মেয়েরা ছোট থেকে একটু একটু করে বড় হতে থাকে, চলার পথে সমস্যা ও জটিলতার সম্মুখীন হতে থাকে। কোনোটা সমাধান হয় আবার কোনটা নিরবে নিভৃতে একটি গ্লানি হয়ে রয়ে যায়। হাজার পেরিয়ে লক্ষ লক্ষ মেয়ের জীবনে যুক্ত হয় নানা রকমের গ্লানি, কষ্টের অধ্যায়। তার ক’জনার খবর আমরা জানি।
যারা পারিবারিকভাবে প্রভাবশালী তারা কিছুটা সমস্যা সমাধান করে বা জীবনের পুরনো ক্ষত মুছতে পারলেও অন্যদের জন্য তা বেশ কঠিন। যেসব মেয়েদের বড় ভাই বা বাবার জোর থাকে না, তাদের মনে হয় ‘যদি আমার একটা বড় ভাই থাকত !’ পারিবারিক শক্তিটাই মেয়ের চলার পথকে সহজ করে।
এক সময় ভাবতে শিখলাম এমন ভাবনার শেষ হবে একদিন। এ ভাবনা দূর হলেও দেখছি, মেয়েরা এখনও ঘরে বাইরে মোটেও নিরাপদ নয়। সুন্দরভাবে বাঁচতে প্রয়োজন শিক্ষার। শিক্ষা অর্জনের জন্য মেয়েরা যখন বাইরে যায় তখন শুরু হয় নানা সমস্যা। মোড়ের দোকান, স্কুল কলেজের পাশে দোকান থেকেই মেয়েদেরকে বিব্রত হতে হয়, অপমানিত হতে হয়। এখানেই বখাটেদের প্রধান আড্ডাস্থল।
শিক্ষায়, কর্মক্ষেত্রে, উন্নয়নে নারী এগিয়ে চলেছে। এর পেছনে রয়েছে সরকারের সহযোগিতা এবং মেয়েদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই নারী নির্যাতনের খবর। দেশের আনাচে, কানাচে, গ্রামে শহরে সর্বত্র নতুন নতুন কৌশলে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। সমাজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মানুষরূপী কিছু অমানুষ নারীর অগ্রগতিকে পিছে টানতে সব সময়ের জন্য অপতৎপরতায় লিপ্ত। আমাদের দেশে আইন আছে, নেই প্রয়োগ। সচেতনতা আছে, নেই সামাজিক উদ্যোগ।
গত ১৯ অক্টোবর, ২০১৬, রাজধানীর বিসিআইসি কলেজে দুই ছাত্রীকে রাস্তায় ফেলে বেধড়ক পিটিয়েছে বখাটে দোকানদার ও তার বন্ধুরা। দুই ছাত্রী বখাটে দোকানদারের উত্ত্যক্তকর আচরণের প্রতিবাদ করায় এমন করুণ পরিস্থিতির মুখোমুুখি হতে হয়েছে। নির্বাক দাঁড়িয়ে দেখেছে, অনেক লোক। কলেজের কয়েকজন ছাত্র ছুটে গিয়ে তাদের উদ্ধার করেছে। সিলেটের খাদিজাকে বখাটে বদরুল যখন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়েছে তখনও বহুলোক দাঁড়িয়ে দেখেছে। মজার দৃৃশ্য মনে করে ছবি তুলেছে।
যারা মাঝে মধ্যে নিউ মার্কেটে যান তাদের প্রায় সবাই গাওছিয়া মার্কেটেও যান। এখানে অনেকেই বিব্রতকর ও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির শিকার হন। সেখানে ফুটপাত জুড়ে বসা অস্থায়ী দোকানগুলোর সামনে অনেক বেশি ভিড় হয়। ভিড়ে মিশে থাকা বখাটেরা মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে উদ্দেশ্যমূলক গুঁতা দিয়ে, কৌশলে পকেট মেরে পালিয়ে যায়। এটি নিত্যকার ঘটনা। এসব ফুটপাতের দোকানের কর্মচারীদের আচরণ ভীষণ উত্তেজিত ও উত্ত্যক্তকর। তার প্রতিবাদ করলে শুধু মন আর পরিবেশ নষ্ট হয়। কোনো সমাধান হয় না। প্রায় দুই সপ্তাহ আগে এক কলেজ ছাত্রী ও তার মায়ের সাথে অত্যন্ত বাজে আচরণ করে তাদের আটকে রাখা হয়। মেয়েটির কলেজের বন্ধুরা মা-মেয়েকে সেখান থেকে উদ্ধার করে।
রাজধানীর মৌচাক মার্কেট অনেক পুরাতন ও পরিচিত একটি বিপনীকেন্দ্র। সেখানে সামনে, পিছনে, পাশে গলিতে ফুটপাত জুড়ে দোকান। এই ব্যস্ততম মার্কেটের ফুটপাতের দোকানী ও কর্মচারীদের আচরণও অত্যন্ত আপত্তিজনক। বেশিরভাগ দোকান কসমেটিকসের এবং অল্প বয়সের ছেলে দ্বারা পরিচালিত। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো নারী ওদের কাছে অপদস্ত হয়। যা মার্কেটে আসা বিভিন্ন মানুষের কাছে শুনলে বা একটু দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করলেই দেখা যায়।
মৌচাক থেকে শান্তিবাগ পর্যন্ত দীর্ঘ ফুটপাত হকারদের দখলে। একদিকে ফ্লাইওভারের কাজ হচ্ছে, রাস্তা ভাঙা, কাদা- পানি অন্য দিকে ফুটপাত দখল। মানুষ তার মধ্য দিয়ে চলাচল করে। ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকে পকেটমার, ছিনতাইকারীরা। অনেক মানুষ ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে ট্রাফিক পুলিশের কাছেও যায়। তারা ‘সরি’ বলে নির্বাক হয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
গত ২৮ অক্টোবর, ২০১৬, শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে মৌচাক মার্কেটে কাজ সেরে মার্কেটের সামনে ফুটপাতে দাঁড়িয়েছি আমার ব্যক্তিগত গাড়ি আসার অপেক্ষায়। ফুটপাত থেকে নিচে দাঁড়াবার কোনো উপায় নেই। চারিদিকে বৃষ্টি কাদা। যানজট তো আছেই। দাঁড়াতেই মোড়ের ফলের দোকানদার বেশ রুঢ়ভাবে সরে দাঁড়াতে বলল। আমি আশে পাশে সরে যাওয়ার মতো জায়গা না দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে দোকানী ও তার কর্মচারী রীতিমত মুখ খিস্তি করে উঠল।
আমি বললাম, সরকারি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছি, সমস্যা কী? সে বলল, “বহু টাকায় জায়গা কিনেছি, এটা লোক দাঁড়ানোর জায়গা না।” একজন বলে উঠল, “শেখ হাসিনা আসছে রে, শেখ হাসিনা আইন দেখাচ্ছে।” এরপরে কয়েক কথায় ওই ফুটপাতের দোকানের কর্মচারীরা অকথ্য ভাষা ব্যবহার করতে থাকে। রীতিমত মারমুখি আচরণও করে। পথচারীদের দু’য়েকজন ছুটে এসে ওদেরকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। অন্যান্য দোকানদাররা তা দাঁড়িয়ে দেখে।
আমি মার্কেটের সিকিউরিটিদের সাহায্য চাইলে তাদের খোঁজ পাওয়া যায় অনেক পরে এবং বলে এখানে তো আমাদের ডিউটি না। বিষয়টিতে যারপরনাই হতাশ ও অপমানিত হয়ে রমনা থানায় গিয়ে একটি ডায়েরি পর্যন্ত করলাম। আমি ইচ্ছে করলে মামলাও করতে পারতাম। কারণ, ওদের আচরণের মধ্যে প্রচলিত আইনের দৃষ্টিতে ঘোরতর অপরাধ হয় এমন অনেকগুলো বিষয় রয়েছে। অনায়াসেই বেশ কয়েকটি ধারা যোগ করা যেত।
মামলা করিনি, কারণ আমাদের আদালতের নিয়ম অনুসারে সাক্ষী লাগবে। সেখানে উপস্থিত পথচারীদের আমি পাব না। আর কোনো দোকানদার অন্য দোকানদারের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবে না। কিছুদিন দৌঁড়ানোর পর আমিও ক্লান্ত হয়ে যাব। যে কারণে কেউ থানা পুলিশ করতে চায় না। কিন্তু প্রতিবাদ তো করতেই হবে। আমাদের সাধারণ মানুষকে প্রতিবাদ করা জানতে হবে শিখতে হবে। এটা আমাদের নাগরিক অধিকার।
ফিরে আসি লেখাটির শুরুর প্রসঙ্গে। ছোট থেকে একটু একটু করে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও ভাবতাম – আমার বড় যদি একটা ভাই থাকত! তাহলে জীবনের পথ-চলা সহজ হতো! আমার এখন অনেক বড় ভাই, ছোট ভাই আছে। সেই সাথে আছে অনেক বোন-বন্ধু। যা পেয়েছি সংগঠন করতে গিয়ে মানুষকে ভালবেসে। আইনের শিক্ষার্থী হিসেবে মানুষের আইনী অধিকার আর অপরাধের অনেক ধারাও আমি জানি। নারীর পক্ষে আইনী অধিকার আদায় করতে রাস্তায় নামার সুযোগ ও অনুকূল পথ আমার রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার চলার পথ কতটা মসৃণ সে হিসেব এখন আর করি না। তবে অন্য মেয়েদের চলার পথ নিরাপদ করতে কি করতে পারি সেটি ভাবনার বিষয়।
কেন আমাদের সমাজের মানুষ এত বেশি অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, কেন তাদের বোধবুদ্ধি এত হিংসাত্মক হয়ে উঠছে তা বের করা খুব জরুরি। কেন আমরা নারীর চলার পথকে নিরাপদ রাখতে পারছি না, কেন ব্যক্তি সচেতনতা আর সামাজিক সচেতনতার মতো বিষয় আমাদের অধরা হয়ে উঠছে?
আসুন আমরা সমাজকে সচেতন করে তুলতে কাজ করি, নিজ নিজ জায়গা থেকে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)