শুক্রবার। ঘড়িতে সময় বিকাল সাড়ে চার। কিংবদন্তি নির্মাতা, লেখক ও গীতিকার আমজাদ হোসেনের মৃত্যু সংবাদটি সোশাল মিডিয়ার বদৌলতে রীতিমত ছড়িয়ে গেছে। তার এমন মৃত্যু সংবাদে শোক প্রকাশে আরেকজন নির্মাতা লিখলেন, ‘গোলাপীকে নিয়ে ট্রেনে করে চলে গেলেন আমজাদ ভাই’।
আমজাদ হোসেনের মৃত্যু সংবাদে তার সৃষ্টির কথা আলোচনায় চলে আসবে এটা স্বাভাবিক! আর ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ তো তার অনন্য সৃষ্টি। স্বভাবতই মনে হলো, আচ্ছা, গোলাপী কি জানেন তার নির্মাতার মৃত্যু সংবাদটি! এমন কৌতূহল থেকেই তাকে ফোন। স্বাভাবিক কণ্ঠেই ‘হ্যালো’ বলে ফোন ধরলেন তিনি। জানতে চাইলেন কেনো ফোন দিয়েছি।
আপনি কি আমজাদ ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদটি শুনেছেন? জিজ্ঞেস করতেই ফোনের অপর প্রান্তে চুপ মেরে গেলেন গোলাপী! আচমকা এমন সংবাদের জন্য কি তিনি প্রস্তুত ছিলেন? হ্যালো…হ্যালো…! চুপ মেরে আছেন আমজাদ হোসেনের বিখ্যাত চরিত্র গোলাপী! একটু দম নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। স্পষ্ট শোনা গেল। হয়তো অসংখ্য স্মৃতি তাকে ঝেঁকে বসেছে। মুখ খুললেন এবার। কণ্ঠস্বর কিছুটা ভারি মনে হলো তার। জানতে চাইলেন কখন মারা গেছেন তিনি, কবে নিয়ে আসা হবে, ওইখানে উনার সাথে আর কে আছে? এরকম আরো অসংখ্য প্রশ্ন তার।
ধীরে ধীরে স্বাভাবিক কণ্ঠে ফিরলেন গোলাপী। বললেন, আহারে! কতো কতো স্মৃতি আমজাদ ভাইয়ের সাথে। উনার সাথে আমি বহু ছবিতে কাজ করছি। তার নির্দেশনায় বেশকিছু হিট ছবি আছে আমার। তার মৃত্যু সংবাদ বেদনার, খুবই দুঃখের। তার মতো এমন জিনিয়াস মানুষ আমি জীবনে খুব কম পেয়েছি। তার আত্মার শান্তি কামনায় দোয়া করি। এমনটা বলেই আবারও দীর্ঘশ্বাস গোলাপীর!
এরআগে নির্মাতা, অভিনেতা, গীতিকার ও লেখক আমজাদ হোসেনে ব্রেইন স্ট্রোক করে রাজধানীর ইমপালস হাসপাতালে ভর্তি হলে ২১ নভেম্বর সেখানে তাকে দেখতে এসেছিলেন ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ খ্যাত অভিনেত্রী ববিতা। সেটাই ছিলো এই কিংবদন্তির সাথে তার শেষ দেখা। কথা হয়নি যদিও, দূর থেকে বহুক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন। এমনটাই বললেন ববিতা।
এরআগে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ নিয়ে নিজের মুগ্ধতার কথা চ্যানেল আই অনলাইনকে জানিয়েছিলেন ববিতা। ছবিটি নিয়ে তিনি বলেন, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ তো সারা বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মানুষের গল্প। যেসময় মুক্তি পায় সেসময়ের প্রতিটি গ্রাম বাংলার মানুষের গল্প। ছবির প্রত্যেকটা ডায়ালগ কি যে অসামান্য ছিলো, ভাবতেও ভালো লাগে এখন। সেসময়তো অফিস আদালতেও ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’র ডায়ালগগুলো বলে বেড়াত। বিশেষ করে ওই কথাটাতো ছড়িয়ে গিয়েছিলো মানুষের মুখে মুখে, তিন মহিলা যখন শহরে গিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য করে, সেখানে একটি কথা আছে না! যে ট্রেনে উঠার পর তাদের জিজ্ঞেস করা হয়, তোমরা যে ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসে এসে ঢুকলা, তোমরা টিকেট কেটেছো? তখন গোলাপী একটা কথা বলে, বাংলাদেশে কোনো কেলাস(ক্লাস) নাইক্যা, আমরা হগলেই এক কেলাসের(ক্লাস) মানুষ। এই যে এই ডায়ালগগুলো, কি অসাধারণ ভাবেই না আমজাদ ভাই ফুটিয়ে তুলেছিলেন তার চরিত্রদের মধ্য দিয়ে।
আমজাদ হোসেন সমকালীন সময়ের মেধাবী নির্মাতাদের একজন ছিলেন জানিয়ে ববিতা আরো বলেন, আমিতো জীবনে তিনশোর মতো ছবিতে কাজ করেছি, কিন্তু আমজাদ ভাইয়ের ছবিগুলো তারমধ্যে ছিলো ব্যতিক্রম। তার ছবিগুলো আর্টফিল্ম-ক্যাটাগরির না, কমার্মিশিয়ালিই সব ছবি সুপার ডুপার হিট হয়েছে, কিন্তু ছবির গল্প, ডায়ালগ সব রিয়েলিস্টিক। আসলে তিনিতো জহির রায়হানদের সাথে কাজ করেছেন, জহির রায়হানের অ্যাস্টিস্টও করেছিলেন তিনি।
‘হায়রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতে অন্ধ’-গানের লিরিক লেখার প্রসঙ্গ এনে আমজাদ হোসেনকে নিয়ে ববিতা বলেন, আমরা তখন ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’র শুটিং করছি। ট্রেন যাচ্ছে জামালপুরের দিকে। এরমধ্যেই ট্রেনে বসেই আমজাদ ভাই একটা গান বেঁধে ফেললেন, একেবারে ইনস্ট্যান্ট বসে। গানটি হলো ‘হায়রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতে অন্ধ’। অবাক করার মতো বিষয়। তার মতো ট্যালেন্ট মানুষ খুব কমই আছে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে। পরে এই গানটি রেকর্ড করে এই ছবিতেই ব্যবহার করেছিলেন তিনি। এই গানটিও সেই সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো।
ব্রেন স্ট্রোক করে গত ১৮ নভেম্বর সকালে তেজগাঁয়ের ইমপালস হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের মাইলস্টোন ছবি ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’র নির্মাতা আমজাদ হোসেন। হাসপাতালে ভর্তির পর থেকেই ছিলেন টানা লাইফ সাপোর্টে। তার অবস্থা দেখে চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, কোনো মিরাকল না ঘটলে বাঁচানো যাবে না আমজাদ হোসেনকে।
না, কোনো মিরাকল ঘটেনি। উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সহায়তায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ২৭ নভেম্বর দিবাগত রাতে নিয়ে যাওয়া হয় ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে। সেখানে প্রায় ১৭ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর মারা গেছেন এই কিংবদন্তি নির্মাতা।
আমজাদ হোসেনের পরিচালনায় জনপ্রিয়তা পাওয়া ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বাল্যবন্ধু’, ‘পিতাপুত্র’, ‘এই নিয়ে পৃথিবী’, ‘বাংলার মুখ’, ‘নয়নমনি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘সখিনার যুদ্ধ’, ‘ভাত দে’, ‘হীরামতি’, ‘প্রাণের মানুষ’, ‘সুন্দরী বধূ’, ‘কাল সকালে’, ‘গোলাপী এখন ঢাকায়’ ‘গোলাপী এখন বিলেতে’ ইত্যাদি।
১৯৭৮ সালে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ এবং ১৯৮৪ সালে ‘ভাত দে’ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া নানামাত্রিক কাজের জন্য ১৪ বার জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। একইসাথে বাংলা একাডেমী পুরস্কার সহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।