হাত, পা, চোখ, কান, মাথা থাকলেই কি মানুষ হওয়া যায়? মানুষ হওয়ার জন্য নীতি নৈতিকতা সম্পন্ন সমন্বিত গুণের সমন্বয় প্রয়োজন। কারো উপকার করতে না পারলেও নিদেনপক্ষে আমার দ্বারা কারোর কোনরূপ ক্ষতি হবে না এমন মানসিকতাকে প্রত্যেকের মধ্যে বপন করা প্রয়োজন। তা না হলে মানুষরূপী পশু হয়ে জীবনযাপন করার কোন মানে হয় না। কথা বলছিলাম করোনার প্রকোপ ও প্রাদুর্ভাব নিয়ে, সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশে গৃহীত ব্যবস্থা ও উদ্যোগ গ্রহণের সামগ্রিকতা নিয়ে।
পারিপ্বার্শিকতা বিবেচনায় নিয়ে ও বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করে সরকার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে ছেলেমেয়েদের বাসায় কিংবা বাড়িতে নিরাপদে রাখার জন্য। কিন্তু পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সরকারকে বাধ্য হয়ে পর্যটন কেন্দ্রগুলো বন্ধ করার জন্য ঘোষণা প্রদান করতে হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে জরিমানা করতে বাধ্য হয়েছে সরকার।
করোনা ভাইরাস যে কতটা ভয়াবহ সেটা কিন্তু ইটালি, চীনসহ আক্রান্ত দেশগুলোর দিকে একবার তাকালে বোঝা যায়। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে নতুন নতুন সংখ্যার সংযোজন হচ্ছে, তারপরেও আমাদের বোধোদয় হচ্ছে না। একথা বলতে বাধা নেই যে, আক্রান্ত দেশগুলোর তুলনায় আমাদের দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা খুব ভাল নয়। তাই আমাদের প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। আর সেই প্রতিরোধের জন্য মূল হাতিয়ার হিসেবে এ দেশের প্রত্যেক জনগণকে আন্তরিকতা ও সচেতনতার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দেখাতে হবে। অন্যথায় করোনার হিংস্র থাবা থেকে জনজীবনে যে ক্ষয়ক্ষতি নেমে আসবে দীর্ঘমেয়াদেও সেটা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না।
আমরা খুব আবেগী জাতি, আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা চরম ও পরম মাত্রার ভুলের শামিল। কেননা, বিদেশ ফেরত প্রত্যেককেই সরকার বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনের কথা বলেছে। কিন্তু সেটি তেমন কাজে আসছে বলে মনে হয় না। কেননা ইতিমধ্যে খবর বেড়িয়েছে বিদেশ ফেরত কোয়ারেন্টিনে থাকা এক যুবক সদ্য বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন। সরকারও কোনভাবে এর দায় এড়াতে পারেনা। কারণ, বিদেশ থেকে আসা ফ্লাইটগুলো অনেক আগেই বন্ধ করে দেওয়া উচিত ছিল। দেখা যাচ্ছে, বিদেশ থেকে আসাদের কাছ থেকে করোনা ভাইরাসটা সংক্রমিত হচ্ছে এবং এ ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে আসা মানুষদের দায়ও কিন্তু কম নয়। তারা উন্নত দেশ থেকে জেনে বুঝেই ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। তাদের কিন্তু বিষয়টি আমলে নেওয়া উচিত ছিল কারণ তারা ভাইরাসটির ভয়াবহতা সম্বন্ধে ইতিমধ্যে অবগত।
একটি কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আমি আপনি নিরাপদ থাকলেও কিন্তু হবে না। আমাদের পরিবেশ প্রতিবেশের প্রত্যেকটি অনুসঙ্গকে অবশ্যই সুরক্ষায় রাখতে হবে না হলে যে কোন সময় আমরা ভাইরাসের সংক্রমণে আক্রান্ত হতে পারি। কাজেই অন্যদেরকে সুরক্ষা ও নিরাপদে রাখার জন্য প্রত্যেককেই স্ব স্ব জায়গা থেকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। ইটালি ফেরত এক প্রবাসীকে হজ ক্যাম্পে নেওয়ার সময় তার মুখ নিসৃত যে বাণীগুলো আমরা শুনেছি রেমিট্যান্স যোদ্ধা বলে যাদেরকে আমরা সম্মানের প্রথম দিকে রেখেছিলাম কিয়দংশ হলেও সেটা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। কারণ আপনি যদি প্রকৃত অর্থেই দেশমাতৃকার তরে রেমিট্যান্সে ভূমিকা রাখেন তাহলে এ দুর্যোগ সময়ে আপনি বা আপনারা দেশে এসে আমাদেরকে বিপদের রাস্তাকে আর ত্বরান্বিত করতেন না।
এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত তবে খবরের মাধ্যমে জানা যায় প্রবাসীরা কোয়ারেন্টাইন মানছেন না অনেকেই। তারা বাজারে, চায়ের দোকানে দেদারসে আড্ডা দিচ্ছে অনেকেই আবার শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত গ্রহণ করছে। এ কথাটি আমরা কেন ভুলে যাই আমি যদি সংক্রমিত হই তাহলে আমার দ্বারা আমার পরিবারের যে কেউই সংক্রমনের স্বীকার হতে পারে।
কাজেই পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে হলেও প্রবাসীদের নিয়মমাফিক ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকা জরুরী। কিন্তু সে বিষয়টি সকলেই যেন বেমালুম ভুলে যাচ্ছে বিশেষ করে প্রবাসীরা। সুতরাং বলা যায়, ভাইরাসের সংক্রমণের ভয়াবহতা দেখা দিলে রোগীকে চিকিৎসা প্রদান করা আমাদের জন্য দুরূহ। কাজেই প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা যতটুকু সম্ভব উন্নত করে করোনার ভয়াবহতা কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু আমরা যেন বিষয়টাকে গুরুত্বই দিতে চাচ্ছি না। যে বিষয়গুলো করোনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ সেগুলোই আমরা বেশি করে করছি।
জনসমাবেশ নিষিদ্ধ কিন্তু মন্ত্রী হাসপাতাল পরিদর্শনে দলবল নিয়ে যাচ্ছেন। আবার দেখা যাচ্ছে দর্শনীয় স্থানগুলোতে উপচে পড়া ভিড়, লাখো লোকের সমাবেশে দোয়া পড়া হচ্ছে। এসব কিন্তু প্রকৃত মানুষের নমুনায়ন নয়। কবে এবং কিভাবে আমাদের বোধোদয় হবে সেটি নিশ্চিত করে এখনও বলা যাচ্ছে না। যত দ্রুত উদ্ভুত সমস্যাগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে আমরা মানুষরূপী আচরণ করতে পারবো ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।
অন্যদিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় কোন সংকট এলেই এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে কুন্ঠাবোধ করে না। বাজারে মাস্ক এবং হ্যান্ডগ্লাভসের প্রচুর সংকট দেখা দিয়েছে। একেবারে যে পাওয়া যাচ্ছে না বিষয়টা তেমন নয়, উচ্চমূল্যে ঠিকই পাওয়া যাচ্ছে। ১০ টাকার মাস্ক ১৫০-২০০ টাকা বিক্রি করতেও আমাদের শঙ্কা লাগছে না। আসলে কি আমরা মানুষ? না মানুষরূপী দানব। শুধু কি তাই? হাসপাতালে ডাক্তার নার্সদের ব্যবহৃত মাস্ক শ্যাম্পু দিয়ে পরিস্কার করে ইস্ত্রি করে বাজারজাত করছে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। এই ব্যবসায়ীদের কাছে আমার প্রশ্ন এক জীবনে আপনাদের কত টাকার প্রয়োজন?
আপনারা কেন ভুলে যাচ্ছেন, যে কোন ভাবেই হয়তো আপনার পরিচিত আত্নীয় স্বজন কিংবা আপনার পরিবারের সদস্য এসব মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন। ব্যবহৃত মাস্ক ব্যবহার করলে যে কেউ সংক্রমিত হতে পারে; কেমন হবে বিষয়টা যখন আপনার পরিবারের কেউ সংক্রমিত হলো এবং তার মাধ্যমে আপনিও সংক্রমিত হলেন। কাজেই ভাইরাস যে কোনভাবেই আমাকে আপনাকে আক্রমণ করতে পারে। পাশের জনকে বিপদে ফেলে আপনি নিরাপদে থাকবেন এমনটা ভাবা মোটেই ঠিক নয়। কাজেই সময় থাকতে আমাদের সকলের সাবধান হওয়া উচিত। মাস্কের পাশাপাশি হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সাবান, তেল, চাল, ডাল সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রবাদ্রির দাম নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার নমুনা দেখা যাচ্ছে। এ যেন কারো পৌষ মাস আবার কারো সর্বনাশ।
পরিশেষে একটি কথাই বলবো, জাতির এ সংকটকালে প্রত্যেককে স্ব স্ব জায়গা থেকে মানবিকতার পরিচয় দিতে হবে। অন্যথায় মারত্মক এবং ভয়ানক পরিণতি অপেক্ষা করছে সকলের জন্য। গুজবে বিভ্রান্ত না হয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থেকে সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে এবং যে কোন খারাপ পরিস্থিতিতে আইইডিসিআর সহ সরকার প্রদত্ত সংশ্লিষ্ট হটলাইনে যোগাযোগ রাখতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)