চার বছর আগে ব্রাজিলের মারাকানায় লেখা হয়েছিল এক বিরহগাঁথা। যার ট্র্যাজেডির নায়কের নাম লিওনেল মেসি। সেবার পুরো ফুটবলবিশ্বই যেন চাচ্ছিল মেসির হাতে উঠুক বিশ্বকাপ। কিন্তু ফাইনাল শেষে কাপ উঠল জার্মান অধিনায়ক ফিলিপে লামের হাতে।
চার বছর বাদে আরেকটি বিশ্বকাপের দ্বারপ্রান্তে মেসি। আর্জেন্টিনাকে এবার প্রায় একক নৈপূন্যে এনে দিয়েছেন রাশিয়ার টিকিট। বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচে ইকুয়েডরের বিপক্ষে মেসির হ্যাটট্রিক না হলে অন্যরকম কিছু ঘটার সম্ভাবনাও ছিল, সেটা দুবার বিশ্বজয়ী দলটিকে ছাড়া বিশ্বকাপ।
শেষপর্যন্ত হয়নি, যেটা হয়েছে সেটা মেসির কাঁধে ভর করে দীর্ঘ শিরোপা খরা ঘোচানোর স্বপ্নযাত্রার পালে হাওয়া দিয়েছে নতুন করে। কেমন ছিল আগের আসরে বিশ্বকাপ হারানোর দুঃখ, নতুন বিশ্বকাপে কেমন হবে শিরোপার মিশন, সেসব নিয়ে লিওনেল মেসি দিয়েছেন বিশেষ সাক্ষাৎকার।
মারাকানার হারটা কী এখনো জ্বালায়?
মেসি: এটা হল একটা উন্মুক্ত ক্ষত। সারাজীবন জ্বালাতে থাকবে। আমরা আমাদের স্বপ্ন পূরণের খুব কাছে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু এটাই ফুটবল। সেরা দলটা সবসময় জেতে না। আমাদের এটা মেনেই সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আমি কেঁদেছি, আমরা সবাই কেঁদেছি। আর্জেন্টিনার হয়ে যারা জিততে চেয়েছি, সবাই কেঁদেছি। ব্যথাটা এখনো হৃদয়ে রয়ে গেছে।
আরেকটা বিশ্বকাপ চলে এলো। আকাশছোঁয়া প্রত্যাশার উত্তাপ পারদের মতো বাড়ছে নিশ্চয়ই…
মেসি: আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। তবে আমরা জয়ের জন্যই খেলবো। ১৯৮৬ সালের পর আরেকটা বিশ্বকাপ জিততে না পারায় প্রত্যাশার চাপ বাড়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রত্যেক আর্জেন্টাইনই তাই চায়। আমি নিজেও বিশ্বকাপ জিতে দেশের জন্য দারুণ আনন্দ বয়ে আনতে চাই। প্রত্যেক আলবিসেলেস্তে খেলোয়াড়ই নিজের সেরাটা দিয়েছিল ২০১৪ সালে। যদিও আমরা পারিনি।
২০১৮তে কী আর্জেন্টিনা পারবে?
মেসি: আমার স্বপ্ন একই আছে। ফাইনালে ওঠা আর কাপটা তুলে ধরা। খুব কাছে থেকেও শিরোপা তুলতে না পারার কষ্টটা আসলে বলে বোঝানো যাবে না। আমরা এখনো তাই চাই, শুধু ফলাফলটা ফিরে আসুক সেটা চাই না। আমরা আমাদের শেষ প্রজন্মের খেলোয়াড় হিসেবে সত্যিই কাপটা তুলে ধরতে চাই।
জাতির স্বপ্ন বয়ে বেড়ানো কী আপনার জন্য দুঃসহ যন্ত্রণার কারণ হয়ে যাচ্ছে?
মেসি: না, আসলেই না। আপনি যদি একজন আর্জেন্টাইন আর ফুটবলপ্রেমিক হয়ে থাকনে, তাহলে আপনি দেশের হয়ে সর্বোচ্চটাই জিততে চাইবেন। এরমধ্যে ভুল কিছু নেই। সত্যি বলতে, আমি এভাবেই ভেবেছি। আমরা জানি বিশ্বকাপ জেতা কত কঠিন, কিন্তু আমরা সবাই এটা চাই। আর্জেন্টিনার সত্যি এটা দরকার।
আপনার প্রজন্মের ফুটবলাররা, বিশেষত আপনি প্রায়ই নিজ দেশের গণমাধ্যমে সমালোচনার শিকার হন। এটা কতটা যন্ত্রণার?
মেসি: অবশ্যই এটা যন্ত্রণার। কিন্তু আপনাকেও বুঝতে হবে তারাও আমাদের মতো যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছে। আর্জেন্টিনা এক ফুটবলপাগল দেশ। গণমাধ্যম যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় আসলে সেটাই স্বাভাবিক। তাই টানা তিন ফাইনালে রানার্সআপ হওয়াটা আমাদের কাছে অর্থহীন। আসলে আর্জেন্টিনা এমন একটা জায়গা, যেখানে রানার্সআপদের জন্য কোনো জায়গা নেই।
আইসল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, নাইজেরিয়াদের নিয়ে কঠিন গ্রুপে পড়েছে আর্জেন্টিনা। আপনার ভাবনা…
মেসি: যখন সেরাদের সেরার বিপক্ষে খেলবেন, তখন আপনাকে নিজের সেরাটা দিয়েই খেলতে হবে। প্রত্যেক প্রতিপক্ষ চাইবে আপনাকে অনর্থক প্রশ্ন করে বিব্রত করতে, আপনাকে সেজন্য তৈরি থাকতে হবে। এটা বিশ্বকাপ। সবকিছু মেনে নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। একমাত্র বিশ্বসেরারাই এখানে নিজেদের জাহিরের সুযোগ পাবে। প্রত্যেক ম্যাচই হবে ভীষণ কঠিন। তবে, আমরাও প্রস্তুত লড়ার জন্য।
আসরের ফেভারিট বললে আপনি কাদের বেছে নেবেন?
মেসি: প্রত্যেকটা ফুটবলখেলুড়ে বড় দেশগুলো নিজেকে ফেভারিট ভেবে আসর শুরু করবে। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন জার্মানি চাইবে আরও একবার শিরোপার স্বাদ নিতে। স্পেনের ভালো একটা দল আছে, যারা অনেকদূর পর্যন্ত যেতে পারে। ব্রাজিল, পর্তুগাল বাছাইপর্বে দারুণ খেলে এসেছে, ফ্রান্সও তাই।
আপনার কী অবাক লাগে না যে ইতালি-নেদারল্যান্ডসের মতো বড় দুই দেশ এবারের বিশ্বকাপে নেই?
মেসি: এটাই প্রমাণ করে যে বিশ্বকাপ কতটা কঠিন। ইতালিকে ছাড়া একটা বিশ্বকাপ কল্পনাও করা যায় না। নেদারল্যান্ডস তো ব্রাজিল বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছিল। আমরা তাদের টাইব্রেকে হারিয়ে ফাইনালে গিয়েছিলাম। আজ্জুরি আর কমলা রঙে রাঙানো সমর্থকদের অভাব অনেক বোধ করবে রাশিয়া।
আপনারা নিজেরাও তো রাশিয়ার বিমানের টিকিট অল্পের জন্য হাতছাড়া করতে বসেছিলেন। ইকুয়েডরের বিপক্ষে আপনার হ্যাটট্রিকই পরে রাস্তা খুলে দিল আর্জেন্টিনার…
মেসি: আমাদের ম্যাচটা জিততেই হতো। আমরা পিছিয়ে থেকে খেলা শুরু করেছিলাম। এরপর পুরো ম্যাচটাই পরিকল্পনা মাফিক হয়েছে, আমি গোল করলাম। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হল দলের সবাই মিলেই এটা সম্ভব হয়েছে। এটাই চিরন্তন, সবচেয়ে বড় আসর। যেকোনো মূল্যে আমরা চেয়েছি এর অংশ হতে। আমরা খুশি যে প্লে-অফের ঝামেলা ছাড়াই সরাসরি রাশিয়া বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলতে পারছি।
গ্রুপপর্বের ড্রয়ের পর ইভান রাকিটিচ(বার্সেলোনা সতীর্থ) আপনাকে কী বলেছেন? যখন দেখলেন আর্জেন্টিনা আর ক্রোয়েশিয়া একই গ্রুপে?
মেসি: সত্যি বলতে খুব বেশিকিছু না। ইভান দারুণ একজন ফুটবলার আর নিবেদিতপ্রাণ সতীর্থ। সে দারুণ একজন যোদ্ধাও। যে ভঙ্গিতে খেলতে ভালোবাসি সে আমাকে সে ভঙ্গিতে খেলতে দেবে না। সে লুকা মদ্রিচের সঙ্গে দারুণ এক জুটি গড়ে তুলবে। তবে, সেও কিন্তু আমাদের কাছ থেকে একই রকম আতিথেয়তা পাবে। বার্সেলোনায় অনুশীলনের সময় আমরা সেই ম্যাচ নিয়ে টুকটাক আলোচনা করেছি, এই যা!