১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নবীন সামরিক অফিসারদের পেশাগতভাবে দক্ষ, নৈতিক গুণাবলীসম্পন্ন এবং দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করতে বক্তব্য প্রদান করেছিলেন।
ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন: আমি বিশ্বাস করি, আমাদের ছেলেদের শক্তি আছে। যেকোন দেশের সৈনিকের সঙ্গে তারা মোকাবেলা করতে পারে।
বুধবার চট্টগ্রামে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে নতুন কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সেই ভাষণটি আবারও নবীন ক্যাডেটদের বাঁজিয়ে শোনানো হয়।
বঙ্গবন্ধুর পূর্ণাঙ্গ ভাষণ
গর্বে আমার বুক ভরে যায়; এজন্যই যে বাংলাদেশের মালিক এখন বাংলাদেশের জনসাধারণ। সেজন্যই সম্ভব হয়েছে, আজ আমরা মাটিতে একাডেমি করার। আমি আশা করি, এমন দিন আসবে এ একাডেমির নাম শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নয় সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়বে।
তোমাদের মনে রাখা উচিত ক্যাডেট ভাইয়েরা, আজ তোমরা তোমাদের ট্রেনিং শেষ করলা, এক পর্যায় শেষ, আরে পর্যায় শুরু। এ পর্যায়ের দায়িত্ব অনেক বেশি। আজ তোমরা ট্রেনিং শেষ করে সামরিক বাহিনীর কর্মচারী হতে চলেছ। জাতির ওপর তোমার দায়িত্ব, জনগণের ওপর তোমার দায়িত্ব, দেশের ওপর তোমার দায়িত্ব, সামরিক বাহিনীতে তোমরা যাদের নির্দেশনা দিবা তাদের ওপর তোমার দায়িত্ব এবং নিজের ওপর তোমরা দায়িত্ব ভুলে গেলে চলবে না। তাই দায়িত্ব জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। তা না হলে জীবনে মানুষ হতে পারবা না।
শৃঙ্খলা ছাড়া জীবনে কোন জাতি জীবনে বড় হতে পারে নাই। তোদের কমান্ডররা অনেক কষ্টে তোমাদের দায়িত্ব দিয়েছে। কিন্তু আমি আজ যা দেখলাম তাতে আমি বিশ্বাস করতে পারি, আমাদের ছেলেদের শক্তি আছে, যেকোন দেশের যেকোন সৈনিকের সঙ্গে তারা মোকাবেলা করতে পারে।
বাঙালিরা সামরিক বাহিনীতে যোগদান করতে পারে না। বাঙালিরা কাপুরুষ, বাঙালিরা যুদ্ধ করতে জানে না! পাকিস্তানের সৈন্যরা বাংলার মাটিতে দেখে গেছে বাঙালিরা কিভাবে যুদ্ধ করতে পারে। আমরা বাঙালিরা আর যাই হতে পারি, কাপুরুষ নই।
আমি আমার মাতৃভূমিকে ভালোবাসতে পারি।একটা জিনিস তোমাদের মনে রাখা দরকার দেশ যখন আমাদের আছে, মাটি যখন আছে, বাংলার সোনার মানুষ যখন আছে, যদি আমরা সোনার ছেলে পয়দা করতে পারি, আমার স্বপ্নের সোনার বাংলা একদিন হবেই।
আমি দেখে না যাবার পারি, কিন্তু সোনার বাংলা একদিন হবেই। যে জাতির ৩০ লক্ষ লোক প্রাণ দিতে পারে স্বাধীনতার জন্য সে জাতি দরকার হলে কোটি লোকের জীবন দেবে। বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য। ছেলেরা আমার: তোমরা নতুন জীবনে যাচ্ছো। মনে রেখো তোমরা এক একজন সামরিক কর্মচারী। তোমাদের নিচে থাকবে আমার সৈনিক বাহিনী। তাদের কাছ থেকেও তোমাদের অনেক শেখার আছে। তাদের সঙ্গে মিশতে হবে তাদের জানতে হবে। তাদের সুখের সময়, দুঃখের সময়পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের পাশে থাকতে হবে। মনে রেখো শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে। তুমি যখন শাসন করবা সোহাগ করতে শেখো। তাদের দুঃখের দিনে পাশে দাড়িও। তাদের পাশে থেকো। কেননা, তোমরা নির্দেশে তারা জীবন দেবে। আগে তাদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা অর্জন করো। নিজকে দেশকে ভালোবাসতে হবে। মানুষকে ভালোবাসতে হবে। এবং চরিত্র ঠিক রাখতে হবে। তা না হলে কেনো ভালো কাজ করা যায় না।
মনে রেখে মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন, মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন। এতো রক্ত দিয়ে যে স্বাধীনতা এনেছি, তারপরও অনেকের চরিত্রের পরিবর্তন হয় নাই। এখনও ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, মুনাফাখোর বাংলার মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। এই মানুষদের দুঃখ দেখলে আমি পাগল হয়ে যায়। ত্রিশ লক্ষ লোকের জীবন দিয়ে যদি আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারি। তাহলে পারবো না! নিশ্চয় পারবো এই বাংলার মাটি থেকে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, মুনাফাখোর নির্মূল করতে।
এদের বাংলার মাটি থেকে নির্মূল করতে হবে। আমি প্রতিজ্ঞা নিয়েছি, তোমরাও প্রতিজ্ঞা নাও এদের নির্মূল করার। এজন্য শহীদরা রক্ত দিয়ে যায় নাই। আমি তোমাদের ভালোবাসি, তোমরা জানো। তোমরা সৎ পথে থেকো। মাতৃভূমিকে ভালোবেসো। আর যেখানেই অন্যায় অবিচার দেখবা রুখে দাড়াবা। ন্যায়ের পক্ষে দাড়াবা। গুরুজনকে মেনে, সৎ পথে থেকো, শৃঙ্খলা মেনে চলবা। মনে রেখো জনগণ কারা? তোমার বাপ-তোমার ভাই। তোমরা তাদের মালিক নও। তোমরা তাদের সেবক। তোমরা তাদের শ্রদ্ধা করতে শেখো, ভালোবাসতে শেখো। নিশ্চয় তাদের যেখানে অন্যায় হবে প্রতিরোধ করবা।
তোমাদের জন্য আমার শুভেচ্ছা রইলো। তোমরা বুঝতে পারবা কিনা আমি জানি না! আমার মনে যে কি আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। কারণ আমি কোন দিন ভাবি নাই, বাংলাদেশ মিলেটারি একাডেমি হবে আর আমি তা দেখে যেতে পারবো। তবে আমার বিশ্বাস ছিলো একদিন হবেই। কিন্তু, আল্লাহ আমাকে দেখিয়েছেন।
আমি আরও দেখে যেতে চাই। সে কি জানো: সোনার বাংলা দেখে যেতে চাই। আরও দেখতে চাই, এদেশের দুঃখি মানুষ পেট ভরে ভাত খাক, কাপড় পরুক। অত্যাচার অবিচার বন্ধ হয়ে যাক। এটা আমি দেখতে চাই।
মিলিটারি একাডেমি একদিনে গড়ে ওঠে না। এই একাডেমি একদিন আরও বড় হবে। এমন হবে সারা বিশ্ব থেকে মানুষ আমার একাডেমিকে দেখতে আসবে। সে বিশ্বাস আমি রাখি। আমি তোমাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ধন্যবাদ জানিয়ে তোমাদের কাজ থেকে বিদায় নিচ্ছি। ইনশাল্লাহ স্বাধীন দেশে রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি, এ স্বাধীনতা ইনশাল্লাহ থাকবে কেউ ধ্বংস করতে পারবে না।