ইংল্যান্ডের মাটিতে তামিম ইকবালের অনেক কীর্তি। লর্ডসে টেস্ট সেঞ্চুরির পর রাজসিক উদযাপন আজও টাইগারপ্রেমীদের চোখে ভাসে। ক্রিকেট মক্কায় বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে অনার্স বোর্ডে নাম লেখানো এ ওপেনার সাফল্য টেনে নিয়েছেন ওয়ানডে সংস্করণেও। সবশেষ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেখানে চার ম্যাচে এক সেঞ্চুরি ও দুই ফিফটিতে করেছিলেন ২৯৩ রান। অথচ এবারের ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে পেছনের কীর্তি নাকি কাজেই আসবে না!
তামিম নিজে এমনটা মনে করেন। অতীতের সব কীর্তি, রোমাঞ্চ বাক্সবন্দী করে রেখে ভাবতে চান কেবলই সামনের কথা। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করে ইংলিশ কন্ডিশনে বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাটিংয়ে পালন করতে চান অর্পিত দায়িত্ব। এমন ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকতে পারলেই নাকি বেরিয়ে আসবে সেরা পারফরম্যান্স। বুধবার শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে অনুশীলন শেষে সংবাদমাধ্যমের নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তামিম, দেশসেরা ওপেনার জানিয়েছেন নিজের বিশ্বকাপ-ভাবনা।
ইংল্যান্ডের কন্ডিশন কতটা চ্যালেঞ্জিং?
একদমই ভিন্ন আবহাওয়া থাকবে সম্ভবত। আমার কাছে মনে হচ্ছে পরিশ্রমটা আমরা এখানে করে নিচ্ছি। এমন গরম আবহাওয়ায় রানিং করা, ব্যাটিং করা, ফিল্ডিং করা, জিম করা– এটা খুব চ্যালেঞ্জিং। যে কষ্টটা আমরা এখানে করে নিচ্ছি, যখন ওই (ইংল্যান্ড) ধরণের কন্ডিশনে যাব, আমার কাছে মনে হয় যে অন্তত শারীরিক ফিটনেসের দিক থেকে সাহায্য করবে।
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ড সফর। সেখানকার কন্ডিশন নিয়ে কী ভাবনা?
আমার কাছে মনে হয় কন্ডিশনটা চ্যালেঞ্জ হবে। আয়ারল্যান্ড এমন একটা দেশ যেখানে আমরা খুব বেশি খেলিনি। শেষ যেবার খেলেছিলাম, তখনও উইকেট খুব একটা সহজ ছিল না। কঠিন ছিল। তাই আগের সাতটা দিন (সিরিজ শুরুর) এবং প্রস্তুতি ম্যাচটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম ম্যাচটা আমরা কীভাবে শুরু করি সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হবে। সেখানে আরেকটি প্রতিপক্ষ থাকবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, যারা এখন খুব ভালো ফর্মে আছে। যে কারণে সফরের শুরুটা, অর্থাৎ প্রস্তুতি ম্যাচ ও প্রথম ম্যাচটা গুরুত্বপূর্ণ।
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেলেননি একান্তভাবে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য, সেটা কতটুকু হল?
আমি অনেকটাই সন্তুষ্ট। মূলত যে জিনিসটা ছিল, ব্যাটিংয়ের চেয়েও বেশি হল শারীরিক ফিটনেস। যে লক্ষ্য নিয়ে লিগ মিস করেছিলাম, লক্ষ্যটা পূরণ হয়েছে।
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে এমন একটা টুর্নামেন্ট, যেটার দুটো দিকই থাকতে পারে, ভালো করলে একরকম আবার খারাপ করলে একরকম। ব্যক্তিগতভাবে এই সিরিজকে কিভাবে দেখছেন?
নেতিবাচক দিক যদি ধরতে হয়, তাহলে একটাই ব্যাপার আছে। সেটা হল, আমরা হয়তবা দেড় মাসের মধ্যে ১৩-১৪টা ম্যাচ খেলব (ত্রিদেশীয় সিরিজ ও বিশ্বকাপ)। এটাই নেতিবাচক পয়েন্ট। তাছাড়া আর কোনকিছু দেখি না। ওইসব কন্ডিশনে আমরা খুব বেশি খেলার সুযোগ পাই না। আমার কাছে মনে হয়, বিশ্রাম দিয়ে খেলোয়াড়দের খেলাতে হবে। যখন যার বিশ্রাম দরকার হয়। কারণ বিশ্বকাপে বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ নেই। আয়ারল্যান্ডে হয়ত পাঁচটা ম্যাচ খেলার সুযোগ থাকবে। কিন্তু ওখানেও দুই-একটা ম্যাচ করে যদি একটু পরিবর্তন করা হয়, সবাইকে মানসিকভাবে ফ্রেশ রাখতে, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
আপনার ওপেনিং পার্টনার সৌম্য সরকার গতকাল প্রিমিয়ার লিগের শেষ ম্যাচে ২০৮ রান করেছেন। বিশ্বকাপের আগে এই ইনিংসটা তাকে কতটা সাহায্য করবে?
এটা অনেক বড় অর্জন। বাংলাদেশি কেউ এই প্রথম ২০০ রান করেছে। যদিও আমরা খেলবো একেবারেই ভিন্ন একটা কন্ডিশনে, ভিন্ন বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে, তবুও রান করাটা সবসময়ই ইতিবাচক। এটা আত্মবিশ্বাস যোগায়। সে কোথায় রান করেছে এটা মুখ্য বিষয় নয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সে রান করেছে।
যদি শেষ দুই ম্যাচে দুইটা সেঞ্চুরি না করে ১০ আর ৫ করে ট্যুরে যেত, ওর মাথার মধ্যে এক শতাংশ হলেও চাপ থাকত। কিন্তু এখন রান করে যাচ্ছে। যখন রান করেন, তখন আপনি এটা জানেন কীভাবে রান করতে হয়। যখন কারো ফর্ম খারাপ যায়, তখন সে ভুলে যায় যে কীভাবে রান করতে হবে। তাই এটা তার জন্য খুব ইতিবাচক যে, আয়ারল্যান্ডে যাবার আগে দুটো বড় ইনিংস খেলেছে।
আপনি দীর্ঘদিন ধরে ওপেন করছেন, কিন্তু অন্যপ্রান্তে নিয়মিত ওপেনার পরিবর্তন হয়। এখন পর্যন্ত আপনার একজন নিশ্চিত ওপেনিং সঙ্গী নেই। এটা মানসিকভাবে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে কিনা?
শুধু একটি ম্যাচ হলে তেমন কোনো সমস্যা করে না। কিন্তু যখনই আপনার একজন নিয়মিত ওপেনিং সঙ্গী থাকবে, তখন যেটা হয়, আমরা দুজনই আমাদের খেলাটাকে ভালো বুঝতে পারি। অনেক সময় হয়তবা এমন থাকে, আমার টাইমিং ভালো হচ্ছে না। হয়ত আমি মারছি, কিন্তু ফিল্ডারের কাছে চলে যাচ্ছে। তখন আমার সঙ্গী হয়ত মারার সুযোগ নেয়। একইভাবে ওর সাথে যদি এই জিনিসটা হয়, আমার ঝুঁকি নিয়ে মারতে হয়। আমি নিশ্চিত, লিটন এবং সৌম্য পর্যাপ্ত সুযোগ পাবে। আমার বিশ্বাস তারা সঠিক সময়ে জ্বলে উঠবে।
ইংল্যান্ডে আপনার অনেক অর্জন। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভালো খেলেছেন, লর্ডসে টেস্ট সেঞ্চুরি। ইংল্যান্ডের মাটিতে এবার স্মরণীয় কিছু করার ব্যাপারে আপনি কতটা আত্মবিশ্বাসী?
এগুলো নিয়ে একটা ফোঁটাও ভাবি না যে, ইংল্যান্ডে ভালো করেছি। আমার কাছে মনে হয়, যদি এগুলো ভাবি সেটি আমাকে সাহায্য করবে না। এতটুকু জানি, সামনে কঠিন সময়। আরও বেশি কঠিন হবে যদি বিশ্বকাপে সফল হতে চাই। আমাকে শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। তাই কী করেছি ইংল্যান্ডের মাটিতে, সেটা নিয়ে খুব বেশি ভাবি না। এটা অতীত ইতিহাস (ইংল্যান্ডে সাফল্য) হয়ে থাকুক, সেটাই চাই। ভালো করি বা না করি, কখনো পিছনের জিনিস নিয়ে চিন্তা করতে চাই না। যেটা বর্তমানে আছে, সেটা নিয়েই আমাকে ভাবতে হবে। আর একটা জিনিস জানি, যদি বিশ্বকাপে সফল হতে চাই, আমাকে প্রচণ্ড কষ্ট করে এবং মাঠে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েই সেটা করতে হবে।
ব্যাটিংয়ের সময় সঙ্গীকে বুঝতে পারা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যখন একটা মানুষের সাথে যেকোনো কিছুতে, যেকোনো পেশায়- আপনার পেশাতেই চিন্তা করেন না কেনো, যদি একজন সহকর্মীর সাথে ২০ বছর ধরে কাজ করেন, তাহলে সে আপনার পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারগুলো জানবে। এটা সব পেশাতেই প্রযোজ্য। যারা বিশ্বের কিংবদন্তীতুল্য ওপেনিং পার্টনার, হেইডেন-গিলক্রিস্ট, গাঙ্গুলি-শচীন, শেবাগ-শচীন, এদের মধ্যে দেখবেন একটা বোঝাপড়া থাকত। যখন ওদের খেলা ম্যাচগুলো দেখবেন, তারা কিন্তু একজন আরেকজনের চাওয়া সম্পর্কে জানত।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের এখনও সেটি হয়নি। কিন্তু আমি নিশ্চিত, যে দুজন (সৌম্য ও লিটন) বিশ্বকাপে যাচ্ছে, তারা বাংলাদেশের হয়ে আগামী ১০-১৫ বছর খেলার সামর্থ্য রাখে। ভালো একটা পারফরম্যান্স দেখানোর এটাই সেরা সময় বলে মনে করি।
এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে বিশেষ কোনো লক্ষ্য আছে?
কোনো টার্গেট নেই। কারণ আমার কাছে মনে হয়, যখনই কোনকিছু নিয়ে বেশি ভাবি, যেকোনো কারণেই হোক সেখানে পৌঁছাতে পারি না। তাই এটা নিয়ে খুব বেশি ভাবছি না। বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি নেই, এই নেই, সেই নেই- সবই জানি। এটা (পরিসংখ্যান) তো পরিবর্তন করতে পারব না। এই বিশ্বকাপে যদি এটাই টার্গেট করে যাই যে, একটা সেঞ্চুরি করতে হবে বা খুব রান করতে হবে, তাহলে আসলে অপ্রয়োজনীয় চাপ নিবো আমার উপরে। এটা চাই না। দল আমাকে যেটা করার দায়িত্ব দেবে, যদি পালন করতে পারি, তাহলেই সুযোগ আসবে বড় ইনিংস খেলার। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল দলকে একটা ভালো শুরু এনে দেয়া এবং যে রোলটা দেয়া হয়েছে সেটা ভালোভাবে পালন করতে পারা।
বিশ্বকাপে বড় রানের ম্যাচ হবে, বাংলাদেশকে কোনো কোনো ম্যাচে বড় টার্গেট তাড়া করতে হতে পারে। তখন খেলার ধরণটা কী হবে?
এই জিনিসটায় আমরা খুব একটা অভ্যস্ত নই, ৩৪০-৩৫০ তাড়া করা। সাথে এটাও জানি, বিশ্বকাপে হয়ত বেশিরভাগ ম্যাচেই আমাদের ২৮০-৩০০-৩২০ চেজ করতে হবে। ফলে এটা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। এই কারণেই এই ট্রেনিং সেশনগুলো বা যে পাঁচটা ম্যাচ আমরা খেলবো আয়ারল্যান্ডে, সেগুলো এত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ওই পরিকল্পনায় কীভাবে আগাব, আমাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে যে, আমাদেরকে বড় রান তাড়া করতে হবে।
আমার মনে হয়, ৩০০ রানে কোনো প্রতিপক্ষকে আটকাতে চাইলেও বোলারদেরকে খুব ভালো বল করতে হবে। দুই-একদিন ব্যতিক্রম যেতে পারে, যেদিন আপনি ২৪০-২৫০ রানে অলআউট করে দিতে পারেন। আমার কাছে মনে হয়, ইংল্যান্ড ৩০০ রান তাড়া করার মতো। এটার জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। আমাদের অতীত ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে হয়ত দেখা যাবে, আমরা খুব বেশিবার এরকম রান তাড়া করিনি। তার অনেক বড় কারণ হল, আমরা যেখানে খেলি, সেখানে ৩০০ রান খুব বেশি হয় না। আশা করবো যে পরিকল্পনা আমাদের দেয়া হবে, সেটি যেন বাস্তবে রূপ দিতে পারি।
নেটে ব্যাটিং নিয়ে আলাদা কিছু করছেন কিনা?
ওই কন্ডিশনে আমার সাথে হতে পারে, এমন সবকিছু নিয়েই কাজ করছি এবং চেষ্টা করছি। সবসময় বলি, প্রস্তুতিটা পুরোটাই আমার হাতে। এটা নিয়ে যা ইচ্ছা তা করতে পারি। কষ্ট করতে পারি, ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে পারি। মাঠে গিয়ে কি হবে না হবে, সেটা অনেক সময় আমার হাতে থাকে না। তবে ট্রেনিংয়ের দিক থেকে সবই চেষ্টা করছি।