ফোর কি ফাইভে পড়ি, তখনো পড়ার চেয়ে খেলাটাই ঢের গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। ছোয়াছুঁয়ি, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্দা কিংবা কানামাছি এসব খেলা ছেলেমেয়েরা একসাথেই খেলি। ফাঁকে শুধু ছেলেরা, ফুটবল নিয়েও মেতেছি। আর এই সুযোগে নিজেদের একটু বড় বড়ও ভাবতে শুরু করেছি। গোপনে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে মেয়েদের সাথে খেলাধুলা আর নয়। এমন সময় সেদিন সন্ধ্যায় এক হাঁটু কাদাজল মেখে বীরদর্পে বাসায় ফিরছি ফুটবল ম্যাচ শেষে। মাগরিবের আযান সবে শেষ হয়েছে। যার বাসা সামনে পড়ছে সেই বিদায় নিচ্ছে। আমার বাসা পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমরা আর তিন চার জন আছি। হঠাৎ দেখি আমার বাসার দেয়াল ঘেঁসে বেলা (ছদ্মনাম) দাঁড়িয়ে আছে জড়সড় হয়ে।
ও সাধারণত মাগরিবের আযান শুরু হলেই বাসায় দৌড় মারে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অবাকই হলাম। বললাম, কিরে তুই বাসায় যাসনি কেন এখনো? সবাই তো চলে গেছে !! একা একা কি করছিস এখানে দাঁড়িয়ে? বেলা কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বললো তোর জন্য দাঁড়িয়ে আছি। আমার এক ক্লাস নিচে পড়লেও খেলার কারণে আমাকে তুই তোকারিই করতো। বললাম বাসায় যেতি, বল? দেখলাম ও আরো অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। (বেলা যে অস্বস্তিতে পড়েছিলো তা আমি তখন একেবারেই বুঝিনি। ওই বয়সে বোঝার কথাও না।) বললো ওরা যাক তারপর বলবো। আমি মহা বিরক্ত হলাম। একে তো সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে তারমধ্যে দেরি হয়ে যাচ্ছে। বললাম, বললে বল না বললে বাসায় গেলাম। স্যার আসবেন পড়াতে।
বেলা জানতো সন্ধ্যায় পরপরই আমার প্রাইভেট টিচার আসতেন পড়াতে। তাই আর দেরি না করে হাতের পেছন থেকে চট করে একটা লাল গোলাপ বাড়িয়ে ধরলো আমার দিকে। বললো আমার টবের প্রথম ফুল ফুটেছে তাই তোর জন্য নিয়ে এসেছি। এবার আমার অস্বস্তির পালা। ফুলটা ভীষণ নিতে ইচ্ছে করলেও বন্ধুরা ক্ষেপাবে শুধু এই ভয়ে আমি ফুলটা নিলাম না। বোকার মতো বললাম তোর টবের ফুল আমি নিবো কেন? স্পষ্ট মনে আছে বেলা দ্বিতীয়বার খুব আকুতি করে বলেছিলো, নে না। নিয়ে নিতামও হয়তো, কিন্তু ফিক করে পাশেরজন হেসে ওঠায় বেলা এক দৌঁড়ে বাসায় চলে গেলো।
ওইদিনের পর থেকে বেলা আর কখনো খেলতে আসেনি আমাদের সাথে। ওর বাসার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বারান্দা অথবা জানালায় থাকলেও দ্রুত সরে যেতো। আমি ঠিক বুঝতাম না কেন এমন হচ্ছে ব্যাপারটা। ওদের বাসার সামনে দিয়ে সারাদিন আসা যাওয়া করতাম যেই আমি, সেই আমিই বা কেন ওপথ দিয়ে যেতে বারবার ওদের বারান্দা, জানালায় তাকাই। কিছুই মাথায় ঢুকছিলো না। এই বোঝা না বোঝার মাঝে একদিন আমরা ওদের পাড়া ছেড়ে অন্য পাড়ায় বাসা নিলাম। সময়ের সাথে ভুলেও গেলাম বেলাকে। তবে ওদের পাড়ার ছেলে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগটা রয়েই গেলো।
তারও বহু বছর পরে ঢাকা আর্মি স্টেডিয়ামে আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, হাসানের কনসার্ট। তখন আমার লেখা দু-একটি গান সবে জনপ্রিয় হয়েছে। বন্ধুদের নিয়ে কনসার্ট দেখবো বলে স্টেডিয়ামের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। একটু দূরে মেয়েদের একটা গ্রুপ। আমার এক বন্ধু দেখলাম ওই গ্রুপটার দিকে এগিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ গল্প করে আবার ফিরেও আসলো। বললাম কিরে কারা ওরা? ও বললো আরে ও তো বেলা। চিনিসনি? আমি মুহূর্তেই চিনতে পারলাম বেলাকে। তাকিয়ে দেখি বেলাও আড়চোখে বার বার তাকাছে। আবার পুরোনো সেই অস্বস্তি। আমার বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি করে ও এখন। বললো ল’ পড়ছে। জানিস ওর না একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। যেখানে ওর বান্ধবীদের এখনো বিয়েই হয়নি আর ওর ডির্ভোস হয়ে গেছে। ছেলেটা অ্যাডিকটেড ছিলো। যা কথা বল (ধুম করে আমার বুকের ভেতরটা খালি হয়ে গেলো।)বললাম না থাক, কতোদিন আগের পরিচয়, এখন হয়তো চিনবেই না। আমার বন্ধু বললো তোকে খুব ভালোভাবেই চেনে। তোর লেখা সব গানই বেলার মুখস্ত।
আমি কিছু বলার আগেই স্টেডিয়ামের গেট খুলে গেলো। শুরু হলো ভেতরে ঢোকা নিয়ে যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে আমিও ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আড় চোখে একবার তাকিয়ে দেখলাম বেলাদের গ্রুপটাও যুদ্ধ করছে ভেতরে ঢোকার জন্য। খুব ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সেবার বলতে পারিনি বেলা আমার হাতটা ধরো শক্ত করে। আমরা ভেতরে ঢুকে একসাথে কনসার্ট দেখবো। একটু পরে মানুষের ভীড়ে হারিয়ে গেলো বেলা। তারপর থেকে আজ অব্দি বেলার সাথে আমার দেখা হয়নি। তবে মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে একটা আবছা আবছা স্বপ্ন দেখি, একটি ফ্রক পড়া মেয়ে দৌঁড়ে আসছে আমরা দিকে আর বলছে নে না ফুলটা, আমার টবের প্রথম গোলাপ। ঠিক তখনই আমার ঘুম ভেঙে যায়। মোবাইলে ঘড়ি দেখি, টেবিল থেকে পানি নিয়ে গ্লাসে ঢেলে খাই। কিন্তু তখনো আমার সারা ঘরে একধরনের ফুলের গন্ধ লেগে থাকে, খুব সম্ভবত গোলাপ ফুলের গন্ধ। বেলা তোমাকে রোজ ডের শুভেচ্ছা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)