অভাবের সংসারে একটু স্বস্তি এনে দিতে রানা প্লাজা ধসের মাত্র ৭ দিন আগে স্বামীকে না জানিয়ে নিউওয়েভ স্টাইল লিমিটেডে চাকরি নিয়েছিলেন বিলকিস বেগম। কিন্তু তার সেই ইচ্ছার মৃত্যু ঘটে রানা প্লাজার চাপায়। ওই ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ বিলকিসের আজও খোঁজ পায়নি তার পরিবার।
ঘটনার সময় বিলকিসের তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে সবার ছোট আব্দুল্লাহ আল মামুনের বয়স ছিল চার বছর। বড় মেয়ে খাদিজা আক্তারের ১২ আর ছোট মেয়ে ফাতেমা আক্তারের বয়স ছিল ৯ বছর।
বৃহস্পতিবার সকালে বাবা মুসা মুন্সীকে সাথে নিয়ে মামুন এসেছিল দুই বছর আগে নিখোঁজ হওয়া মাকে আরো একবার খুঁজতে। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মামুন। কিন্তু তার মাকে খুঁজে পায়নি। কোন দিন পাবেও না। মামুন না বুঝলেও অন্যরা ঠিকই জানেন, লাশ পাওয়া না গেলেও বিলকিস বেঁচে নেই।
সেদিনের কথা স্মরণ করে মুসা মুন্সী জানান, আগেরদিন রানা প্লাজায় ফাটল দেখা দেওয়ার পর ওই ভবনে থাকা সবগুলো প্রতিষ্ঠানেই শ্রমিকদের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। বিকেলে বাড়ি গিয়ে বিলকিস তার সন্তানদের ঘটনার কথা বলেন। পরদিন সকালে তাকে যখন ফ্যাক্টরি থেকে কাজের জন্য ডেকে পাঠানো হয়; ছোট্ট মামুন তখন মাকে বার বার বলেছিল, ‘আম্মু যেও না।ওই বিল্ডিং ভেঙ্গে যাবে। তুমি ওখানে গেলে মারা যাবে। যেও না আম্মু।’
সেদিন এসব কথা বলে প্রায় ১০ মিনিট মাকে আটকে রেখেছিল মামুন। ওর কথা শোনেননি বিলকিস। সেই শেষ দেখা, মায়ের কাছে শেষ চাওয়া।
মুসা মুন্সী দীর্ঘ নি:শ্বাস ছেড়ে বলেন, ইস সেদিন যদি ছেলেটার কথা শুনতো!
বিলকিস নিখোঁজ হওয়ার পর আজও স্বাভাবিক হতে পারেনি শিশু মামুন। এখনো মাঝরাতে মায়ের কথা মনে হলে ডুকরে কেঁদে ওঠে।
‘মাঝে মাঝেই গভীর রাতে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে মামুন। বলে আম্মু আমার কাছে পানি চায়।’ বলেন মুসা মুন্সী।
একটু সুখের আশায় রাজমিস্ত্রীর সহকারি হিসেবে কাজ করা মুসা গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার হলুদিয়া এলাকা থেকে সাভারে এসেছিলেন। কিন্তু রানা প্লাজা তার সব স্বপ্ন, সব আশা শেষ করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ওই দিন ঘটনা শুনে সাথে সাথেই দৌড়ে আসি। শত শত লাশের মধ্যে আমার স্ত্রীকে খুঁজেছি। ১৫/২০ দিনের পচা লাশ হাতড়ে বেড়িয়েও লাভ হয়নি। তবে আমার একটি লাশের কথা মনেহয়। যে লাশটি অন্য কেউ তাদের বলে সনাক্ত করেছিল। ওই লাশের পা দেখেই আমি নিশ্চিত হয়ে ছিলাম সেটা বিলকিসেরই লাশ। কিন্তু আমার কথা কেউ শোনেনি।’
নিখোঁজের স্বজন হিসেবে ছেলে-মেয়েসহ প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টাকার সরকারি অর্থ সহায়তা পেয়েছেন মুসা মুন্সী।
‘সেদিন আমার কাছে টাকা ছাড়া সবই ছিল। আজ টাকা আছে কিন্তু জীবন নেই।’ এ কথা বলে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তপের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলেন মুসা মুন্সী। তার সঙ্গে কাঁদে শিশু মামুনও।