কোনো বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া যেকোনো দিনই অন্য আরেকটি দিন। যার বা যাদের কোনো উপলক্ষ আছে তাদের ছাড়া ২০ এপ্রিলও তাই ৭০০ কোটি বিশ্ববাসীর জন্য অন্য আরেকটি দিনের মতোই। তবে, চ্যানেল আই– আরো স্পষ্ট করে বললে চ্যানেল আই অনলাইনের জন্য ২০ এপ্রিল একটি বিশেষ দিন। পাঁচ বছর আগে এদিন যাত্রা শুরু করেছিল চ্যানেল আই অনলাইন। সে হিসাবে আমরা আজ ৬ষ্ঠ বর্ষে পদার্পণ করলাম।
গত পাঁচ বছর এদিনটিতে চ্যানেল আই ভবনে একটি উৎসবের আবহ থাকে। অন্যদিনের চেয়ে সংবাদকর্মীদের পোশাকে একটু পরিবর্তন আসে, উৎসবের আবহে মেয়েরা শাড়ি পরেন, ছেলেরা অনেকে পাঞ্জাবি। নিউজরুম তাই অন্যদিনের চেয়ে একটু রঙিন হয়ে উঠে। বিকেলের দিকে একটা ছোট গেট-টুগেদার হয়, সেখানে একজন বিশেষ বক্তা সাংবাদিকতার সুনির্দিষ্ট কোনো দিক নিয়ে বক্তৃতা করেন, আমাদের কর্মীরা আরো ঋদ্ধ হন। ওই অনুষ্ঠানে সেরাকর্মীদের স্বীকৃতি হিসেবে পুরস্কৃত করা হয়, সবশেষে থাকে কেক কেটে চ্যানেল আই অনলাইনের জন্মদিন উদযাপন।
আমাদের সাইটে এবং টেলিভিশন পর্দায় এসব আয়োজন নিয়ে নিজের ঢোল নিজে পেটানোর মতো হলেও কিছু সংবাদ থাকে। বিশিষ্টজনদের শুভেচ্ছায় সিক্ত হয়ে আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের শুভেচ্ছাবাণী পরিবেশন করি। কর্মীদের নিজেদের ফেসবুকেও জন্মদিন উদযাপনের ছোঁয়া থাকে।
আজ ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল আমি যখন নিউজরুমে বসে বর্ষপূর্তি নিয়ে লিখছি, তখন আমাদের অনলাইন সেকশনটি খা-খা করছে। কারণ অনলাইনের সকল কর্মী একমাসেরও বেশি সময় ধরে ভার্চুয়াল অফিসে বাসা থেকে কাজ করছেন। শুধু অনলাইন নয়, টেলিভিশনেরও একটি অংশ হোম অফিস থেকে কাজ করছেন। অফিসের অনেকগুলো ওয়ার্ক স্টেশনেই লেখা নোটিশ ঝুলছে: হোম অফিস থেকে কাজ চলছে, দয়া করে কম্পিউটারটিতে হাত দেবেন না বা বন্ধ করবেন না। শুধুমাত্র যে কাজগুলোর জন্য অফিসে আসতেই হবে, কিংবা মাঠে যেতে হবে- সেই কাজগুলোর জন্য অল্পসংখ্যক টেলিভিশন কর্মীকে এখন নিউজরুমে দেখছি। দুইশ জনের নিউজরুমে এ মুহূর্তে সবমিলিয়ে কর্মী আছেন দশ থেকে বারোজন।
শুধু আমাদেরকে নয়, পুরো বিশ্বকেই এ অবস্থায় নিয়ে এসেছে সাড়ে তিনমাস বয়সী এক ঘাতক যার নাম করোনাভাইরাস।এ থেকে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে মানুষকে তথ্য জানানোর বিষয়টি এখন শুধু আমাদের বা বাংলাদেশের গণমাধ্যম নয়, পুরো বিশ্বের গণমাধ্যমের জন্যই এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।
সাংবাদিকতা এমন একটি পেশা যেখানে স্বাস্থ্যকর্মী বা শৃঙ্খলা বাহিনীর মতো পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই বলা হয় সাংবাদিকতা হচ্ছে সাহসী মানুষের পেশা বা সাহস হচ্ছে সাংবাদিকের জন্য অবশ্যম্ভাবী একটি গুণ। তবে, পিলখানা হত্যাযজ্ঞ বা আগুন সন্ত্রাস কাভার করতে যে সাহস প্রয়োজন, এখনকার প্রেক্ষাপট তার চেয়ে ভিন্ন। অবশ্যই এখানে ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা স্বাস্থ্যকর্মী বা শৃঙ্খলা বাহিনীর মতোই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চ্যানেল আই’র পক্ষ থেকে সেই সুরক্ষার জন্য যা যা করার প্রয়োজন তার সবই করছি, তারপরও বলতে হয় এসবই আসলে লখিন্দরের বাসরঘর।
তাহলে কি বর্তমান সময়ে সাংবাদিকরা সবকিছু থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে সংবাদপত্র প্রকাশ বা টেলিভিশন/বেতারে সংবাদ প্রচার কিংবা অনলাইন অপারেশন বন্ধ করে দেবে? সেটা হওয়ার নয় বলেই কিছু পত্রিকা মুদ্রণ স্থগিত করলেও প্রতিদিন সকালে আমরা পত্রিকা পাচ্ছি, শুধু টপ অফ দ্য আওয়ার নয়- প্রতি মুহূর্তেই টেলিভিশন এবং বেতারে নিউজ আপডেট পাচ্ছি এবং মিনিটে মিনিটে মোবাইল স্ক্রিন বা ল্যাপটপ/ডেস্কটপে অনলাইনগুলোর নোটিফিকেশন পাচ্ছি।
সাধ্যমতো আপাত চোখে নিজের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করে সংবাদকর্মীরা যে কাজ করে যাচ্ছেন, এটা শুধু তাদের সাধারণ পেশাগত দায়িত্বপালন নয়। করোনাকালে বিশেষ এ সাংবাদিকতা আসলে বাংলাদেশের সকল মানুষের স্বার্থ নিশ্চিত করার এক মহান এবং মহাযজ্ঞ।
এর প্রথম কারণ, সাংবাদিকতার মূল পাঠ: মানুষকে সঠিক তথ্য জানানো। আমরা জানি, যেকোনো দুর্যাগে সত্যের চেয়ে মিথ্যা বা গুজব বেশি ছড়ায়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এ সময়ে গুজবের ডালপালা ছড়ায় আরো বেশি এবং আরো দ্রুত। সঠিক তথ্য জানানো এবং জানার মাধ্যম তাই গণমাধ্যম। একইসঙ্গে মানুষকে সচেতন করে সাহস দেওয়ার জন্যও বিশেষ এ সময়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সাংবাদিকতার যে মূল উদ্দেশ্য তার প্রতিপালন, সেটা হচ্ছে সত্য উন্মোচন। আপনারা একটু ভেবে দেখুন, গত কয়েক মাসে সরকারের নানামুখি প্রস্তুতির পরও অনেক সিদ্ধান্তই এসেছে গণমাধ্যমে সংবাদের পর। সেটা চিকিৎসকদের পিপিই নিশ্চিত করা বা পরীক্ষা কিটের স্বল্পতা কিংবা হাসপাতালগুলোর নানা সমস্য থেকে শুরু করে সমন্বয়ে সমন্বয়হীনতা কিংবা গরিব মানুষের সহায়তা– সব ক্ষেত্রেই। তালিকা করলে তা অনেক দীর্ঘ হবে।
এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আসলে কর্তৃপক্ষীয় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, যার মাধ্যমে করোনা মোকাবিলায় সর্বোচ্চ সবকিছু করা যায়, শেষ পর্যন্ত মানুষের জীবন রক্ষা পায়। এ মুহূর্তে গণমাধ্যম না থাকলে এসবের অনেককিছুই হতো না। গণমাধ্যমকে তাই সাধারণ সময়ের চেয়ে আরো বেশি সক্রিয় থাকতে হচ্ছে।
এক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ অবশ্য সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। সেটা যেমন স্বাস্থ্যগত তেমনি অর্থনৈতিকও। সামগ্রিকভাবে আমাদের গণমাধ্যম এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আসলে কতোটা প্রস্তুত তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আমরা কঠিন এ সময়ে দেখছি অনেক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে বেতন হয়নি, বিশেষ প্রেক্ষাপটে কাজ করলেও কর্মীদের জন্য কোনো ঝুঁকিভাতা বা বীমা নেই। তবে, এগুলোর জন্য সরকারের কাছে হাত পাতলে এবং সরকারও দয়া-দাক্ষিণ্য দেখালে সাংবাদিকতা কতোটা হবে সেটা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। গণমাধ্যমের জন্য অনুদান কোনো পথ নয়, বরং অন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য সরকার যেমন ঋণসুবিধা দিচ্ছে, বিপদে পড়া গণমাধ্যমের জন্যও সেটা সম্প্রসারিত করা যেতে পারে।
পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মী এবং সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোরও এ মুহূর্তে কিছু মানবিক দায়িত্ব আছে। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেই উদ্যোগগুলো নিয়ে এখন গণমাধ্যমকর্মীদের পাশে সাংবাদিকদেরও দাঁড়াতে হবে। ব্যক্তি উদ্যোগে আমরা সবাই কিছু না কিছু করছি। বিষয়টি সংগঠনগত বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হলে হয়তো আরো কার্যকর হবে।
ছোট করে বললে চ্যানেল আই অনলাইনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এ সময়ে, মানে এ করোনা পরিস্থিতিতে সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতার তিনটি প্রধান কাজ:
১. নিজেদের সুরক্ষা।
২. নিজেদের সুরক্ষিত রেখে করোনা পরিস্থিতির সত্য উন্মোচন যাতে নীতি-নির্ধারকরা তাদের মনোযোগের বাইরে থাকা বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দিয়ে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমিয়ে আনার পাশাপাশি যাদের প্রয়োজন তাদের খাবারসহ অন্য বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারেন এবং অর্থনীতি বিশেষ করে ব্যক্তি খাত কিছুটা হলেও সচল রাখতে পারেন।
৩. অফিসের ভেতরে বাইরে আরো বেশি সহমর্মী মনোভাব নিয়ে সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত বিষয়ে ব্যক্তি বা সামষ্টিকভাবে একজন আরেকজনকে সহায়তা করা।
আমরা আমাদের জায়গা থেকে এগুলো করার চেষ্টা করছি।এবার তাই উদযাপন না করা প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে আমাদের ঘোষণা না করা প্রতিপাদ্য: মানুষের জন্য সাংবাদিকতা। আরো বেশি সত্য উন্মোচনই আমাদের এবারের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর উদযাপন।
চ্যানেল আই অনলাইনের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে আমাদের অনলাইন এবং টেলিভিশন কর্মীদের আরো একবার অভিনন্দন। আমাদের পাঠক-দর্শক-পৃষ্ঠপোষকসহ সবার জন্য শুভেচ্ছা। সকলের সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।