চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘আর্মানিটোলা থেকে আর্মেনিয়া’

ফাদার বললেন, যাবার সময় সকালে আমার সঙ্গে দেখা করে যেও! সকাল ৮টায় কলা ভবনে থাকবো। ক্লাস আছে। রাতেই সবকিছু গুছিয়ে নিবে। ভিসা-পাসপোর্ট ভালোভাবে নিবে। আর হ্যাঁ, লোকমানের জন্য একটা নেট (জাল) রেখে দিয়েছি পিজে হার্টগ হলের (ঢাবির ইন্টারন্যাশনাল হল) দোকানটাতে। সেটা নিয়ে নিতে বলবে তাকে। পারফরম্যান্সের সময় তার দরকার হবে বলল।

১৯ জুলাই ভোরে ওঠে দ্রুত প্রস্তুতি সেরে নিলাম। ফাদারের নির্দেশনা অনুযায়ী সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছি। কাপড়-চোপড় পরে সকাল ৮:৩০টায় বের হয়ে কলা ভবনে রওনা দিলাম রিক্সায়। শহিদ মিনারের নিকটে বঙ্গবন্ধু টাওয়ার থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ কলাভবন। ঢাকায় তখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি! রিক্সার পর্দার ফাঁক গলে বৃষ্টির ফোটা গায়ে এসে লাগছে। ক্ষণিকের বিদায় বেলায় বৃষ্টি মন জুড়িয়ে দিলো! বৃ্ষ্টির চঞ্চল ছন্দে ভুলে গেলাম ব্রেকফাস্টের কথাও।

ততোক্ষণে লোকমান তার পলাশির বাসা থেকে এসেছেন কলা ভবনে। ফাদার ক্লাস নিচ্ছেন। প্রায় শেষ পর্যায়ে। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি শেষ করে ভেতরে ডাকলেন আমাদের। এরপর সবার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এরা আর্মেনিয়া যাচ্ছে। মূকাভিনয় নিয়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে’!

শুভকামনা ও অভিনন্দনে সিক্ত হলাম শিক্ষার্থীদের। একঝাঁক তারুণ্যের মাঝ থেকে বিদায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে ফাদার দু’জনকে দুটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বললেন, সাবধানে যাও। বেস্ট অফ লাক’!

মাইম অ্যাকশনের সাধারণ সম্পাদক প্রিয় ছোট ভাই সানোয়ারুল হক সনি টিএসসি থেকে বিমানবন্দরের সিএনজিতে তুলে দিলো। সময় তখন ৯ঃ৩০টা। শাহবাগ এসেই বিশাল জ্যাম। জ্যামে বসে ফাদারের দেওয়া খামে কি আছে খুলে দেখার কৌতূহল জাগলো মনে। খাম খুলে দেখি তরতাজা ডলার! বাহ! কি অসাধারণ উপহার! একটি সফরে ঠিক যে জিনিসটার সবচেয়ে প্রয়োজন তিনি তারই সমাধান দিলেন! অবাক করা ব্যাপার। এই মানুষটি এতো সহযোগিতা করতে পারেন! এতো বু্ঝতে পারেন সবকিছু!

সত্যি একজন বিশাল মনের মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের চেয়ারম্যান ও ঢাবি মাইম অ্যাকশনের মডারেটর ফাদার ড. তপন ডি রোজারিও। তিনি একই সঙ্গে কাকরাইল চার্চের ফাদার। একটি উদার মন বহন করেন বলেই তিনি এতোগুলো দায়িত্বও বয়ে বেড়াতে পারেন। শুরু থেকে ফাদারের সার্বিক সহযোগিতা ব্যতীত পূর্ব ইউরোপের দেশ আর্মেনিয়ায় আমাদের আসাই হতো না বলা যায়! উদার এই মানুষটি ভালো থাকুন সবসময় সেই প্রার্থনাই করি।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলাম সকাল ১১টায়। বিমানবন্দরে দেখা মিলল ঢাবি পরিবারের সদস্য আল আমিন প্রধান (বিমানবন্দরে কাস্টমস অফিসার) এর সঙ্গে। তার সঙ্গে আলাপ ও সেলফি পর্ব সেরে দ্রুত ইমিগ্রেশন শেষ করলাম। ঠিক ১২.৪৫টায় চড়ে বসলাম আর্মেনিয়ার উদ্দেশ্যে ফ্লাই দুবাই বিমানে।

বিমানে বসে ভাবনায় ডুবে গেলাম! মেঘের ওপর দিয়ে বিমানের নিরব ছুটে চলা দেখতে দেখতে ভাবছি জীবন কোথায় চলেছে! কোথায় যাচ্ছি! কোথা থেকে যাচ্ছি! ভারত মহাসাগরের পর পারসিয়ান উপসাগর, আরব সাগর, কৃষ্ণ সাগর পাড়ি দিতে হবে! তারপর সুদূর আর্মেনিয়া! রাশিয়া এবং আজারবাইজানের নিকটবর্তী দেশ। একসময় বাংলাদেশে ব্যবসার জন্য নিয়মিত আগমন করতেন আর্মেনিয়ানরা। চাকরি করতেন, ধর্ম প্রচার করতেন, আরো কতো কি!

সেদিক থেকে আর্মেনিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। আনুমানিক ষোড়শ শতক থেকেই বাংলায় আর্মেনীয় ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি শুরু হয়। পারস্যের সাফাভি শাসকরা ষোল শতকে পশ্চিমের পাহাড়ি দেশ আরমানিয়া দখলের প্রেক্ষাপটে আর্মেনিয়ানরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। মোগলদের সমসাময়িক সময়ে ঢাকায় আর্মেনিয়ানদের আগমন ঘটে। ভাগ্য বদলের লক্ষ্যে ঢাকায় আসা আর্মেনিয়ানরা অল্পদিনের মধ্যেই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। এখানে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য দ্রুত বিস্তারের মাধ্যমে তারা শহরের গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। আঠারো শতকে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির রমরমা ব্যবসা ছিল লবণ। এই লবণ উৎপাদনএবং বিতরণের জন্য কোম্পানির ঠিকাদারদের অধিকাংশ ছিল আর্মেনিয়ান।

ব্যবসায়িক সাফল্যের কারণে আর্মেনিয়ান পরিবার আঠারো শতকে ঢাকয় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। ঢাকা শহরের যে স্থানটিতে তারা শ্রেণীবদ্ধভাবে বসত শুরু করে সে স্থানটি আরমানিটোলা নামে পরিচিত। বর্তমানে আর্মেনিয়া পুরনো ঢাকার একটি স্থান। আর্মেনিয়ার অধিবাসী বা আর্মেনিয়ানরা থাকতেন বলেই এলাকাটির নামকরণ হয়ে যায় আর্মানিটোলা।

এই আর্মেনিটোলা যাদের কল্যাণে সেই তাদের দেশেই এসেছি আন্তর্জাতিক মূকাভিনয় উৎসবে। রাত দেশটায় বিমানবন্দর থেকে আমাদের ড্রপ দিলেন উৎসব আয়োজকদের দু’জন সদস্য বাগরাত এবং অতিব সুন্দর আর্মেনি মুহতাসিন।

প্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে দেশটির। বিশ্বে এই দেশটিই প্রথম রাষ্ট্রীয়ভবে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে। সভ্যতার পরিবর্তনে প্রথম দিকে ছিলো বাইজেন্টান সভ্যতার অধীনে। এরপর অটোম্যান সাম্রাজ্যের শাসনাধীন এবং সর্বশেষ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৯১ সালে।

পাহাড়-পর্বত বেষ্টিত দেশটির রাজধানী ইয়েরেভানের বিভিন্ন স্থানে ঘুরলাম। এক কথায় অসাধারণ অনুভূতি। এমন গোছানো, পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন, পরিকল্পিত একটি রাষ্ট্র। রাস্তায় কোন ট্রাফিক পুলিশ নেই। সিগন্যাল পড়ছে। গাড়ি থেমে যাচ্ছে। পথচারীরার রাস্তা পার হচ্ছেন! সকালে উঠে গেলাম রিপাবলিক স্কয়ারে। দারুণ এই স্কয়ারে কিছুক্ষণ ছবি তুললাম। এসময় পরিচয় হয় কয়েকজন ইরানির সঙ্গে। সখ্যতা হয়। একত্রে সেলফিও তোলা হলো।

এরপর গেলাম মস্কুভিয়ান স্ট্রিটে অবস্থিত আর্মেনিয়ান ইয়ুথ থিয়েটারে। দেখা হলো আন্তর্জাতিক মূকাভিনয় উৎসবের আয়োজকদের সঙ্গে। আলাপ হলো। উৎসবের আইডি কার্ড নিলাম। এরপর তারা জানিয়ে দিলেন, আগামীকাল সকাল ১১টায় উৎসব নিয়ে প্রেস কনফারেন্স আছে। সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে সঠিক সময়ে।

এই পর্ব শেষ করে আমরা যাত্রা করলাম আর্মেনিয়ান বাংলাদেশে। গতকাল থেকে শুনছি ইয়েরেভানে বাংলাদেশ নামক একটি ডিস্ট্রিক রয়েছে। শোনার পর থেকে অস্থিরতা অনুভব করছিলাম জেলাটি দেখার জন্য! বাংলাদেশ নামের জেলা! এটি সত্যি তো আশ্চর্যজনক ব্যাপার! না দেখলে বিশাল অপরাধ হয়ে যাবে এবং তা দ্রুতই দেখতে নিজেকে নিজে এমনটাই বলছিলাম। কিছু সময় পেয়ে আর অপেক্ষা করিনি। মস্কুভিয়ান স্ট্রিট থেকে ৯৯ নাম্বার বাস নিয়ে রওনা হলাম বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে…..