অপহরণের শিকার হয়ে ফিরে আসা কুমিল্লার তিতাস উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা পারভেজ হোসেন সরকার জানিয়েছেন: ক্রসফায়ারের হুমকি দেখিয়ে তিনশ’ টাকার দুই সেট স্ট্যাম্পে ও দুটি সাদা কাগজে বাংলা-ইংরেজীতে আটটি সাক্ষর নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। যে উদ্দেশ্যে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, অপহরণের খবর গণমাধ্যমে প্রচার হয়ে গেলে তা পরিবর্তন করে ফেলে দুর্বৃত্তরা।
শুক্রবার জুমার নামাজের পর লালমাটিয়ার নিজ বাসার সামনে থেকে অপহরণের শিকার হন পারভেজ হোসেন। এর ৮ ঘন্টা পর পূর্বাঞ্চলের কাঞ্চন ব্রিজে উদ্ধার হয়ে সুস্থ দেহে বাড়ি ফিরেন তিনি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে শনিবার বিকেলে লালমাটিয়ায় নিজ বাসায় চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেন পারভেজ হোসেন। এসময় তিনি বলেন: ‘শুক্রবার নামাজ পড়ে বাসায় ঢোকার সময় একজন আমাকে সালাম দেয়। আরেকজন পেছন থেকে এসে আমাকে টেনে গাড়িতে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে। ওই সময় তাদের সঙ্গে আমার ধস্তাধস্তি হয়, একপর্যায়ে তারা পিস্তলের বাট দিয়ে আমার বাম কানে নিচে আঘাত করে। আমাকে গাড়িতে উঠিয়ে ক্লোরোফোর্ম করা হয়। পরে কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে আমার মুখে একটি মুখোশ পড়ানো হয়। পরবর্তীতে দুই হাতে হাতকড়া দিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে আমাকে শুইয়ে রাখা হয়। গাড়িটিতে আমিসহ পাঁচজন ছিলাম।
‘‘গাড়িতে উঠার পর দুই তিন মিনিট আমার জ্ঞান ছিল। গাড়ি থেকে নামানোর আধা ঘণ্টা আগে আমার জ্ঞান ফিরে আসে। তারা রাত ১০টা ৪০ মিনিটে অন্ধকার একটি রাস্তায় আমাকে নামিয়ে দেয়। এরমাঝে তিনশ’ টাকার দুই সেট স্ট্যাম্পে ও দুটি সাদা কাগজে বাংলা ইংরেজীতে আটটি সাক্ষর নেয় তারা। স্ট্যাম্পে সাক্ষর করতে অপারগতা প্রকাশ করায় ক্রসফায়ারের হুমকিও দেয় তারা।
তবে কী কারণে স্ট্যাম্পে সাক্ষর নেয়া হলো, এ ব্যাপারে এখনো কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আমার কোনো ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব নেই, নিজেও সন্ত্রাস-হামলা পছন্দ করি না। হয়তো কোনো চাপে ফেলতে এমনটা করা হয়েছে।’’
পারভেজ বলেন: যে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, অপহরণের খবর গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারের পর সেই অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলে দুর্বৃত্তরা।
অপহরণের পর কোনো খাবার খেতে বলা হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন: একবার শুধু আমি ইনটেক বোতলের পানি খেয়েছি। তবে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য তারা আমাকে ডেকেছিল, কিন্তু বিরিয়ানী জাতীয় খাবার ছিল বলে সেটা আমি খাইনি।
তিনি বলেন: গাড়িতে যতোটুকু বুঝেছি পিনপতন নীরবতা ছিল। দুর্বৃত্তদের মুঠোফোন বেজেছে কিন্তু কেউ তা রিসিভ করেনি। অনেকের ভাইবারেও ফোন এসেছিল।
এই আট ঘণ্টার মধ্যে শুধু গাড়িতেই রাখা হয়েছে, নাকি অন্য কোথাও নামানো হয়েছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে তিতাস উপজেলার সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন: যতদূর মনে পড়ে একবার আমাকে নামানো হয় এবং কোথাও সিড়ি বেয়ে উঠানোর চেষ্টা করা হয়। যার জন্য আমার পায়েও ব্যথা রয়েছে।
নামানোর সময় দুর্বৃত্তরা কী বলেছিল জানতে চাইলে পারভেজ বলেন: আমাকে এক হাজার টাকার নোট দিয়ে একটা অন্ধকার রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে তারা বলে- বাসায় চলে যান, কোনো সাংবাদিক বা মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলবেন না। আওয়ামী লীগ করেন বলে বেঁচে গেলেন, নামিয়ে দেওয়ার এক মিনিট পর মুখোশ খুলবেন।
‘‘মিনিট খানেক পর আমি মুখোশ খুলে আলো খুঁজতে থাকি। এসময় একটা গাড়ির তেলের দোকান পাই তিনশ ফিটের কাঞ্চন ব্রিজের আগে। ওই দোকানিকে বলে তার মোবাইল দিয়ে আমার স্ত্রীকে ফোন দেই। পরে আমার বন্ধু ফরিদপুরের এমপি নিক্সন চৌধুরীসহ আমার পরিবারের লোকজন চলে আসে। এরপর পুলিশ ও র্যাবের সদস্যরা আসে।’’
অপহরণ বিষয়ে কোনো মামলা করবেন কিনা জানলে চাইলে তিনি বলেন: রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।
কারা এ ঘটনা ঘটাতে পারে বলে আপনার মনে হয়? এ বিষয়ে পারভেজ বলেন: রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ থাকা স্বাভাবিক। তারপরেও যেহেতু আমি এ বিষয়ে জানি না, তাই এ মুহূর্তে এটা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না। কারণ আমি কাউকে দেখি নাই।
‘‘আমি একবছর ধরে আমার এলাকায় যাই না। কারণ আমার ওপর আগে হামলা হয়েছিল। কিন্তু এজন্য আমাকে অপহরণ করা হয়েছে, এটা আমি এখনই বলতে চাই না। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করছে। তারাই বিষয়টি বের করুক।’’
পারভেজ বলেন: যে গাড়িতে করে আমাকে অপহরণ করা হয়েছিল (ঢাকা মেট্রো-১৪২৫৭৭) সেটাও ফেইক গাড়ি নম্বর। সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও গণমাধ্যমের তৎপরতার পরই তারা তাদের উদ্দেশ্য পরিবর্তন করে বিধায় আমি ফিরে আসতে পেরেছি। সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জামাল উদ্দিন মীর চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: তিনি (পারভেজ) ফিরে এসেছেন। আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি। যে গাড়িতে তাকে তোলা হয়েছিল সেই গাড়ির নম্বরটি ব্লক। বিআরটিএ থেকে আমাদের জানানো হয়েছে এই নম্বর তারা এখনও কাউকে দেয়নি। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। উনি স্বাভাবিক হলে তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তবে অপহরণকারীদের কাউকে এখনও শনাক্ত করা যায়নি।
লালমাটিয়া সি ব্লকের একটি বাড়িতে দুই ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন পারভেজ। ২০০৯-২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি তিতাসের উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। পারভেজ হোসেন সরকার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-২ আসন (তিতাস-হোমনা) থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। বর্তমানে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য তিনি।