হবে এবং কোনো প্রতিষ্ঠানেই ঘুষ দিয়ে সার্টিফিকেট আনা যাবে না, তাহলে সবাই বাধ্য হতেন সব নিয়ম কানুন মেনে ভবন নির্মাণ করতে এবং সেখানে নিজস্ব অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা রাখতে।
মূলত জবাবদিহিতা না থাকা এবং ঘুষ ও প্রভাব প্রতপত্তির বিনিময়ে সব ধরনের অবৈধ জিনিস হালাল করার সুযোগ থাকার কারণেই এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসকে যেতে হয়। আবার নকশার বাইরে গিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো প্রতিটি ফ্লোরের সবগুলো অফিস নিজস্ব স্টাইলে অফিস তৈরি করায় অনেকেই আগুন লাগার পরেও কেউ তৎক্ষণায় ছাদে কিংবা নিচে যেতে পারেননি।
ভবনে আগুন নেভানোর মতো পর্যাপ্ত পানিও থাকে না। ভবনের আশপাশে রাস্তায় যে হাইড্র্যান্ট থাকার কথা, তাও নেই। এত নাইয়ের ভেতরে আছে শুধু মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
ফলে আগুন লাগলেই সেটিকে স্রেফ বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট বলে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বরং বহুতল ভবনগুলো কীভাবে গড়ে উঠছে, সেখানে অগ্নি নির্বাপণের নিজস্ব ব্যবস্থা আছে কি না, না থাকলে তার জবাবদিহিতা কোথায়—সেই প্রশ্নগুলোই এখন তোলা দরকার।
তবে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটও একটি বড় সমস্যা। কারণ একটি ভবনে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হবে, সংযোগ নেয়ার আগে তার একটি আগাম হিসাব বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকে দিতে হয়।
কিন্তু সমস্ত বাণিজ্যিক ভবন, ফ্ল্যাট, বাসাবাড়ি, কারখানায় ঘোষিত লোডের ২৫ থেকে ৫০ গুণ বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয় বলে ধারণা করা যায়। ফলে বিদ্যুতের তারগুলো ক্যাপাসিটির বেশি লোড কতদিন বহন করতে পারবে?
একসময় সেখানে তো শর্ট সার্কিট হবেই? আবার এখন আধুনিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় শর্ট সার্কিট হওয়ার সাথে সাথে পুরো বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কথা, সেটি যদি না হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে ত্রুটি আরও গভীরে। আবার ভবনের এমন কোনো অংশে যদি শর্ট সার্কিট হয় যেখানে সাধারণত লোকজনের যাতায়াত কম, তাহলে আগুন লাগার পরে সেটি ছড়ানোর আগে কারো নজরে আসবে না।
ফলে এটি আরেকটি বিপদ। সুতরাং শর্ট সার্কিট হলে সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এবং সঙ্গে সঙ্গে আগুনের উৎস খুঁজে সেটি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিভিয়ে ফেলা না গেলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষে কিছু করার থাকবে না।
এখানে আমাদের এই প্রশ্নটিও তুলতে হবে যে, যে ভবনে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হবে বলে অনুমোদন নেয়া হয়েছিল, নিয়মিত বিরতিতে বিদ্যুৎ বিভাগ কি তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখে যে, আসলেই ওই ভবনে কী পরিমাণ বিদ্যুতের লোড নিতে হচ্ছে? নাকি এই তথ্য বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে থাকার পরও পয়সার লেনদেন আর ক্ষমতার দাপটে কর্তৃপক্ষ চুপ হয়ে যায়?
আসলে সমস্যা আমাদের মজ্জায়। দুর্নীতি এতটাই প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়ে গেছে যে, যখনই কোনো কিছু সিস্টেমে আনার জন্য সরকার উদ্যোগ নেয়, সেটা হোক সড়কে শৃঙ্খলা কিংবা ভবনের নিরাপত্তা—সেখানে একটি বড় চক্রের জন্য পয়সা খাওয়ার উপলক্ষ্য তৈরি হয়।
বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মিটার রিডার, বিভিন্ন অনুমোদন ও ফিটসেন সার্টিফিকেট প্রদানকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব অনুসন্ধান করলে সেটি আরও পরিস্কার হবে।
সুতরাং বনানী ও গুলশানে আগুনের পরে গণপূর্ত মন্ত্রী যে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, নকশাবহির্ভূত ভবন চিহ্নিত করে ১৫ দিনের মধ্যে অভিযান শুরু করা হবে কিংবা সেসব ভবনে আগুন নির্বাপণের নিজস্ব ব্যবস্থা তৈরিতে মালিকদের বাধ্য করা যাবে—ব্যাপারটা এত সহজ নয়।
যেখানে একটি মহানগরী গড়েই উঠেছে নানবিধ অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা-লোভ আর অন্যায়ের কংক্রিটে, সেখানে একটি দুটি দুর্ঘটনায় কিছু মানুষের প্রাণহানির পরে সবকিছু নিয়মের মধ্যে চলে আসবে, এমনটি ভাবা যেতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
বরং বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনের ঘটনা নিয়ে ফেসবুকে একজন সরকারি কর্মকর্তার স্ট্যাটাস উল্লেখ করে লেখাটা শেষ করা যায়। তিনি লিখেছেন-আগুনে পোড়া মানুষগুলির জন্য স্টেপ বাই স্টেপ যা করা হবে: ১. তদন্ত কমিটি হবে; ২. কমিটি ২ মাস পর ডজনখানেক সুপারিশ দেবে যার মধ্যে দুটি সুপারিশ থাকবে এমন—ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলিতে কিভাবে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা কাজ করে সেটি সরেজমিনে দেখার জন্য দুটি টিম পাঠানো হোক।
আরেকটি সুপারিশ হবে,কয়েকজন হাই প্রোফাইল কন্সালট্যান্ট নিয়োগ দেয়া হোক; ৩. মোটামুটি ১০/১২ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ১০ দিনের সফরে শেনজেন ভিসা নিয়ে ইউরোপ যাবেন। আরও ভাগ্যবান ৫/৬ জন আমেরিকায় যাবেন। পুরো দলটিতে কোনো ফায়ার এক্সপার্ট থাকবেন না; ৪. দেশি-বিদেশি এক্সপার্ট মিলিয়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এক বছরের জন্য কয়েকজন কন্সালট্যান্ট নিয়োগ দেয়া হবে। তারা বছর শেষে আরও ডজনখানেক স্বপ্নালু সুপারিশ দেবেন; ৫. এরমধ্যেই আরও শ’খানেক মানুষ আগুনে পুড়ে মারা যাবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)